কিছুদিন থেকে পশ্চিমা গনমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছিলো, রাশিয়ার সহায়তায় স্বাধীন হওয়া উত্তরে ডনবাস এবং দক্ষিণে খেরসন অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। তারা বেশ কিছু এলাকা পুর্নদখল করতে পেরেছে বলে দাবি করা হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলোনেস্কি বিভিন্ন সময় শুধু ডনবাস অঞ্চল নয় রাশিয়ার ভেতরেও হামলার হুমকি দিয়ে আসছেন। ইউক্রেনের এই সাফল্যর খবরের মধ্যে মস্কোর দিক থেকে গনভোটের ঘোষণা আসে। ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও রাশিয়ার সেনাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সেখানে ইতোমধ্যে গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
ডোনেটস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্যেই এ গণভোটের আয়োজন। ২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের পক্ষ থেকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে গণভোটের আয়োজনের ঘোষনা দেয়।
পূর্বাঞ্চলীয় লুহানস্ক এবং ডোনেটস্ক এর পাশাপাশি দক্ষিণে জাপোরিঝিয়া এবং খেরসন থাকছে গনভোটের আওতায়।এসব অঞ্চলে ইতোমধ্যে রাশিয়া সমর্থিত প্রশাসকরা দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানকার অনেক নাগরিককে দেয়া হয়েছে রুশ পাসপোর্ট।
খেরসন অঞ্চলে রাশিয়ার নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তারা বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে খেরসনকে যুক্ত করা নিয়ে তাঁরা গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খেরসনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নেতাদের সুরেই কথা বলেছেন রুশ পার্লামেন্টের স্পিকার। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে যদি জনগণ ভোট দেন, তবে তিনি তাতে সমর্থন করবেন।
রাশিয়া এতো দ্রুত এসব অঞ্চল নিজ ভূখন্ডের অংশ করে নেবে তা পশ্চিমা দেশগুলো অনুমান করতে পারেনি। এর প্রতিক্রিয়ায় ন্যাটো সামরিক জোট বলছে, ন্যাটো সামরিক জোট বলছে, এই পরিকল্পনা যুদ্ধকে আরো দীর্ঘায়িত করবে।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন ডনবাস অঞ্চলসহ রাশিয়ার দখলে থাকা এলাকাগুলো মুল ভুখন্ডের সাথে যোগদানের মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের রুপ বদলে যেতে পারে। তখন এসব এলাকায় হামলাকে রাশিয়ার ওপর হামলা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এখন যেমন ক্রিমিয়া উপদ্বীপে হামলাকে রাশিয়ার ওপর হামলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। একই সাথে বিদ্রোহীদের সাথে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সরাসরি সামরিক অভিযানে অংশ নেবে। এর ফলে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া আরো তীব্র হামলা চালাতে পারে। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন যে বিপুল সৈন্য সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন তা থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ডোনেটস্ক ও লুহানস্ক রিপাবলিক এবং রাশিয়ার দখলে থাকা এলাকায় গনভোটের ঘোষণা দেয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন মাতৃভূমি রক্ষায় আংশিক সেনা সমাবেশের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের মাধ্যমে দেশটির রিজার্ভ ফোর্সের সদস্য ৩ লাখ রুশ নাগরিক ইউক্রেনে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেবে। এই নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। নির্দেশ দেয়ার পর পরই তা কার্যকর করা হয়।
ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, মুক্ত করা ভূখ-ের মানুষকে রক্ষার জন্য জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তাই আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে আংশিক সেনা সমাবেশে করতে বলেছি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানান, আংশিক ‘সেনাসমাবেশের’ অংশ হিসেবে তিন লাখ রিজার্ভ সেনাকে ডাকা হবে। অতীতের সামরিক অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, রাশিয়া এবং এর ভূখন্ড রক্ষা করতে দেশটির ২০ লাখ শক্তিশালী রিজার্ভ সেনা থেকে এই আংশিক ‘সেনাসমাবেশ’ করা হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, যেসব নাগরিক এ সিদ্ধান্তের আলোকে সংগঠিত হবে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মতো মর্যাদা দেওয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন এই ঘোষণার সাথে পশ্চিমা বিশ্বকে আরো কিছু বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের অখ-তা হুমকির মধ্যে পড়লে রাশিয়া এবং এর জনগণকে রক্ষার জন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নেবো। যারা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতে চায়, তাদের জানা উচিত যে, পাল্টা বাতাস তাদের দিকেও যেতে পারে। এটা কোনও ফাঁকা বুলি নয়।
অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পরিকল্পনা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। হতাহত হয়েছে বহু সেনা। ধ্বংস হয়েছে বিপুল সামরিক সরঞ্জাম। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পুতিন হতাশা থেকে সেনা সসামবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমা নেতারা প্রেসিডেন্ট পুতিনের পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘোষণা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার বক্তব্যর কড়া সমালোচনা করে বলা হচ্ছে, তিনি পারমানবিক হামলার হুমকি দিচ্ছেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামরিক দিক দিয়ে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে মাত্রায় রাশিয়াকে দূর্বল করা গেছে বলে মনে করা হচ্ছে, ততটা দূর্বল রাশিয়া হয়নি।
অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, বড় আকারের যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে রিজার্ভ সৈন্য সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছে রাশিয়া। হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট পুতিন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা বলা যাবে না। পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে মাধ্যমে ইউক্রেনের সাফল্য ও রাশিয়ান সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতির পর মস্কো একাধিকার যুদ্ধ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে। এবারও ফ্রন্টলাইনে থাকা সেনাদের পরিবর্তন করে নতুন ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন করা হবে।
রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের দিক হলো এর আগে ইউক্রেনের সৈন্যরা ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার সীমান্ত শহর বেলগোরেড একাধিকবার ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে। এখন রাশিয়া সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে পাল্টা আঘাত হানতে পারে।
ইউক্রেনের কাছে স্বল্প পাল্লার হিমারস, এন্টি-শিপ মিসাইল হারপুন আসার পর রাশিয়া বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাদের সেনা অবস্থান এসব মিসাইলের আওতার বাইরে নিয়ে যায়। রাশিয়ার অভিযোগ ইউক্রনকে এসব অস্ত্র সরবরাহ করে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন সৈন্য সমাবেশের ঘোষণায় পাল্টা পরমানু অস্ত্র ব্যবহারের যে কথা বলেছেন তা নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, যুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায় হলে এক পর্যায়ে রাশিয়া সীমিত আকারে পরমানু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। শুরু থেকে রাশিয়া এ নিয়ে সর্তক করে আসছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার নিউক্লিয়ার ফোর্সকে সর্তক রাখা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন পরমানু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে রাশিয়াকে সর্তক করেছেন। এর পরিনতি ভয়াবহ হবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্ব হয়তো ধীরে ধীরে আরেকটি পরমানু যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমা অস্ত্রের জোরে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু এ ধরনের প্রক্্ির যুদ্ধের শেষ পরিনতি কী সে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া বলছে লুহন্সক ও ডোনেটস্কের বিদ্রোহীদের সমর্থনে তারা বিশেষ সামনিক অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু লুহানস্ক, ডোনেটস্ক , খেরসন ও জাপোরোঝিয়া রাশিয়ার অংশ হওয়ার পর একে আর বিশেষ সামরিক অভিযান বলার উপায় থাকবে না। কারন এই এলাকাগুলো রাশিয়ার অংশ হিসাবে দেখবে মস্কো। এর ফলে আনুষ্টানিক ইউক্রেন - রাশিয়া যুদ্ধে রুপ নেবে। তাতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সাহায্যকারী দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
রাশিয়ার মিত্র দেশের কয়েকজন নেতা কিছুদিন থেকে ইউক্রেনে বড় আকারের যুদ্ধ এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছেন। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিক সর্তক করে বলেছেন, বিশ্ব বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। ভুসিক বলেন, একটি সামরিক অভিযান শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক সংঘাতে রুপ নিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি হতে পারে বড় সংঘাত।
এর আগে মে মাসে তিনি ইউরোপে জ্বালানী সংকট নিয়ে সর্তক বানী উচ্চারন করেছিলেন। সে সময় তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের চেয়ে ইউরোপের পরিস্থিতি শোচনীয় হতে পারে বলে সর্তক করেন।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের আরেক মিত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো তার দেশের সৈন্যদের বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। পারমাণবিক অস্ত্র বহনের জন্য সামরিক বিমানগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন লুকাশেঙ্কো। পরমানু হামলা চালাতে সক্ষম ইস্কান্দর এম ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থাও বেলারুশে মোতায়েনের ঘোষণা দেয়া হয়।
রাশিয়ার আরেক মিত্র ইরান পাঠিয়েছে ড্রোন। এসব ড্রোন ইউক্রেনের সেনাদের ওপর কার্যকর ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পশ্চিমা গনমাধ্যমে খবর এসেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বে নতুন মেরুকরনের জন্ম দিয়েছে। নানা ধরনের অবরোধ আরোপ করে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল করতে পারেনি। রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে ইউরোপের দেশগুলো। জ্বালানী সংকটকে কেন্দ্র করে আগামি শীতে ইউরোপের অনেক দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটতে পারে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে।
এছড়া চীন , রাশিয়া , ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলো ডলারের বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ঝুকে পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এ ধরনের তৎপরতা পশ্চিমা অর্থনৈতিক প্রভাব খর্ব করার ইঙ্গিত। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন সম্প্রতি শেষ হওয়া সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে বিভক্ত বিশ্বের রুপ ফুটে উঠেছে। একটি যুদ্ধের মধ্যদিয়ে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটতে পারে।