তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ১০০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে ২০২৩ সালে। এই উপলক্ষ্যে তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অস্ত্রাগারে বহুল প্রতীক্ষিত নতুন বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হবে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের এই প্ল্যাটফর্মগুলো সশস্ত্র বাহিনীতে যুক্ত হলে তার একটা ঝলক বিশ্ববাসী দেখতে পাবে।
প্রেসিডেন্সি অব ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ বা এসএসবি'র অধীনে নিজস্ব প্রযুক্তিতে বেশ কিছু অত্যাধুনিক সরঞ্জাম তৈরি করেছে তুরস্ক। যেগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর মাধ্যমে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প বছর খানেকের মধ্যে বহু প্রকল্পের ক্ষেত্রে বহু দূর এগিয়ে যাবে।
দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি প্রকল্প হলো ন্যাশনাল কমব্যাট এয়্যারক্র্যাফট বা এমএমইউ। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিএআই। ২০২৩ সালের ১৮ মার্চ এই প্রকল্পের অধীনে তৈরি বিমানগুলো হ্যাঙ্গার থেকে অবমুক্ত করা হবে।
টিএফ-এক্স এমএমইউ হলো পঞ্চম প্রজন্মের জেট বিমান, যেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের এফ-৩৫ লাইটনিং টু বিমানের মতো একই ধরণের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুর্কি বিমান বহরের এফ-১৬ জেট বিমানগুলো বদলে নতুন এই বিমানগুলো যুক্ত করা হবে। ২০৩০ এর দশকের মধ্যে বিমান বাহিনীর বহরের সবগুলো এফ-১৬ বিমান বদলে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে তুরস্ক। বহরে যুক্ত নতুন বিমানগুলো ২০২৫ সালে প্রথম আকাশে ওড়ানো হবে। আর ২০২৮ সালে এগুলো সরাসরি অভিযানে ব্যবহার করা শুরু হবে।
এই বিমান তৈরির মাধ্যমে তুরস্ক সেই সব দেশের তালিকায় চলে যাবে, যাদের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের বিমান তৈরির অবকাঠামো ও প্রযুক্তি রয়েছে।
প্রশিক্ষণ জেট বিমান ও হালকা অ্যাটাক বিমান 'হুরজেট'-ও প্রথমবারের মতো আকাশে উড়বে ২০২৩ সালের ১৮ মার্চ। চার ধরণের প্রটোটাইপ বিমান পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে অংশ নেবে। এই বিমানগুলোও সরাসরি ব্যবহার করা শুরু হবে ২০২৫ সালে। এক ইঞ্জিন, দুজন পাইলটের বসার আসন, এবং আধুনিক বিমান চালানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো ককপিট দিয়ে হুরজেট বিমান তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রশিক্ষণের সময় এগুলো উচ্চমানের পারফরমেন্স দিতে পারে। টি-৩৮ প্রশিক্ষণ জেট বিমান এবং এফ-৫ বিমানগুলো বদলে নতুন এই বিমান বহরে যুক্ত করা হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হবে হেলিকপ্টার। ভারি শ্রেণীর অ্যাটাক হেলিকপ্টার এটাক-২ প্রথমবারের মতো আকাশে উড়বে। ভারি ওজনের গোলাবারুদ বহনের সক্ষমতা দিয়ে বিশেষভাবে এই হেলিকপ্টার তৈরি করা হয়েছে। যে কোন আবহাওয়াতে দিনে বা রাতে এই হেলিকপ্টারগুলো অভিযান চালাতে পারবে। ১১ টন ওজনের এই হেলিকপ্টারগুলো ১ দশমিক ২ টন ওজনের গোলাবারুদ বহন করতে পারবে। গোলা বর্ষণের জন্য এই হেলিকপ্টারে ৩০ মিলিমিটার কামান যুক্ত থাকবে। টিএআই একইসাথে বহুমুখী হেলিকপ্টার 'গোকবে'-ও সরবরাহ করবে। এই কপ্টারগুলোরও যথেষ্ট ভার বহনের সক্ষমতা রয়েছে।
বায়রাক্তার কিজিলেলমা নামের নতুন যে মনুষ্যবিহীন জঙ্গি বিমান ডিজাইন করা হয়েছে, সেটিও প্রথমবারের মতো আকাশে উড়বে ২০২৩ সালে।
দুই ধরণের কিজিলেলমা বিমানের মেকানিক্যাল আর এভিওনিক সিস্টেমের মধ্যে এখন সমন্বয়ের কাজ চলছে। এই বিমানগুলো পাঁচ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে থাকতে পারবে, এবং ৩৫ হাজার ফুট উচ্চতার মধ্যে অভিযানে অংশ নিতে পারবে। এগুলো দেড় টন ওজনের প্রয়োজনীয় বোঝা টানতে পারবে।
ড্রোন তৈরি প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন কমব্যাট ড্রোন বায়রাক্তার টিবি-টু তৈরি করছে। তুরস্ক যে বহুমুখী অ্যাসল্ট জাহাজ টিসিজি আনাদোলু তৈরি করছে, এই নতুন ড্রোন সেই জাহাজ থেকে উড়তে ও সেখানে অবতরণ করতে পারবে। এই নতুন ড্রোনটিও আকাশে উড়বে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি। টিবি-থ্রি ড্রোনগুলো দেশের বাইরে পরিচালিত সশস্ত্র মনুষ্যবিহীন অভিযানে অংশ নিতে পারবে।
এর বাইরে, টুসাস এঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজ বা টিইআই টিএস১৪০০ টার্বোশ্যাফট ইঞ্জিন তৈরি করছে। গোকবে হেলিকপ্টারে এই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। এই ইঞ্জিনের সক্ষমতার পরীক্ষাও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই এই ইঞ্জিন সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এই ইঞ্জিনকে গোকবে হেলিকপ্টারের সাথে সমন্বয় করা হবে। এর পরেই কেবল নতুন ইঞ্জিনবিশিষ্ট কপ্টারগুলো অভিযানে অংশ নিতে পারবে।
তুরস্ক যে ফ্ল্যাগশিপ টিসিজি আনাদোলু জাহাজ তৈরি করছে, সেটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ। ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগেই এটা নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের প্রথম নিজস্বভাবে তৈরি জাতীয় বিমানবাহী রণতরী হবে এই টিসিজি আনাদোলু। এই জাহাজ তুরস্কের নৌবাহিনীর আভিযানিক সক্ষমতা অনেক বাড়িয়ে দেবে।
টিসিজি আনাদোলু জাহাজ ২৭ হাজার ৪৩৬ টন ওজনের। জাহাজটি লম্বায় ২৩১ মিটার আর চওড়ায় ৩২ মিটার। টিসিজি আনাদোলুকে সাধারণভাবে বিমানবাহী রণতরীও বলা হচ্ছে। এজিয়ান সাগর, কৃষ্ণ সাগর, ও ভূমধ্যসাগরে, এবং প্রয়োজনে ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের জলসীমায় অভিযানের ক্ষেত্রে এই জাহাজকে কাজে লাগাতে পারবে তুরস্কের নৌবাহিনী।
এছাড়া 'নিউ টাইপ সাবমেরিন প্রজেক্টের' অধীনে যে সাবমেরিনগুলো তৈরি হচ্ছে, তার প্রথম ছয়টি চলতি বছরেই হস্তান্তর করা হবে। টাইপ-২১৪ নামে পরিচিত এই সাবমেরিনগুলোতে যে জ্বালানি সেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, সে কারণে এগুলোর এয়ার- ইনডিপেন্টেনট প্রপালশান সক্ষমতা রয়েছে। এগুলো হবে তুরস্কের নৌবাহিনীর বহরের প্রথম সাবমেরিন।
সাগরতলে, সাগরপৃষ্ঠে এবং স্থলের বিভিন্ন টার্গেটে আঘাত হানার উপযোগী অস্ত্র দিয়ে এই সাবমেরিনগুলো সুসজ্জিত থাকবে। এই সাবমেরিনগুলো বিভিন্ন ধরণের টর্পেডো, মিসাইল ছুড়তে পারবে এবং মাইন বসাতে পারবে।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা কারখানাগুলোতে নতুন মনুষ্যবাহী ও মনুষ্যবিহীন দুই ধরণেরই যানবাহন তৈরি করা হচ্ছে। এগুলোও প্রথমবারের মতো সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রাগারে যুক্ত করা হবে।
এগুলো তৈরি করছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানি এফএনএসএস। নৌবাহিনীর উভচর যানবাহনের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। জল ও স্থল উভয় জায়গায় অভিযানের ক্ষেত্রে এই এমএভি যানবাহনগুলো সেনাদেরকে নিরাপদে উপকূলে ল্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। ল্যান্ডিংয়ের পর এগুলোই আবার সেনাদের সাঁজোয়া যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
পৃথিবীতে সামান্য হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কাছে এই ধরণের যানবাহন আছে। ন্যাটো এবং তাদের মিত্রদের কাছেও এগুলো আছে। এফএনএসএস ছাড়া আর একটি মাত্র কোম্পানি এই যানবাহন তৈরি করতে পারে।
পার্স ফোর সিক্স-বাই-সিক্স স্পেশাল অপারেশান্স যানবাহনও তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনীর বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এগুলোর ডিজাইন করেছে এফএনএনএস। মাইন ও ব্যালিস্টিক অস্ত্র থেকে সুরক্ষার জন্য এগুলোতে উচ্চ পর্যায়ের সুরক্ষা সিস্টেম রয়েছে। এই যানবাহনে তিনটি ভিন্ন ধরনের অস্ত্র সিস্টেম রয়েছে। এগুলো যে কোন বিশেষ অভিযানে অংশ নিতে সক্ষম।
'ভুরান' হলো তুরস্কের প্রথম আধুনিক সাঁজোয়া কমব্যাট যান, যেটাতে মনুষ্যবিহীন গান টারেট সংযুক্ত আছে। এটাও ২০২৩ সালে হস্তান্তর করা হবে।
তুরস্কের প্রথম নিজস্বভাবে তৈরি ট্যাঙ্ক হলো আলটে। এই ট্যাঙ্কের কিছু সাব-সিস্টেমের কাজ স্থানীয়ভাবে করার চেষ্টা চলছে। এগুলো শেষ হলেই ট্যাঙ্কের উৎপাদন শেষ হবে।
এসএসবি'র প্রধান ইসমাইল দেমির বলেছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধাপের কাজ শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুওলোতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প যে অসামান্য অর্জন করেছে, সেটার দেশের মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। একই সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা পণ্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলেরও আগ্রহ বেড়েছে।
দেমির বলেন, আমাদের যে সব সিস্টেম পরীক্ষামূলক পর্যায়ে সাফল্য দেখিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী এখন সেগুলো সাফল্যের সাথে ব্যবহার করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের যে সক্ষমতা অর্জন হয়েছে, সেটাকে এখন পরিস্থিতি বদলে দেয়ার উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, তুরস্ক এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ করবে। শিগগিরই প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই আমরা নতুন উন্নয়ন দেখতে পাবো।