শুরু হয়ে গেছে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুযুদ্ধ

ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনের সৈন্যরা - আনাদুলু

  • মোতালেব জামালী
  • ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:৪৫

ওয়াশিংটন পোষ্টের সাংবাদিক ডেভিড ইগনাশিয়াসকে সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্লিঙ্কেন বলেছেন, রাশিয়াকে প্রতিরোধের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। এই লক্ষ্য অর্জনের প্রতি দিচ্ছেন যথেষ্ট গুরুত্ব । ডেভিড ইগনাশিয়াস তার সাংবাদিকতা জীবনের অধিকাংশ সময় কাজ করেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন এবং গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাথে। তার সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি মনে করেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের এ ধরণের কথার একটাই অর্থ হতে পারে। আর তা হচ্ছে- রাশিয়া যাতে বিশ্রাম নেয়ার, পুনর্গঠিত হওয়ার এবং আবারও কোন দেশ আক্রমন করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে চায় বাইডেন প্রশাসন।

২০২২ সালের ২৬ মার্চ রাশিয়ার পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে যে পরিকল্পনা থেকে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল তার ‘প্রথম ধাপ’ অর্জিত হয়েছে। এখন তাদের নজর পূর্ব ইউরোপের বাকি অংশে। রুশ সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের প্রধান ডেপুটি চিফ কর্নেল জেনারেল সের্গেই রুদস্কয় সংবাদ সম্মেলনে এমন ঘোষণা দেন। রাশিয়ার এমন ঘোষণার পর পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো জানিয়েছে, তারা পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক উপস্থিতি দ্বিগুণ করছে। রাশিয়ার সামরিক হুমকি মোকাবিলায় বাল্টিক দেশগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে ন্যাটো।


এটা এখন স্পষ্ট , এই অঞ্চলে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকাতে যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে সেটি এবার পুরো পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে রাশিয়া। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, পুর্ব ইউরোপে আক্রমনের প্রস্তুতি হিসেবে ইউক্রেনে মূলত অস্ত্র শাণিয়ে নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।

ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, পূর্ব ইউরোপে জোটের সামরিক উপস্থিতি জোরদারের প্রথম ধাপে বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও শ্লোভাকিয়ায় ন্যাটোর সশস্ত্র ইউনিট মোতায়েন করা হবে। এরপর বাল্টিক দেশগুলো এবং পোল্যান্ডে ন্যটোর বাহিনীর পরিমাণ দ্বিগুণ করা হবে। এর মানে হলো, বাল্টিক থেকে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত ন্যাটোর আটটি যুদ্ধ ইউনিট থাকবে। যত দিন প্রয়োজন হবে ততদিন এই বাহিনী সেখানে থাকবে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কনডোলিজ্জা রাইস ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রবার্ট গেটস মনে কনে, ইউক্রেন আক্রমন করেই রাশিয়া থেমে থাকবে না। পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশও পুতিনের টার্গেটে আছে।


ইয়েল বিশ্ববিদালয়ের ইতিহাসবিদ টিমোথি স্নাইডার মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হলেই কেবল দেশটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। রাশিয়ার পরাজয়ই কেবল কর্তৃত্ববাদী শাসনের বর্তমান প্রবণতাকে পরিবর্তন করতে পারে। অন্য কোনভাবে এই ধারার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হবে না। কেননা ‘পুতিনবাদ’ বর্তমান বিশ্বে ‘একটি শক্তি ও মডেল’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কাজেই সাধারণ প্রক্রিয়ায় রাশিয়াতে আইনের শাসন কায়েম হবে সেরকম কোন সম্ভাবনা নেই।


রাশিয়ায় পুতিনবাদের এই ধারাকে সামনে রেখেই প্রতিরক্ষা গবেষক, টিমোথি স্নাইডার বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। মুক্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই সুযোগকে যে ভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে। কেননা নিজেদের উদ্যোগে আমরা এগুলো অর্জন করতে পারিনি। ইউক্রেন আমাদের সামনে এগুলো অর্জন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয় ‘একটি সাম্রাজ্যবাদী যুগের অবসান ঘটাবে’।


টিমোথি স্নাইডার মনে করেন, রাশিয়ার পরাজয় একই সাথে চীনের জন্যও হবে একটা সতর্কবার্তা। চীন এটা বুঝতে সক্ষম হবে যে, তাইওয়ানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক আগ্রাসন হবে ব্যয়বহুল এবং শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হবে। স্নাইডারের মতে, গনতন্ত্রকামী বিশ্বের সামনে শত বছরের মধ্যে যে বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে তা কোন ভাবেই নষ্ট করা যাবে না। রাশিয়াকে পরাজিত ও চীনকে থামিয়ে দেয়ার এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর চীন ও রাশিয়া পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এক যোগে কাজ করার কথা জানিয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকের পর চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। চীনের আনহুই প্রদেশে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠকের পর চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, নতুন যুগে চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে দুই দেশ সঙ্গে কাজ করবে।

এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে এতদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র তার আঞ্চলিক মিত্র দেশ জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে জোট গঠন করেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো প্রথম বারের মতো চীনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।


২০২২ সালের ২৯ জুন প্রকাশিত সংস্থাটির আগামী দশকের কৌশলগত ধারণাপত্রে চীনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। স্পেনের মাদ্রিদে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে এই কৌশলগত ধারণাপত্র অনুমোদন দেন। যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম চীনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে গ্রহন করল ন্যাটো। সংস্থাটি জানিয়েছে, চীনের উচ্চাকাংখা এবং দমনমূলক নীতি পশ্চিমা স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং মূল্যবোধের জন্য গুরুতর হুমকি। ন্যাটোর এই ধারণাপত্রে রাশিয়াকে সংস্থার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।


ন্যাটোর কৌশলগত ধারণা পত্রে বলা হয়েছে, রাশিয়া ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ‘সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সরাসরি হুমকি’। ওই নথিতে আরও বলা হয়, বেইজিংয়ের সামরিক উচ্চাকাংখা, তাইওয়ানের প্রতি এর সংঘাতমূলক মনোভাব এবং রাশিয়ার সঙ্গে এর মৈত্রী ন্যাটোর সামনে ‘কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে হাজির হয়েছে।


ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘চীন ক্রমাগত পারমাণবিক অস্ত্র সহ সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। এর প্রতিবেশী দেশগুলোকে হয়রানি করছে, তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে, নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। রাশিয়ার পক্ষ হয়ে মিথ্যা এবং ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে।’ এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘চীন আমাদের শৃঙ্খলাভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত অবমাননা করে চলেছে।

রাশিয়া তার সামরিক শক্তি দেখাতে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার ভূখন্ড দখল করে। এরপর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নেয়ার পাশাপাশি পূর্ব ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সামরিক সহায়তা দিতে শুরু করে। সর্বশেষ পুরো ইউক্রেন দখল করতে গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক আগ্রাসন চালান প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি এখন পুর্ব ইউরোপের দিকে নজর দিচ্ছেন।

পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার কর্মকান্ডকে সামরিক সন্ত্রাস হিসেবেই বিবেচনা করছে। আর এজন্যই তারা রাশিয়াকে ঠেকাতে ইউক্রেনের পক্ষে মাঠে নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্য সদস্য দেশগুলোর সামরিক ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। ন্যাটো জোট রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। এমনকি ইউরোপে পরমানু অস্ত্র মোতায়েনের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়াও ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই পরমানু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়ে আসছে।


পরমানু অস্ত্র মোতায়েন ও ব্যবহার নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে চুক্তি আছে তা নিয়ে আলোচনায় বসার কথা কোন পক্ষই মুখে আনছে না। বরং দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। চলছে জোরালো সামরিক প্রস্তুতিও। পরিস্থিতি যে দিন দিন পরমানু যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা অবজ্ঞা করছেন ন্যাটো জোট ও রাশিয়ার নীতি নির্ধারকরা।


জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি’র সিনিয়র ফেলো মেলভিন এ গুডম্যান এর মতে, রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি কোন হুমকি সৃষ্টি করেনি। কিন্তু দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তা ওয়াশিংটনের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।


রাশিয়া ও চীন দুই দেশই তাদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভুরাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট কোনভাবেই সেটা ঘটতে দেবে না। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে সহসা কোন সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা না থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল একটি ¯œায়ু যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।