নতুন এক ধরনের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার রাশিয়ার ড্রোনগুলোর গাইডেন্স সিস্টেমকে বেশ চতুরতার সাথে প্রতারিত করছে। যার ফলে অনেকগুলো রাশিয়ার ড্রোনও সাম্প্রতিক সময়ে ভূপাতিত করা সম্ভব হয়েছে। দৃশ্যটি চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের। ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই এ যুদ্ধে সমর কৌশল হিসেবে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামিং করতে ব্যস্ত। কারণ, দুই পক্ষই একে অপরকে ড্রোন ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে চায়।
সাধারণত প্রতিপক্ষের ড্রোনকে পর্যুদস্ত করে দেওয়ার জন্য দুই ধরনের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ব্যবহার করা হয়। একটি হলো- রেডিও নয়েজ তৈরি করা। কন্ট্রোল সিগন্যালে এই নয়েজ তৈরি করা হয়। ফলে ড্রোনকে চালিয়ে নেওয়া এক পর্যায়ে রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় উপায় হলো- জিপিএস ফ্রিকোয়েন্সিতে ঝামেলা পাকানো। এটি করতে পারলে ড্রোনের স্যাটেলাইট নেভিগেশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যায়। এবারের ইউক্রেন যুদ্ধে তৃতীয় আরেকটি কৌশলের বেশ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, সামরিক ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে নেভিগেশন স্পুফিং।
রাশিয়া সমর্থিত মিলিশিয়া একটি সংস্থা কোঅরডিনেশন সেন্টার ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু নোভোরোশিয়া নামক একটি প্লাটফর্ম পরিচালনা করে। যেখান থেকে নিয়মিতভাবে সামরিক বিষয়াদির ওপর কলাম প্রকাশিত হয়। যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ড্রোন ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
এতে দাবি করা হয়, শুধুমাত্র ৩ দিনে শুধুমাত্র ক্রাসনোহোরিভকার দক্ষিণাঞ্চলেই ৫ম ব্রিগেডের স্কাউটটি ৫টি কোয়াডকপ্টার হারিয়েছে। এর মধ্যে ৩টি হলো ডিজেআই মাভিক থ্রি আর দুটো হলো অটেল ইভো টু ডুয়াল সংস্করণের কোয়াডকপ্টার। এই আকাশযানগুলো অনেকটা একই পরিস্থিতির মুখে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রথমে এগুলোর স্যাটেলাইট নেভিগেশন হারিয়ে গিয়েছিল। কিছু সময় পর অবশ্য স্যাটেলাইট ফিরে এসেছিল কিন্তু তারপরই হুট করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কোয়াডকপ্টারগুলো নিচে পড়তে থাকে।
অপারেটররা অবশ্য বুঝতে পেরেছিল যে ড্রোনগুলোর সাথে ঠিক কী ঘটেছে। মূলত ড্রোনগুলোকে বোকা বানানো হয়েছিল। প্রথমে ড্রোন অপারেটররা ধারনা করেছিল , তারা বোধ হয় নো-ফ্লাই জোনে রয়েছে। তাই তারা অপারেট করা থামিয়ে দিয়েছিল। ডিজেআই এর মতো ড্রোনগুলো যারা বানিয়েছে তারা জিওফেনসিং নামক নতুন একটি কৌশল প্রনয়ন করেছে যাতে নিশ্চিত করা গেছে, তাদের ড্রোনগুলো বিমানবন্দরসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ এলাকার ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করবেনা। এর অংশ হিসেবে প্রতিটি নো ফ্লাই জোনের চারপাশে একটি ভার্চুয়াল ফেন্সও গড়ে তোলা হয় যার ফলে ড্রোনগুলো এর ভেতর গিয়ে উড়তে পারে না।
ইউক্রেনের তৈরি ইলেকট্রনিক ওযারফেয়ার নিয়মিতভাবেই রাশিয়ার ড্রোনগুলোকে বোকা বানাতে পেরেছে। ফলে অনেক ড্রোন ভূপাতিত করাও সম্ভব হয়েছে। জিপিএস স্পুফিং এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত একটি কৌশল। ২০১৩ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টড হামফ্রে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে বড়ো আকৃতির একটি ইয়টকেও মিথ্যা নেভিগেশন ডাটা দিয়ে ভার্চুয়ালী হাইজ্যাক করে ফেলা যায়। এভাবে মিথ্যা ডাটা দেয়ার মাধ্যমে ক্রূরা কিছু টের পাওয়ার আগেই ইয়টটিকে নিজেদের ইচ্ছামতো চালিয়ে নেয়া যায়।
রাশিয়াও তার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এ ধরনের স্পুফিং কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। মস্কোতে থাকা ড্রাইভাররাও অনেক সময় মনে করেন যে, তাদের সাতনাভগুলো হাজার হাজার মাইল দূরে রয়েছে। আর ঐ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পুতিনের চারপাশে একটি জিপিএস স্পুফিং বাবল তৈরি করা হয়। মূলত ড্রোন আক্রমন থেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যই এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়।
অন্যদিকে, ব্ল্যাক সিতে যে জাহাজগুলো মোতায়েন রয়েছে সেগুলোও স্পুফিং করে। এমনও হয় যে, এদের নেভিগেশনে দেখানো হয় যে এগুলো ব্ল্যাক সিতে নয়, বরং গেলেন্দজিক এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রয়েছে। এ ধরনের চতুরতা করা সম্ভব হয় রাশিয়ার ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের কারণে। আরো বেশ কিছু নেভিগেশন সিস্টেমও পৃথিবীতে চালু আছে। এর মধ্যে আছে ইউরোপের গ্যালিলিও, রাশিয়ার গ্লোনাস এবং চীনের বাইডো। তবে স্পুফিং কথাটি জিপিএস নেভিগেশনের সাথেই বেশি ব্যবহৃত হয়।
রেসিলিয়েন্ট নেভিগেশন এবং টাইমিং ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ডানা গোয়ার্ড দাবি করেছেন, ড্রোন বিধ্বস্ত হওয়ার যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়েছে তাতে সাতনাভকে বোকা বানানোর বিষয়টি বেশি হাইলাইট হয়েছে। গোয়ার্ড আরো জানান, রাশিয়ানরা সম্ভবত ইউরোপের বিশেষ মনিটরিং মিশনে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে ইউক্রেনে জিপিএস স্পুফিং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার ইউক্রেন যে স্পুফিং প্রযুক্তিটি ব্যবহার করেছে তাও হয়তো রাশিয়া থেকেই পেয়েছে।
রাশিয়ানরা ২০১৬ সাল থেকেই নিয়মিত স্পুফিং করে আসছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনসহ আরো কয়েকটি দেশে এ প্রযুক্তি রফতানি করার সম্ভাবনা একদম উড়িয়েও দেয়া যায় না। রাশিয়ার ড্রোন অপারেটররা জানিয়েছেন, একটি ড্রোন হুট করে ম্যানুয়াল পাইলটিং মুডে সুইচ করেও স্পুফিং থেকে বেঁচে যেতে পারে। তবে, এভাবে মুড সুইচ করতে হলেও তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে করে ফেলতে হবে।
কারণ ড্রোনটি স্পুফিং এর আওতায় পড়ে গেলে এত দ্রুত গতিতে নিচে নামতে থাকে যে তখন চাইলেও এর মুড সুইচ করা আর সম্ভব হয় না।
সামরিক জার্নালে প্রকাশিত বিশ্লেষণে দাবি করা হয়, এমন পরিস্থিতি বারবার তৈরি হওয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়েই ৫ম ব্রিগেডের স্কাউটটি এখন অধিকাংশ সময়ে ম্যানুয়াল মুডেই ড্রোন পরিচালনা করছে।
স্পুফিং প্রযুক্তিটি খুব দ্রুতগতিতে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই বিশ্বের অনেক এলাকাতেই এখন ড্রোন অপারেটরেরা ড্রোন চালাতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গেছেন।
ক্রাসনোগোরভকা এলাকায় স্পুফিংসহ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের কোয়াডকপ্টার ব্যবহারকারীরা বেশ বড়ো ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। এমনকী ম্যানুয়াল মুডে নেয়ার পরও অনেক ড্রোনই ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারছে না।
স্পুফিং প্রযুক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন একটি টুইস্ট যোগ করেছে যা সব ধরনের ড্রোনের জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রোন-বিরোধী ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি উভয়পক্ষের কাছেই বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এই প্রযুক্তি কোয়াডকপ্টারকে ধীরে ধীরে অকার্যকরও করে তুলতে পারে। ইউক্রেনের একজন ড্রোন বিশেষজ্ঞ দ্য গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাতকারে দাবি করছেন, খুব সম্ভবত তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ডিজেআইগুলো আর ব্যবহার উপযোগী থাকবে না।
ড্রোন ধ্বংসের এই সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হয়তো আরো উন্নত ধরনের ড্রোন তৈরি করতে হবে যেখানে জ্যাম প্রতিরোধক রিসিভার থাকবে। যা রেডিও নয়েজগুলো ফিল্টার করতে পারবে। পাশাপাশি, এগুলো সামরিক বাহিনীর ব্যবহার্য এম-কোড জিপিএস সিগনাল ব্যবহার করেও উড্ডয়ন অব্যহত রাখতে পারবে।
ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের কামিকেইজ ড্রোনগুলো রাশিয়ার জিপিএস জ্যামিংকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। ইউক্রেনের ভালো ইকোসিস্টেমও রয়েছে যার কারণে যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য উন্নতমানের ড্রোন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া ড্রোন কেনার জন্য নানামুখী চেষ্টা করলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতির কারণে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাশিয়া এখনও পশ্চিমা ইলেকট্রনিকসের ওপর নির্ভর করে আছে। এটিও রাশিয়ার জন্য আরেকটি দুর্বলতা ।
যুদ্ধকৌশল নিয়ে আসলে এখন বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করার সময় এসেছে। জিপিএস ওয়ারফেয়ার বিশেষ করে স্পুফিং এরই মধ্যে মূলধারার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই এ প্রযুক্তির কথা জেনে গেছে এবং এ প্রযুক্তি আগামীতে শুধুমাত্র সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে- এমনটাও বলা যায় না। বর্তমানে বেসামরিক অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাও স্যাটেলাইট নেভিগেশনের ওপর ভরসা রাখছে। তাই ব্যাকআপ সিস্টেমগুলো নিয়েও চিন্তা করা প্রয়োজন। কারণ যদি জিপিএস সিস্টেম কাজ না করে বা স্পুফিং এর কারণে যদি জিপিএস হাইজ্যাক হয়ে যায়, তাহলে সার্বিক যোগাযোগ কার্যক্রম এবং যানবাহন পরিচালনাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।