যুদ্ধের চিরায়ত একটি সত্য হলো- এতে নেতৃত্বদানকারী জেনারেলদের মধ্যে এক সময় মতবিরোধ শুরু হয়ে যায়। রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরাও এক পর্যায়ে জেনারেলদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নিজেদের মতো করেই যুদ্ধ পরিচালনা করতে শুরু করেন। যারা ইতিহাস জানেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, জর্জ ওয়াশিংটনও মনমাউথের যুদ্ধে জেনারেল চার্লস লিয়ের ওপর আর ভরসা রাখতে পারেননি। এমনকি লি যুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে কোর্ট মার্শালেরও মুখোমুখি হতে হয়। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের সাথেও তার জেনারেলদের একই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। যুদ্ধরত একাধিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধ এখন ওপেন সিক্রেট। জেনারেলদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যে শুধু রাশিয়ার পক্ষে হচ্ছে তাও নয়, ইউক্রেনের জেনারেলদের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ।
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সাথেও তার জেনারেলদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কারণ, এই জেনারেলরা যুদ্ধে জয়ী হতে পারছিলেন না। এমনকি জয় পেলেও প্রত্যাশিত মাত্রায় শত্রুদের তাড়াও করতে পারেনি। এক্ষেত্রে জেনারেল চার্লস লিয়ের মতো পরিণতি হয়েছিল রবার্ট ইয়ের। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জেনারেলরাও একই ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন।
আইজেনহাওয়ার প্রায়ই তার ব্রিটিশ সহকর্মীদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। বিশেষ করে ফিল্ড মার্শাল স্যার বার্নার্ড মন্টগোমারির সাথে তার বিরোধ ছিল খুবই দৃশ্যমান। বাধ্য হয়ে তাকে এক সময়ে গিয়ে পিছুও হটতে হয়। রাশিয়ানরাও একই সংকটে পড়েছিল স্ট্যালিনের সময়ে। স্ট্যালিনের সাথে তার জেনারেলদের বিরোধ এতটাই প্রকট ছিল যে, তার সময়ের জনপ্রিয় বেশ কিছু জেনারেলকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কয়েকজনকে গুলি করে হত্যাও করা হয়েছিল। এমনকি খ্যাতনামা সেনা কর্মকর্তা মার্শাল জিওর্জি ঝুকভকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান গুলাগেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেভিয়েত যুদ্ধে হেরে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ভাগ্যক্রমে ঝুকভ বেঁচে যান।
বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় রাশিয়ার নীতি নির্ধারকদের সাথেও জেনারেলদের মতপার্থক্য হওয়া অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত কোনো বিষয় নয়। এরইমধ্যে মতপার্থক্যের বেশ কিছু বিষয় দৃশ্যমান হয়েছে। বেশ কয়েকজন সামরিক নেতৃত্বকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই নতুন করে অন্য কোথাও পোস্টিং পেয়েছেন। বাকিদেরকে এখনও কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে প্রকট মতবিরোধ চলছে রাশিয়ান জেনারেল স্টাফ ও দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই সোইগু এবং পিএমসি ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মধ্যে। এরকম বিবাদ চলমান থাকলে ভালো সম্ভাবনা থাকার পরও যুদ্ধের ফলাফল বেহাত হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি বাখমুতে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনাও ঘটে গেছে। যার মূল কারণই ছিল প্রিগোজিনের সাথে অন্যান্য জেনারেলদের বিরোধ।
প্রিগোজিনের সেনারা বাখমুতের ভেতর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড বেশি ধীরগতির হওয়ার কারণে ইউক্রেনিয়ানরা সুযোগ নিচ্ছে। তারা এই সুযোগে ক্লান্ত সেনাদের বদল করে নতুন সেনা পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছে। নিয়মিতভাবে ময়দানে মোতায়েন থাকা সেনাদের রশদও সরবরাহ করতে পারছে।
রাশিয়ান সেনাদের কৌশল অবশ্য এক্ষেত্রে ওয়াগনার বাহিনী থেকে ছিল ভিন্ন। রাশিয়ান সেনারা বাখমুতের মূল শহরগুলোতে ইউক্রেনের সরবরাহ লাইন বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। প্রথমে বড় রাস্তা এরপর অলিগলিগুলো সিল করে। চাসিভ ইয়ারসহ ইউক্রেনের সরবরাহ পাঠানোর কেন্দ্রগুলোতে বোমা হামলা করে ইউক্রেনকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করে। চাসিভ ইয়ার ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাখমুতের প্রয়োজনীয় সব রশদ এখান থেকেই সরবরাহ করা হতো।
এত কিছুর পরও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর উচিত ছিল শহর ও রাস্তাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ সেনাদের মোতায়েন করা। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু অপ্রশিক্ষিত এবং দুর্বলভাবে সজ্জিত সেনা ও ভলান্টিয়ারদের। ফলে, ইউক্রেনের সেনারা তাদেরকে সহজেই পরাজিত করে হারানো এলাকাগুলো পুনরায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দেখা যায়, ইউক্রেনের সেনারা ক্র্যাক ট্রুপ বিশেষ করে আজভ ব্রিগেডের বেশ কিছু উপকরণ ও ট্যাংক ব্যবহার করে। অন্যদিকে, রাশিয়ান সেনাদের কাছে ছিল ছোট ছোট অস্ত্র। তাদের কোনো প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল না। এমনকি কোনো অ্যান্টি ট্যাঙ্ক অস্ত্রও ছিল না। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
বিরাট এই ভুলের কারণে প্রিগোজিন নিজে যেমন সমালোচনা করেছেন, আবার তিনি নিজেও যথেষ্ট পরিমাণে তীর্যক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এমনকি রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পুতিনকেও ওয়াগনারদের গডফাদার হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকেও তুলোধুনো করা হয়েছে। তবে এই সমালোচনার মাঝেও যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো- ওয়াগনার ও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরোধ। এ দুই বাহিনীর মাঝে কোনো সমন্বয় নেই, তাও অনেকটা স্পষ্ট।
মতবিরোধের জায়গা থেকেই রাশিয়ার সেনারা বাখমুতের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো পরিচালনার জন্য সবচেয়ে দুর্বল ও অরক্ষিত বিগ্রেডকে দায়িত্ব দিয়েছিল। এর বিপরীতে আরেকটি যুক্তিও কেউ কেউ দিয়েছেন। তাদের মতে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী আসলে বাখমুতকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেই করেনি। তাই তারা বাখমুতে ফোকাস না করে বরং ইউক্রেনের আসন্ন অভিযান মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেই অধিক শক্তি বিনিয়োগ করছে। এই যুক্তি একদম ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। তবে, শুনতে যতই যৌক্তিক মনে হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, রাশিয়ার সেনাবাহিনী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ওয়াগনার ব্রিগেডকে দুর্বল ও অরক্ষিত রেখেছে। কার্যত এই সেনাদেরকে এখন বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে।
রাশিয়ান বিশ্লেষকদের মতে, যারা একটু সহনশীল ও নমনীয় মানসিকতা লালন করেন, তারা অবশ্য এই সমন্বয়হীনতা ও ভুলগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একজন রুশ বিশ্লেষকের মতে, যেগুলোকে অনেকে সমন্বয়হীনতা বলছেন, এগুলো আসলে কোনো না কোনোভাবে ইউক্রেনীয়দের ফাঁদে ফেলার জন্য ‘ক্রম্পল জোন’ স্থাপনের পরিকল্পনারই একটি অংশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেনের সেনারা এই ফাঁদের মধ্যে আটকে পড়েনি।
প্রেসিডেন্ট পুতিন পড়েছেন আরো এক সংকটে। তিনি জানেন তার বাহিনীতে মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তিনি এও জানেন যে, এই দ্বন্দ্বকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যেকোনো সময় বাহিনীকে ময়দান থেকে গুটিয়েও নেওয়া যায়। তবে, পুতিন একইসঙ্গে বিশ্বস্ত একজন নেতাও বটে। তিনি তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সোইগুর প্রতি বিশ্বস্ত। যদিও সোইগুর সমর অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষমতার ঘাটতি আছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সোইগু কৌশলগত চিন্তাবিদও নন। আবার একইসঙ্গে পুতিন তার ভালো বন্ধু প্রিগোজিনের প্রতিও বিশ্বস্ত। এর আগে সিরিয়া ও আফ্রিকাতেও পুতিন ওয়াগনার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সুবিধা পেয়েছিলেন। এবারও ইউক্রেনে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই তিনি ওয়াগনার সেনাদের মোতায়েন করেছিলেন। প্রিগোজিনও বিশ্বস্ততার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
রুশ জেনারেলদের চলমান মতপার্থক্য নিরসনে পুতিন যদি সক্রিয় হন ও রাশিয়ার জেনারেল স্টাফের কথা মতো যদি প্রিগোজিনকে বরখাস্ত করেন, তাহলে বিষয়টি এখানেই শেষ হবে না। বরং পুতিন হয়তো সেনাবাহিনীর কাছে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণই হারাবেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন তখন সেনাবাহিনীর পুতুলে পরিণত হবেন। এমনকি সামরিক কোনো অভ্যুত্থানে তার পতনও হতে পারে। তেমন পরিস্থিতি হলে কেজিবিতে থাকা তার সাবেক সহকর্মীরাও তাকে বাঁচাতে আসবে না। বরং তারা চুপ করে সরে যাবে।
রাশিয়ার সিক্রেট সার্ভিসগুলো আগাগোড়াই সুবিধাবাদি এবং সেনাবাহিনী চাইলে তারাও পুতিনের ওপর থেকে সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নিতে দেরি করবে না। এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সোইগু এবং জেনারেল স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি গ্যারিসমভ পুতিনের পাশে আছেন।
মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতের কথা কেউই জানে না। যদি প্রেসিডেন্ট পুতিন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনকে বরখাস্ত না করেন, তাহলে তিনি হয়তো গেরাসিমভ বা সোইগুকেও অপসারণ করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তাকে ভিন্ন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো প্রিগোজিন নিজে থেকে সরে যাবেন কিংবা যুদ্ধে আহত হয়ে বিরতি নেবেন। আবার রাশিয়ার সেনাবাহিনী যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, সেক্ষেত্রেও হয়তো পুতিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। বিদ্যমান সংকট থেকেও মুক্তি পাবেন। তবে, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।