শীতল যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর অস্ত্র-রসদ যোগাতে ইউরোপের বহু ট্রিলিয়ন ডলার চলে গেছে। এরপর শীতল যুদ্ধের পর্দা নামার পর ৩০ বছর চলে গেছে। এই ত্রিশ বছরে সেই সব ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে, আবাসন আর স্কুলের পেছনে। নিরাপত্তা ইস্যুকে পেছনে ফেলে বাণিজ্য আর প্রবৃদ্ধি যখন চালকের আসন নিয়েছিল, তখন এক নতুন যুগের শুরু হয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ সেই যুগের অগ্রযাত্রাকে হঠাৎ করেই থমকে দিয়েছে। এখন আবার বেসামরিক বিভিন্ন খাত থেকে বাজেট কাটছাট করে সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাজেট সরানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে ইউরোপের অধিকাংশ দেশই এখন অন্ধকারে। কিন্তু সামনে তারা কোনো বিকল্প দেখতে পাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, ‘শান্তিতে দিন কাটানোর সময় শেষ হয়ে গেছে’। সামরিক বাজেট কাটছাট করে এতদিন যে সব অর্থ বাঁচানো হয়েছে, সেগুলো এখন আবার সেই প্রতিরক্ষা খাতেই ব্যয় করতে হবে।
রাশিয়ার মোকাবিলায় ইউরোপের নেতাদেরকে যেভাবে তাদের সামরিক বাজেট বাড়াতে হচ্ছে, সেটা ইউরোপের মানুষের জীবনযাপনের ওপর কঠিন বোঝা হয়ে উঠছে। ইউরোপ কি এখন হাউইটজারের পিছনে অর্থ ব্যয় করবে, না কি হাসপাতালের পিছনে? তারা ট্যাঙ্ক কিনবে নাকি শিক্ষকদের পেছনে খরচ করবে- এ প্রশ্ন উঠেছে। রকেট কিনবে নাকি রাস্তাঘাট বানাবে। এই অর্থের যোগানই বা কীভাবে হবে, তাও এক প্রশ্ন।
হঠাৎ করে নিরাপত্তা চাহিদা বেড়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলেও এই নিরাপত্তা চাহিদা থেকে যাবে। এমন সময় এই চাহিদা বাড়ল যখন দ্রুত বয়স্ক হয়ে ওঠা জনগোষ্ঠির বিভিন্ন চাহিদা মেটানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্যও অর্থ দরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হতে চায়। এ জন্য আগামী ২৭ বছর ধরে প্রতি বছর ১৭৫ থেকে ২৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কেনেথ রোজফ বলেছেন, ইউরোপের উপর ব্যয়ের চাপ পড়বে বিশাল। সবুজ বিপ্লবের যে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, সেটা বাদ দিয়েই এই ব্যয়ের চাপ বাড়বে। এই সব বড় বড় চাহিদার সামনে পুরো ইউরোপের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।
বার্লিন দেয়ালের পতনের পর সামাজিক ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় দ্বিগুণ করতে হয়েছে ডেনমার্ককে। অর্গানাইজেশান ফর ইকোনমিক কোঅপারেশান অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ব্রিটেনকে তাদের ব্যয় বাড়াতে হয়েছে ৯০ শতাংশ। একই সময়কালে, সংস্কৃতি ও বিনোদন কর্মসূচিতে অর্থায়ন দ্বিগুনের বেশি বাড়িয়েছে পোল্যান্ড। জার্মানি বিনিয়োগ বাড়িয়েছে অর্থনীতিতে। চেক প্রজাতন্ত্র তাদের শিক্ষা বাজেট বাড়িয়েছে।
ন্যাটোর যেসব ইউরোপীয় সদস্য রয়েছে, তাদের সামরিক ব্যয় ২০১৪ সালে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছে। এই সময়ে তাদের যুদ্ধট্যাঙ্ক, জঙ্গি বিমান, এবং সাবমেরিনের চাহিদা কমে যায়। রাশিয়া যখন ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করল, তখন সামরিক বরাদ্দ আবার বাড়তে শুরু করল। তবে, ন্যাটোর বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে কম বরাদ্দ নিয়েই অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ খুশি। ন্যাটোর লক্ষ্য হলো সদস্য দেশগুলোকে জিডিপির দুই শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হবে।
রোমানিয়ার ফিসক্যাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী ড্যানিয়েল দাইয়ানু বলেছেন, বেসামরিক খাত নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় ইউরোপের জন্য শেষ হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ধারণা করা হয়েছিল যে, ২০২৬ সাল নাগাদ ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যগুলোর সামরিক ব্যয় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে যাবে। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে এই ব্যয়ের পরিমাণ ১৪ শতাংশ বাড়বে। এখন যুদ্ধ শুরুর পর ধারণা করা হচ্ছে, সামরিক ব্যয় ৫৩ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যনমশ বাড়বে। এর অর্থ হলো, ব্রিজ বা হাইওয়ে মেরামত, শিশু সেবা, ক্যান্সার গবেষণা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য সরকারি খাতে যে সব অর্থ ব্যয় হতো, তার একটা বড় অংশ এখন সামরিক খাতে সরিয়ে নেওয়া হবে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট সম্প্রতি জানিয়েছে, ইউরোপে গত বছরে সামরিক ব্যয় তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু এটা মাত্র শুরু। আগামীতে এটা আরও বহু গুণে বাড়বে।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা তাদের অস্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা আপগ্রেড ও এর সম্প্রসারণ করবে। উৎপাদনকারীদেরকে তারা এ জন্য ৫০০ মিলিয়ন ইউরো দেবে। মূলত ইউরোপের বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর জন্য দরকারি অস্ত্রের উৎপাদন বাড়ানোর জন্যই এটা করা হচ্ছে। তবে, ইউক্রেনকে এ বছর এক মিলিয়ন রাউন্ড বিভিন্ন ধরণের গুলি ও শেল দিতে চেয়েছে ইউরোপ। উৎপাদন বাড়লে ইউরোপিয় ইউনিয়ন সেই প্রতিশ্রুতিও মেটাতে পারবে। এ রকম আশাবাদ জানিয়েছেন ইউরোপিয় ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার থিয়েরি ব্রেটোন।
পোল্যান্ড তাদের জিডিপির ৪ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আগামী বছর ১১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছে। আগের বরাদ্দের চেয়ে এটা ২০ শতাংশ বেশি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সামরিক ব্যয় এক তৃতীয়াংশের বেশি বাড়াবেন। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের পারমানবিক সক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক বাহিনীকে পুরো বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।
কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, সামরিক খাতের বরাদ্দ এর আগে এতটা কাটছাট করা হয়েছে যে, মৌলিক প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টিও সেখানে উপেক্ষিত হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, সামরিক ব্যয় বাড়ানোর পক্ষে জনমত রয়েছে। এদিকে, সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়ার জন্য ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দেয়ার ব্যাপারেও তোড়জোর শুরু করেছে।
ইউরোপের বেশির ভাগ জায়গায়, যে সব বাজেট এদিক ওদিক করতে হবে, যে কর আরোপ করার দরকার পড়বে, সেগুলো এখনও জনসাধারণের জীবন যাপনের উপর প্রভাব ফেলতে শুরুই করেনি। এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপর যে চাপ বেড়েছে, সেটা হয়েছে মূলত মূল্যবৃদ্ধির কারণে। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মূলত জনগণকে এই চাপ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
আগামীতে ইউরোপকে হয়তো তাদের খেলার কৌশল বদলাতে হবে। বাজেট পরিকল্পনা প্রকাশের পর এক বক্তৃতায় ম্যাক্রো বলেছেন, ফ্রান্স এখন একটা যুদ্ধ অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। এই অবস্থায় আমাদেরকে দীর্ঘ সময় থাকতে হবে।
বড় প্রশ্ন হলো, জাতীয় অগ্রাধিকারে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোত্থেকে অর্থ সরবরাহ করা হবে। উদাহরণ হিসেবে ফ্রান্সের কথা ধরা যাক। শতকরা হিসেবে ইউরোপে সরকারী খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ফ্রান্স, যেটার পরিমাণ হলো ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ইউরো। এর প্রায় অর্ধেকটাই ব্যয় করা হয় বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এর মধ্যে বেকার সুবিধা ও পেনসনের মতো বিষয়ও রয়েছে। মহামারীর সময়টাতে ফ্রান্সের ঋণও বেড়েছে। তারপরও ম্যাক্রো কর বাড়াতে চাচ্ছেন না। তার আশঙ্কা, কর আরও বাড়ালে বিনিয়োগকারীরা দূরে সরে যেতে পারে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বাজেট অগ্রাধিকার নিয়ে বিতর্ক চলছে। যদিও সামরিক খাতের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি সবাই হয়তো স্পষ্ট করে বলছে না। ব্রিটেনে মার্চ মাসের যে দিন সরকার সামরিক খাতের ব্যয় ৬ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার বাড়ানোর ঘোষণা দিলো। ঠিক সেই দিনই বেতন ও কাজের পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্ট্রাইক শুরু করে শিক্ষক, ডাক্তার, আর পরিবহন কর্মীরা। সরকারী কর্মচারিরা এ রকম স্ট্রাইক অনেকবার করেছে। তাদের অভিযোগ হলো, তাদের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ নেই। মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কোঠায় চলে গেছে। আর মহামারীর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য সেবা, পরিবহন ও শিক্ষা খাতগুলো পঙ্গু হয়ে পড়েছে। অথচ দুই বছর সময়ের জন্য ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৪.১ বিলিয়ন ডলার, যেটা সামরিক বরাদ্দের চেয়ে যথেষ্ট কম।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী অর্থনীতি হলো জার্মানির। ফ্রান্স বা ব্রিটেনের তুলনায় জার্মানি সব সময়ই সামরিক খাতে বরাদ্দ দিয়েছে অনেক কম। কিন্তু গত বছর সামরিক খাতে বিশেষ ১১২ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ। এই মুহূর্তটাকে তিনি 'ঐতিহাসিক বাঁক বদলের মুহূর্ত' আখ্যা দেন। কিন্তু এই যে বিশাল বরাদ্দ, এখানে গোলাবারুদ উৎপাদনের জন্য কোন বরাদ্দ নেই। আবার জার্মানির এই তহবিল যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন ন্যাটোর অন্যান্য অংশীদারদের সমপর্যায়ে যেতে তাদের অতিরিক্ত আরও ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ লাগবে।
হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ রোজফ বলেছেন, অসামরিক খাত থেকে বরাদ্দ যেভাবে সামরিক খাতে চলে যাচ্ছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি হবে, সে ব্যাপারে অধিকাংশ ইউরোপিয় দেশেরই কোন ধারণা নেই। তিনি বলেন, এটা একটা নতুন বাস্তবতা। ইউরোপের সরকারগুলোকেই এখন খুঁজে বের করতে হবে, কিভাবে তারা এই সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে।