যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্ঘাত-কবলিত এলাকাগুলোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। তড়িঘড়ি সরে যাওয়ার সময় মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে বহু অস্ত্র সরঞ্জাম ফেলে যায়। এসব অস্ত্রের বড় একটা অংশ চোরাই পথে পাকিস্তানের গোপন অস্ত্র বাজারে ঢুকছে। পাকিস্তানি তালেবানসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠি হামলার সময় মার্কিন অত্যাধুনিক অস্ত্র সরঞ্জাম ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, নাইট ভিশন সরঞ্জামের কারণে রাতের বেলায়ও হামলার সুযোগ পেয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। এগুলোর মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছে।
সন্ত্রাসবাদের এখন যে রূপ, সেখানে অনেক প্রযুক্তি ঢুকে পড়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ যেমন হচ্ছে, তেমনি বেড়ে গেছে যোগাযোগের অবাধ সুযোগ। ডিজিটাল ও সোশাল মিডিয়াগুলো রীতিমতো যোগাযোগ বিপ্লব নিয়ে এসেছে। সন্ত্রাসবাদের প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে ওঠার পেছনে এই সবকিছুরই ভূমিকা রয়েছে। সাথে রয়েছে আরও কিছু বিষয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই এখন সহিংসতা ঢুকে গেছে। নতুন ও উদীয়মান প্রযুক্তি পাওয়া সহজ হয়ে গেছে। এখন বাণিজ্যিকভাবে ড্রোন কেনা যায়। থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত তৈরি করা যায়। এছাড়া, মনুষ্যবিহীন স্বচালিত যানবাহন তো আছেই। এই সব সুবিধার কারণে, যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ার ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের সামনে আগে যে বাধা ছিল, সেটা এখন নাই বললেই চলে। তাদের ভয়াবহতা বেড়ে গেছে। আক্রমণের ত্রুটিও কমে গেছে।
এই সব সুবিধার কারণে নতুন সদস্য নিয়োগ, প্রচার প্রচারণা চালানো, এবং আদর্শিক প্রচারণার বিষয়টিও বাস্তব জগৎ থেকে সাইবার জগতে চলে গেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে সন্ত্রাসবাদীদের খরচ কমে এসেছে। তাদেরকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে গেছে। নির্মুল করা হয়ে গেছে আরও চ্যালেঞ্জিং।
২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি ভাগতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু বহু বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে তোলা অস্ত্র সরঞ্জামের অনেক কিছুই তারা নিয়ে যেতে পারেনি। বহু ছোট ও মাঝারি অস্ত্র, রাতে দেখার সরঞ্জাম, সামরিক যোগাযোগের যন্ত্রপাতি তারা যাবার সময় ফেলে যায়। এই সব অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিগুলো ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ভেতরে যে সব সঙ্ঘাত কবলিত এলাকা রয়েছে, সেখানেও ঢুকে পড়েছে এ সব অস্ত্র শস্ত্র।
পাকিস্তানী তালেবান নামে পরিচিত তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি অনেক সময় সোশাল মিডিয়ায় তাদের সদস্যদের ছবি প্রকাশ করে। সে সব ছবিতে দেখা গেছে, তাদের সদস্যরা আধুনিক সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত। এর মধ্যে মার্কিন অস্ত্রপাতিও রয়েছে। তাদের সাথে দেখা গেছে থার্মাল ভিশন সিস্টেমযুক্ত রাইফেল আর হেলমেট, লেজার সাইটযুক্ত সাপ্রেসড রাইফেল। ২০২২ সালের আগস্টে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল টিটিপি। ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণরত সদস্যরা নানা ধরণের মার্কিন আগ্নেয়াস্ত্র বহন করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এম২৪ স্নাইপার রাইফেল, থার্মাল সুবিধাযুক্ত এম১৬ ফোর-এ রাইফেল, ট্রিজিকন এসিওজি-সহ এম৪ কারবাইন, ভারি মেশিনগান ও ১০৭ মিলিমিটারের টাইপ ৮৫ সিঙ্গেল-টিউব রকেট লঞ্চার। মার্চে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ স্বীকার করেন, টিটিপি মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করছে। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধ টিটিপির হামলা করেছিল। সেখানে তারা মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই টিটিপি সক্রিয় হয়ে ওঠে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে মোতায়েন পাক সেনাদের উপর হামলার জন্য তারা থার্মাল ভিশন সিস্টেমযুক্ত দূরপাল্লার স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করতে শুরু করে। হঠাৎ করে হামলা বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও বেড়ে যায়। শুধু সেনাদের উপর হামলার মধ্যে বিষয়টি সীমিত থাকেনি। পেশাওয়ার, লাক্কি মারওয়াত, বান্নু ও দেরা ইসমাইল খান জেলাগুলোতে তারা রাতে পুলিশ সদস্যদেরকে টার্গেট করে হামলা করে তাদেরকে হত্যা করেছে।
২০২২ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়া রাজ্যে সন্ত্রাসী হামলায় ১১৮ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসেই নিহত হয়েছে ১২০ জন। একইভাবে, বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলায় মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নোশকি ও পাঞ্জগুর জেলায় আধাসামরিক বাহিনী ফ্রন্টিয়ার কোর বা এফসি'র ক্যাম্পে হামলা করেছিল, বালুচ লিবারেশান আর্মি বা বিএলএ। ওই হামলায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তানের অস্ত্র বাজারগুলো রাশিয়ান আগ্নেয়াস্ত্রে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। এর কারন ছিলো আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ান বাহিনীর সরে যাওয়ার পর। এখন অস্ত্র বাজারগুলো মার্কিন অস্ত্রে ভর্তি। যুদ্ধে শেষে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায় আফগানিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের যে মজুদ গড়েছিল, সেগুলো এখন বাজারে জায়গা করে নিয়েছে।
পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে মার্কিন অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে গেছে। কারণ, এগুলোর গুণগত মান ভালো, টার্গেটে অনেক নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে। সে কারণে চোরাই পথে পাকিস্তানে অস্ত্র ঢুকতে শুরু করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভাষ্য মতে, পাকিস্তানের অস্ত্র বাজারে একটা মার্কিন বেরেট্টা এম৯ হ্যান্ডগানের দাম ১৫০০ ডলার, এম৪ অ্যাসল্ট রাইফেলের দাম ১৪০০ ডলার, গ্লক হ্যান্ডগান ১৫০০ ডলার, এম৪ কারবাইন ৪০০০ ডলার, ন্যাটোর সরবরাহ করা পিস্তল ৩০০ ডলার, এবং সামরিক যোগাযোগের যন্ত্র হ্যারিস ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যালকন থ্রি রেডিও'র দাম সাড়ে তিন হাজার ডলার। এগুলোর বেশির ভাগেরই কেনাবেচা হয় পাকিস্তানি রুপিতে। লেনদেন হয় নগদে। পাকিস্তানের কালোবাজারে আরও যে সব মার্কিন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে এম১৬ মেশিন গান, এম২৪ স্নাইপার রাইফেল, পালসান অ্যাপেক্স এক্সডি-ফিফটি থার্মাল সিস্টেমযুক্ত এম১৬ এ-ফোর বন্দুক।
কাবুলের ক্ষমতায় যে তালেবানরা আছে, তারা টিটিপি বা অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোকে অস্ত্র দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে না। তবে, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সরকারী কর্মকর্তা, এবং 'ওয়্যার নয়েরে'র মতো অস্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো একমত যে, বহু মার্কিন অস্ত্র এখন টিটিপির হাতে রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তালেবান নেতাদের অনেকে গোপনে কালোবাজারে এ সব অস্ত্র সরবরাহ করছে। তাদের যে অর্থসঙ্কট রয়েছে, সেটা মেটাতে তারা এই পথ বেছে নিয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা যখন আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব নেয়, তখন তাদের মাঠ পর্যায়ের সেনারা অনেক অস্ত্র সরঞ্জাম হস্তগত করেছিল। এই সেনাদেরকে কিছু কিছু অস্ত্র বিক্রির অনুমতি দিয়েছে তালেবানরা।
কৌশলগত বিবেচনায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত পরিস্থিতির উপর মার্কিন অস্ত্রের প্রভাব হয়েছে খুবই ভয়াবহ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সব অস্ত্র সরঞ্জাম জঙ্গি ও গেরিলা গোষ্ঠিগুলোর আভিযানিক সক্ষমতা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের হামলার ভয়াবহতা যেমন বেড়েছে, তেমনি নিখুঁত আঘাত হানার সক্ষমতাও বেড়েছে।
এই সক্ষমতার কারণে তাদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছে যে, কৌশলগত দিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তারা এখন সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। এছাড়া, এই সব তথাকথিত সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোকে প্রচারণাতেও কাজে লাগাচ্ছে তারা। নতুন সদস্য নিয়োগ ও অর্থায়নেও এগুলোর ব্যবহার হচ্ছে। মার্কিন অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের যে উত্তেজনা, সেটাও নতুন সদস্যদেরকে এই সব গোষ্ঠিতে যোগ দিতে আকৃষ্ট করছে।
পাকিস্তানের সঙ্ঘাত কবলিত এলাকাতে এই সব অস্ত্র ঢুকে পড়ায় সমস্যায় পড়ে গেছে নিরাপত্তা বাহিনী। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বালুচিস্তান প্রদেশের পুলিশ বাহিনীর সম্পদের ঘাটতি যেমন রয়েছে, তেমনি তাদের অস্ত্র সরঞ্জামও অত্যাধুনিক নয়। ফলে, অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে তারা। টিটিপি রাতের বেলায় যে সব অভিযান চালাচ্ছে, বা অ্যামবুশ করছে, সেগুলোর মোকাবেলায় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পুলিশের কোন কার্যকর কৌশলই নেই। নাইট ভিশন সরঞ্জামের কারণে টিটিপি বিভিন্ন চেকপোস্টে মোতায়েন পুলিশ গার্ডদের অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ সেটা পারছে না।
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় রয়েছে তালেবান। অন্যদিকে, পাকিস্তানের অসম সঙ্ঘাত বলয়ের মধ্যে অবাধে ঢুকছে মার্কিন অত্যাধুনিক অস্ত্র সরঞ্জাম। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য নিরাপত্তা সঙ্কট দ্বিগুণ জটিল হয়ে উঠেছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে পাকিস্তানকে এক দিকে যেমন সন্ত্রাস দমন ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, অন্যদিকে, গোপন অস্ত্র বাজারের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, টিটিপির মতো গোষ্ঠিগুলোর কৌশলগত সুবিধার বিপরীতে লড়তে হলে পাকিস্তানকে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য বিশেষ সন্ত্রাস দমন অস্ত্র সরঞ্জামাদি কেনার কথাও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।