কার ড্রোন দিয়ে মস্কোয় হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন

- সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১০ জুন ২০২৩, ১৪:৩০

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেওয়া এক বার্তায় জানিয়েছে, ২৯ মে রাতে আটটি কামিকেজে ড্রোন দিয়ে মস্কোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করছে, এই আটটি ড্রোনের মধ্যে পাঁচটিকেই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। বাকি তিনটা ড্রোন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, যার ফলে নির্ধারিত টার্গেট পর্যন্ত সেগুলো যেতেই পারেনি। বোঝা যাচ্ছে, ড্রোনগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই মস্কো নিজেদের প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে সক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিল। ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে এই ড্রোন হামলার দায় স্বীকার না করলেও এর দায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের দিকে চলে আসে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী মিখাইলো পোডোলাইক জানিয়েছেন, মস্কোতে ড্রোন হামলার সাথে কিয়েভ সরাসরি জড়িত ছিল না। তবে তারা খুব আগ্রহের সাথে মস্কোর বিরুদ্ধে পরিচালিত এই ড্রোন হামলা উপভোগ করেছেন। তারা আশা করছেন খুব শীঘ্রই মস্কো একইভাবে আরো বেশ কিছু হামলার শিকার হবে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেন এরই মধ্যে হয়তো দূরপাল্লার ড্রোন আক্রমণ পরিচালনা করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রোনের মজুদ বৃদ্ধি করেছে। যদিও মস্কোতে কারা এই হামলা চালিয়েছে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া এখনো সম্ভব হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যেসব ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে তা থেকে বেশ কিছু ক্লু পাওয়া যায়। ড্রোনকে অনেক সময় শনাক্ত করা যায় না। এসব ছবি দেখে ড্রোনের উৎস সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় ড্রোন সনাক্ত করার জন্য ফরেনসিক স্কিলে দক্ষ এমন প্রতিষ্ঠানের সহায়তার প্রয়োজন হয়।

কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ নামের প্রতিষ্ঠানটি এর আগে জানিয়েছিল, রাশিয়ার যে ড্রোনগুলো ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে সেগুলো এসেছে ইরান থেকে। একইভাবে এবারের হামলায় ইউক্রেন থেকে যে ড্রোনগুলো এসেছে সেগুলো ইউক্রেনের সরকারের তরফ থেকে নাও ছোড়া হতে পারে। কেননা, অনেকগুলো গ্রুপ এখন এ ধরনের ড্রোন নির্মাণ করছে। বেশ কিছু ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নামসহ একাধিক তালিকাও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে এসেছে।

এর আগে ইউকেআর জেট নামের প্রতিষ্ঠানে তৈরি হওয়া ইউজে টুয়েন্টি টু এয়ারবোর্ন ড্রোন দিয়ে অনেকগুলো দূরপাল্লার আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছে। ইউজে-টোয়েন্টি টু এয়ারবোর্ন হলো এডভান্স লেভেলের ড্রোন, যেখানে ১৭ কেজি ওজনের বিস্ফোরকও বহন করা যায়। এই ড্রোনগুলো কেমিকেজ মিশন পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়। একই কোম্পানি আরেকটু ছোট আকৃতির ইউজে-থার্টি ওয়ান জিলভাও তৈরি করেছিল। ইউজে-টোয়েন্টি টু ড্রোন যেমন ৮শ কিলোমিটার দূর থেকে অভিযান পরিচালনা করতে পারে। তবে, ইউজে থার্টি ওয়ান দিয়ে এত দূরপাল্লার অভিযান পরিচালনা করা যায় না। এই ড্রোনগুলোকে অন্য দুয়েকটি ড্রোনের শংকর হিসেবেও অভিহিত করা যায়।

বেশ কিছু সূত্র জানিয়েছে, মস্কোতে এবার যে হামলা চালানো হয়েছে সেখানেও ইউজে-টোয়েন্টি টু ড্রোনও ব্যবহৃত হয়েছে। ইউজে-টোয়েন্টি টু ড্রোনের একটি এয়ারক্রাফট লেআউট রয়েছে। সাম্প্রতিক আক্রমণের ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, ড্রোনগুলোর সামনে ছোট আকৃতির ফোরপ্লেন বা কানার্ড বসানো ছিল। ড্রোনের এই বিন্যাস দেখে বোঝা যায়, এই ড্রোন বেভারের একটি সংস্করণ। এই ড্রোনগুলো নির্মাণে কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। এই ড্রোনের নাম ও ছবি চলতি মাসের শুরুতে প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এর আগে আমরা বিভিন্ন সময় আলীবাবা ড্রোনের আক্রমণও দেখেছি। ঐ ড্রোনগুলোকে আলীবাবা বলা হতো, কেননা এগুলোকে চীনের বিশ্বখ্যাত অনলাইল পাইকারি প্রতিষ্ঠান আলীবাবার সরবরাহকৃত কিটস দিয়ে এসেম্বল করা হয়েছিল। ক্রিমিয়াসহ বেশ কিছু স্থানে পরিচালিত ড্রোন আক্রমণের ক্ষেত্রে ৯ হাজার ৫শ ডলার ব্যয়ে নির্মিত মুগিন ফাইভ নামক ড্রোন শনাক্ত করা গেছে। মুগিন-ফাইভ ড্রোনগুলো ৭ ঘন্টা টানা উড়তে পারে। এগুলোর রেঞ্জ প্রায় শতাধিক কিলোমিটার। কতটা পথ এ ড্রোনগুলো পাড়ি দিতে পারবে তা নির্ভর করে এতে কী পরিমাণ তেল আছে বা কী পরিমাণ ওয়ারহেড রয়েছে তার ওপর।

এই ড্রোনগুলো দিয়ে সহজেই ইউক্রেন থেকে মস্কোর ভেতর হামলা করা সম্ভব। তবে এই ড্রোনগুলোর বড়ো সীমাবদ্ধতা হলো এগুলো খুব বেশি মাত্রায় জিপিএস অথবা অন্যান্য স্যাটেলাইট নেভিগেশনের ওপর নির্ভর করে। ফলে, রাশিয়ানরা এ ড্রোনগুলো মোকাবিলায় খুব সহজেই জ্যাম তৈরি করতে পারে। যেকোনো টার্গেটে যথাযথভাবে হামলার জন্য চাই উন্নত নেভিগেশন ব্যবস্থা। রাশিয়া এক্ষেত্রে একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে কেননা তাদের হাতে থাকা শাহেদ ড্রোনগুলোতে ইনারশিয়াল নেভিগেশন ব্যাকআপ সিস্টেম বসানো আছে।

ইউক্রেনের প্রখ্যাত উদ্যোক্তা ভলোদেমির ইয়াতসেনকো এরই মধ্যে ড্রোন নির্মাণ করার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ চেয়ে আবেদন করেছেন। গত ডিসেম্বরে ইয়াতসেনকোর প্রতিষ্ঠান টি-টেন ধরনের ১০টি টহল ড্রোন নির্মাণ করে। তখন জানানো হয়েছিল খুব শীঘ্রই তারা অ্যাটাক ড্রোন নির্মাণেও হাত দেবেন। তবে এখনো পর্যন্ত এই অ্যাটাক ড্রোনগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তবে ইয়াতসেনকো জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার বিজয় দিবস উদযাপনের সময়ে রেড স্কয়ারে এই ড্রোনটি নামাতে চান। তিনি এই ড্রোন নির্মাণের জন্য পুরস্কার হিসেবে ৫শ হাজার ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বেশ কিছু ইউক্রেনিয়ান সংস্থাও মস্কোতে ড্রোন হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ড্রোন নির্মানের সাথে জড়িতরা রাশিয়ায় হামলা চালাতে চাইলেও ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এ ধরনের ড্রোন আক্রমণের বিষয়ে এখনো সম্মতি দেয়নি। তাদের আশঙ্কা, এই ড্রোন আক্রমণ শুরু হলে এই অঞ্চলে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। রাশিয়ার পাল্টা হামলা মোকাবিলা করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

ইতোমধ্যে ওয়ানওয়ে এরোস্পেস একিউ ফোর হান্ড্রেড স্কিথ নামক একটি দূরপাল্লার অ্যাটাক ড্রোন বাজারে এনেছে। এর আগে তারা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জন্য ছোট আকৃতির এফপিভি অ্যাটাক ড্রোন তৈরি করেছিল। স্কিথে ড্রোনগুলো ৭শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে এবং ৪০ কেজিরও বেশি পেলোড বহন করতে পারে।

এই ড্রোনগুলোর নির্মাণ ব্যয় ইরানের শাহেদ ড্রোনের কাছাকাছি। স্কিথে ড্রোনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে গণহারে সব প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যায়। এ কারণে ওয়ানওয়ে অ্যারোস্পেস প্রতি মাসে ১শটিরও বেশি স্কিথে ড্রোন তৈরি করছে বলেও জানা গেছে। স্কিথের প্রথম মডেলটির পাইলট প্রোডাকশন এখন চলমান। এই ড্রোনে যেসব বিস্ফোরক ব্যবহার করা হবে তা মূলত ইউক্রেনের দখলকৃত অংশে প্রয়োগ করা হবে। রাশিয়ার বিমান ঘাঁটি, অস্ত্রের গুদামসহ বিশেষ স্থাপনাগুলোতে এই হামলা চালানো হবে। তবে, এখন পর্যন্ত এই ড্রোনগুলো দিয়ে সরাসরি মস্কোতে হামলা চালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।

স্কিথে ড্রোনগুলোর খরচ কম হওয়ায় এবং ড্রোনগুলো আলীবাবা নকশায় তৈরি হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট সামরিক পক্ষ বেশ ফায়দা পাবে। এছাড়া এই ড্রোনগুলো মিটারের আওতাধীন এলাকায় থাকা অবস্থায় জ্যামিং এড়িয়েও যেতে পারে। সার্বিকভাবে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়াতে হামলা চালানোর জন্য ইউক্রেন অন্তত ড্রোনের দিক থেকে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মস্কোর ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক ড্রোন হামলাকে হালকাভাবে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। ইউক্রেনেই এমন অনেক গ্রুপ বা সংস্থা আছে যারা এ ধরনের হামলা করতে পারে। আবার রাশিয়ার সমর বাহিনীর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের রেশ ধরেও কোনো একটি পক্ষ এই ড্রোন ছুড়তে পারে। রাশিয়ার জন্য বড়ো সীমাবদ্ধতা হলো, এখনো পর্যন্ত দেশটিতে এককভাবে এমন কোনো কোম্পানি তৈরি করা যায়নি যারা বিস্ফোরকসহ দূরপাল্লার ড্রোন নির্মাণ করতে পারে। তাদের নকশা ও বিশেষজ্ঞ সহায়তার জন্য ইরানের কাছে শরণাপন্ন হতে হয়েছে।

এর বিপরীতে ইউক্রেনের হাতে বেশ দক্ষ একদল প্রযুক্তিবিদ আছে যারা যেকোনো হার্ডওয়্যার সরবারহ করতে সক্ষম। এছাড়া পশ্চিমা প্রযুক্তিগত সমর্থন তো আছেই। ইউক্রেন এই ড্রোন নির্মাণ শুরু করেছে মাত্র। যদি তারা চলমান কাজের গতি ধরে রাখতে পারে তাহলে ইউক্রেনের নতুন নতুন ড্রোন যে আগামীতে মস্কোর জন্য বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।