ইরানের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আতঙ্কে আমেরিকা ও ইসরাইল

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২৩ জুন ২০২৩, ২১:১৪

নিজেদের তৈরি করা প্রথম হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ফাত্তাহ’ উন্মোচন করেছে ইরান। গত ৬ জুন সকালে তেহরানে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি উন্মোচন করে দেশটির ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, ইরান তার ব্যালিস্টিক মিসাইলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। সেজন্য ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকেও নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ইরান ঠিকই তার সমরাস্ত্র কর্মসূচিকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ইসরাইলের হামলার হুমকিকে অগ্রাহ্য করে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ঘোষণা ইরানের সেই লক্ষ্য অর্জনেরই প্রমাণ বহন করছে। ইরানের এই অর্জন আতঙ্কিত করে তুলেছে আমেরিকা ও তার মিত্র ইসরাইলকে।

আইআরজিসি-র অ্যারোস্পেস ফোর্স নতুন প্রযুক্তির এই ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করেছে। বাহিনীর কর্মকর্তাদের দাবি, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার । এটি সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম। আইআরজিসি বলছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে এবং ঘণ্টায় প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। এই গতিই হলো ফাত্তাহর অন্যতম প্রধান ক্ষমতা। কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ও বাইরে দিয়ে যেকোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি ছোড়ার ৭ মিনিটের মধ্যে ইসরাইলে গিয়ে আঘাত হানতে পারবে বলেও দাবি করছে ইরান।

এই ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রযুক্তির অধিকারী কয়েকটি দেশের একটি হয়ে গেল ইরান। এখন পর্যন্ত শুধু রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়া হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি উন্মোচন করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করতে পারেনি। ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্রের ফলে পশ্চিম এশিয়ায় সামরিক সমীকরণে ইরান এগিযে থাকবে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে শত্রুরা এখন কয়েকবার চিন্তা করবে।

অনুষ্ঠানে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল হাজিজাদেহ বলেন, বিশ্বে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানসহ সব অস্ত্র ধ্বংসের জন্যই পাল্টা ব্যবস্থা বা অস্ত্র আছে। ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের জন্যও এখন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ইরানের তৈরি এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার মতো কোনো অস্ত্র এখন পর্যন্ত কারো কাছে নেই।

মেজর জেনারেল হাজিজাদেহ বলেন, ইরানের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির অর্জন এবং এর কার্যকারিতা নিঃসন্দেহে আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তমূলক এবং বৈপ্লবিক অগ্রগতি। এখন থেকে ইসলামি ইরানের শত্রুরা বিশেষ করে ইহুদিবাদী শাসক গোষ্ঠী ইরানে হামলা চালানোর বিষয়ে তাদের হিসাব পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক হিসেবে পরিচিত হাসান তেহরানি মোগাদ্দামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গত বছরের নভেম্বরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে নিজেদের সাফল্যের তথ্য প্রকাশ করেন জেনারেল হাজিজাদেহ। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এটি বায়ুমন্ডলের ভেতরে ও বাইরে কৌশলগত চলাচল করতে পারে এবং যে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে পারে।

ক্ষেপণাস্ত্রটির কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে হাজিজাদেহর দাবির সত্যতা। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রুশ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিতের দাবি করেছে কিয়েভ। তবে সাধারণ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শব্দের চেয়ে ৫ গুণ গতিসম্পন্ন হয়। ইরানের দাবি মতে, তাদের ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্রটি শব্দের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন।

ক্ষেপণাস্ত্রটি উৎক্ষেপণ করার কোনো ভিডিও প্রকাশ করেনি তেহরান। তবে জেনারেল হাজিজাদেহ জানিয়েছেন, ক্ষেপণাস্ত্রটির ইঞ্জিনের একটি স্থল পরীক্ষা চালিয়েছে তেহরান যা উৎক্ষেপণের চেয়ে জটিল বিষয়। ক্ষেপণাস্ত্রটির উন্মোচন অনুষ্ঠানে যা দেখা গেছে তা বিশ্লেষণ করে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানায়, এর সামনের দিকে স্থানান্তরযোগ্য অগ্রভাগ রয়েছে যা উড্ডয়নরত অবস্থায় এটিকে গতিপথ পাল্টানোর সুযোগ দেবে। ফলে ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ যত অনিয়মিত হবে তত তা প্রতিহত করা কঠিন হবে।

পশ্চিমা দেশগুলো ও ইসরাইল বরাবরই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে। তাদের দাবি, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। তবে তেহরান এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আইআরজিসি গত মাসে সফলভাবে ২ হাজার কিলোমিটার পাল্লার একটি নতুন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা বিশ^ ব্যাপক সমালোচনা করেছে। ফ্রান্স বলেছে, এর মাধ্যমে ইরান ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি ও জাতিসংঘের প্রস্তাব লঙ্ঘন করেছে।

এর আগে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইরান জানিয়েছিল, তারা ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার পাল্লার ক্রুজ মিসাইল তৈরি করেছে। দেশটির রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনীর শীর্ষ কম্যান্ডার সে সময় এ কথা জানিয়েছেন। নতুন এই মিসাইল দিয়ে ইরান থেকে ইসরাইলের যে কোনো স্থানে হামলা চালানো সম্ভব হবে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ইরানি ড্রোন ব্যবহার নিয়ে এমনিতেই উদ্বিগ্ন পশ্চিমা বিশ^। নতুন এই ক্রুজ মিসাইল এখন ইরান নিয়ে তাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে।

ইসরাইলের সংবাদমাধ্যম জেরুসালেম পোস্টের খবরে বলা হয়, ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনীর এরোস্পেস ফোর্সের প্রধান জেনারেল হাজিজাদেহ ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে নতুন এই ক্রুজ মিসাইল তৈরির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্রুজ মিসাইলটি এরই মধ্যে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডারে যুক্ত করা হয়েছে। ওই ক্রুজ মিসাইলের একটি ফুটেজও প্রকাশ করে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। নতুন এই ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে গোটা ইসরাইল।

ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির এই উন্নতি নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন ইসরাইল। গত মাসে ইসরাইলের সেনাপ্রধান জেনারেল হারজি হালেভি বলেছেন, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি অগ্রসর। এই পরিস্থিতিতে ইরানের সাথে ইসরাইলের সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেছেন হালেভি।

নিউজউইকে ইসরাইলের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আভিভির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি বলেছেন, ‘এখন সর্বত্রই ইরান। এই পরিস্থিতিতে ইরানের সাথে বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধের সম্ভাবনা ২০-৩০ বছর আগের চেয়ে এখন অনেক বেড়ে গেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা, ইউরোপীয় দেশগুলির উদ্বেগ ও ইসরাইলের হামলার হুমকিকে পাত্তা না দিয়েই ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি, বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কার্যক্রম জোরদার করেছে। তেহরান বলছে, কর্মসূচিটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরক্ষামূলক। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন বলেছিল যে, ইরান একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে জড়িত থাকা ও সহায়তা করার অভিযোগে ইরানের পাশাপাশি চীন ও হংকংয়ের এক ডজনের বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত ৬ জুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেইজিংয়ে নিযুক্ত ইরান দুতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে দাভুদ দামঘানিও রয়েছেন।

মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ গত ৬ জুন বলেছে, চীনের কোম্পানীগুলো ইরানের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সামরিক কাজে ব্যবহৃত জ¦ালানী উৎপাদনের জন্য সেন্ট্রিফিউজসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে । এসব প্রযুক্তি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কর্মসূচিতে কাজে লাগাচ্ছে ইরান। ট্রেজারি বিভাগের সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত উপমন্ত্রী ব্রায়ান নেলসন গত ৬ জুন এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছেন।

ব্রায়ান নেলসন বিবৃতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবর জানিয়ে বলেছেন, ইরানের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে দামঘানি চীন থেকে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগি প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি কোম্পানির জন্য সামরিক কেনাকাটায় সহায়তা করেছেন।

চীন ও ইরানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট শক্তিশালী করতে ২০২১ সালে দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান থেকে বিপুল পরিমান তেল কিনে থাকে চীন। দেশ দুটির মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। গত মার্চ মাসে ইরান ও তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বি দেশ সৌদি আরব চীনের মধ্যস্থতায় নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।

কিছুদিন আগে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী থেকে নাম প্রত্যাহার করে সৌদি আরব, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখন এসব দেশ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানকে সাথে নিয়ে যৌথ নৌবাহিনী গঠন করছে। এসব দেশের এই পদক্ষেপ এই অঞ্চলে ইরানের পাশাপাশি চীনের অবস্থানকেও সংহত করছে।