ন্যাটোর সব গোপন তথ্য চলে গেছে চীনের হাতে

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২৮ জুন ২০২৩, ১৯:৩৬

জার্মান বিমানবাহিনীর সাবেক পাইলটরা চীনের পাইলটদের বহু বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে জানিয়েছে জার্মান সংবাদ মাধ্যম দার স্পিজেল। বছরখানেক আগে জানা গিয়েছিল, ব্রিটিশ পাইলটরাও চীনা বিমান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশিক্ষণকালে ইউরোপীয় পাইলটরা চীনাদের কাছে ন্যাটোর বিভিন্ন যুদ্ধকৌশল প্রকাশ করে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ লাগলে, তাদের মোকাবেলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। চীনের ব্যপারে ইউরোয় সরকারগুলো উদাসীন- এমন অভিযোগ করে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলেছেন, এখনই তারা যদি সতর্ক না হয়, তবে ভবিষ্যতে যে কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা ইউরোপের নিরাপত্তার জন্যেই ক্ষতির কারণ হবে।

চীনা বিমান বাহিনীকে জার্মান সামরিক বাহিনীর পাইলটদের সাহায্য করার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ১৯৩০ এর দশকে নাৎসি জার্মানি চীন প্রজাতন্ত্রের বিমান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছিল। চীনা বিমান বাহিনী তখন একইসাথে মাও জেদংয়ের অধীনে কমিউনিস্ট উত্থান ঠেকাতে ও ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছিল। এর কয়েক বছর পর বার্লিন টোকিওর সাথে ট্রায়পার্টাইট প্যাক্টে চুক্তিবদ্ধ হলে চীন-জার্মান সম্পর্কের অবনতি হয়। ততদিনে চীনা পাইলটরা জার্মান বিমান বাহিনী বা লুফটওয়াফের পাইলটদের থেকে শুধু প্রশিক্ষণই নেয়নি, বরং তখন তারা জার্মানির তৈরি বোমারু ও জঙ্গিবিমান ওড়ানো শুরু করে। কমিউনিস্ট এবং জাপানিদের বিরুদ্ধে হামলা করছে।

জার্মানির জঙ্গি বিমানের পাইলটরা আবারও চীনের বিমান বাহিনীকে প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সাহায্য করছে। দার স্পিজেলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশক ধরে লুফটওয়াফের সাবেক কিছু পাইলট চীনের পিপলস লিবারেশান আর্মি এয়ার ফোর্স বা পিএলএএএফের পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রতিবেদনে পরিচয় প্রকাশ না করে জার্মানির কিছু নিরাপত্তা কর্মকর্তা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এমন সম্ভাবনা আছে , প্রশিক্ষক পাইলটরা হয়তো সামরিক দক্ষতা ও গোপনীয় আভিযানিক কৌশল সম্পর্কিত তথ্য এরই মধ্যে সরবরাহ করেছে। এমনকি তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যে কোনো কাল্পনিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কি ধরণের মহড়া প্র্যাকটিস করেছে ন্যাটো, সেটার তথ্যও তারা হস্তান্তর করে থাকতে পারে।

লুফটওয়াফের অবসরপ্রাপ্ত পাইলটরা চীনা পাইলটদের কার্যকর দমন অভিযানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এবং শত্রু পক্ষের আকাশ প্রতিরক্ষা ধ্বংসের কৌশল শেখাতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ধরণের অভিযানকে সামরিক পরিভাষায় এসইএডি ও ডিইএডি বলা হয়। শীতল যুদ্ধের পর এই কৌশলগুলো ছিল লুফটওয়াফের দক্ষতার একটা অংশ।

তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যে কোনো যুদ্ধ হলে, সেখানেও আকাশসীমায় আধিপত্য বিস্তারে এই কৌশল চীনকে সাহায্য করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লুফটওয়াফে একমাত্র কমব্যাট মিশনে অংশ নিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। জার্মান টর্নেডো জঙ্গি বিমানগুলো এ সময় ইলেকট্রনিক অস্ত্র ও রেডিয়েশান-রোধক মিসাইলে সজ্জিত হয়ে সার্বিয়ান বিমান সুরক্ষা সিস্টেমের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছিল। সেটা ছিল মূলত ন্যাটোর এসইএডি অভিযানের অংশ।

জার্মান পাইলটরা চীনা পাইলটদেরকে বিমান অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও বিশদভাবে শেখাতে পারে। যেমন, যৌথ বিমান অভিযানের ক্ষেত্রে ন্যাটোর যে সামরিক নীতিমালা রয়েছে, সেই তথ্য তারা বিনিময় করে থাকতে পারে। এর অর্থ হলো, ন্যাটোর অধীনে বিভিন্ন ধরণের বিমান কিভাবে সমন্বিতভাবে অভিযানে অংশ নেবে, সেটার তথ্য জানিয়ে দেয়া।

তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীন কোনো এসইএডি অভিযানে নামলে সেখানেও তারা বিভিন্ন ধরণের বিমান সমন্বিতভাবে ব্যবহার করবে। এগুলো সব আরও বৃহৎ অভিযানের অংশ হিসেবে কাজ করবে, যেখানে ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক মিসাইলের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের ড্রোনও থাকবে। এই ধরণের অভিযানের পরিকল্পনা করাটাই অনেক চ্যালেঞ্জিং ও জটিল। তার বাস্তবায়ন আরও কঠিন। সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ কিভাবে এ ধরণের অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, জানতে পারলে চীনা কর্মকর্তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।

জার্মান কাহিনীর আগে গত বছর আরেকটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। দেখা গেছে, ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের অন্তত ৩০ জন সাবেক পাইলট একইভাবে চীনের বিমান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চীনা পাইলটদেরকে তারা ন্যাটোর কৌশল ও পশ্চিমা সামরিক নীতিমালা সম্পর্কে জানিয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, জার্মান ও ব্রিটিশ পাইলটরা যে এত দীর্ঘ সময় চীনের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এর অর্থ হলো ইউরোপিয়ানরা বেইজিংয়ের সাথে বিশেষ করে সামরিক ক্ষেত্রে বিনিময়ের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তবে, শুধু ইউরোপীয় পাইলটই নয়, সাবেক এক মার্কিন মেরিন কোর পাইলটের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে , তিনি চীনা পাইলটদেরকে বিমানবাহী রণতরীতে বিমান ল্যান্ড করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ইউরোপে এ ধরণের ঘটনার সংখ্যা বেশি। এর অর্থ হলো, সেখানে এটা পদ্ধতিগত সমস্যা হয়ে উঠেছে।

চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে ইউরোপের জন্য তারা কি ধরণের হুমকি হয়ে উঠছে, সেটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বিশেষ করে চীন যেখানে বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলছে। অথচ ইউরোপের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নির্ভর করছে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার উপর। ইউরোপ যদি শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে চায়, তাহলে তাদেরকে ঢিলা নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।

চীনের সামরিক উচ্চাকাঙ্খার ব্যপারে ইউরোপের উদাসীনতার কতগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, চীন যেখানে যুদ্ধে জড়াতে পারে, সেটা হলো তাইওয়ান। ইউরোপ ভাবছে, এ রকম যুদ্ধ লাগলে, সেটা হবে পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধ, এবং তা হবে মূলত যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, চীনের ব্যপারে ইউরোপিয়দের ধারণা তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রেরও ভূমিকা আছে।

যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইউরোপিয়ানদের বলেছে, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের সামরিক শক্তি বাড়ানো উচিত। চীনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য কোনো সঙ্ঘাতে ইউরোপের কোনো ভূমিকা থাকবে কি না, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনও কিছু বলেনি। সে কারণে ইউরোপীয়রা ভাবছে, তারা শক্তি বাড়িয়ে আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেরাই গড়ে তুলবে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ন্যূনতম হলেই চলবে।

অন্যদিকে, ইউরোপ থেকে শক্তি বাঁচিয়ে চীনের যে কোনো সম্ভাব্য আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র একাই মোকাবেলা করুক। ইউরোপের মতো যুক্তরাষ্ট্রও এটাই চাচ্ছে। কিন্তু জার্মান ও ব্রিটিশ পাইলটরা চীনা বিমান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে ইউরোপ আমেরিকার এই সামরিক শক্তির বিভাজনটা খুব একটা কার্যকর না-ও হতে পারে।

ইউরোপীয় নাগরিকদের মাধ্যমে বেইজিংয়ের কাছে সামরিক গোপন তথ্য চলে যাওয়ার অর্থ হলো, এই দেশগুলোর সরকার সামরিক হুমকিকে ঠিক গুরুত্ব দিচ্ছে না। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইউরোপীয় শিল্প কারখানাগুলো ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়াকে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সামরিক সরঞ্জাম, দ্বৈত ব্যবহার্য প্রযুক্তি, নিখুঁত আঘাত হানার উপযোগী অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিসহ অন্যান্য সহায়তা দিয়ে গেছে। এগুলো রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার ব্যপারে সতর্ক হয়েছে। কিন্তু চীনের ব্যপারে তাদের উদাসীনতা রয়েই গেছে। চীনাদের কাছে ইউরোপীয়দের সামরিক গোপন তথ্য সরবরাহের অর্থ হলো, যে কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে জেতাটা যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, যে কোনো অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাও আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক হয়ে চীনকে অবহেলার নীতি ঠিক নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ইউরোপীয়দের যেসব অস্ত্র সরঞ্জাম লাগবে, চীন বিরোধী যে কোনো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই একই অস্ত্র সরঞ্জাম লাগবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রিসিশান-গাইডেড অস্ত্র, দূরপাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, আকাশ যান, নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ বিমান, ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম, এয়ার-টু-এয়ার জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সাইবার নজরদারির সক্ষমতার মতো বিষয়।

ওয়াশিংটনের কাছে এই সব ধরণের অস্ত্র সরঞ্জাম যথেষ্ট পরিমাণে নেই। এই অবস্থায় ইউরোপিয়ানদের চীনাদেরকে সাহায্য করার অর্থই হলো এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক সরঞ্জামের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সতর্কতা জানানোর পরও ইউরোপীয় দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি উচ্চ প্রযুক্তির সক্ষমতা বাড়াতে ধীর গতিতে বিনিয়োগ করছে। বড় ধরণের তীব্র যুদ্ধ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জনের জন্য অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশের আরও বহু বছর লেগে যাবে।

জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বোরিস পিস্টোরিয়াস চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে এক বৈঠকে বলেছেন, বেইজিং যাতে চীনা পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য লুফটওয়াফে পাইলটদের ভাড়া না করে। তবে, এ রকম অনুরোধ যথেষ্ট হবে না। ইউরোপীয় সরকারগুলোকে আইন করতে হবে, যাতে তাদের নাগরিক বা কোনো কোম্পানি চীনা সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে না পারে।

চীনের ব্যাপারে ইউরোপের বৃহত্তর মানসিকতা পরিবর্তন করা অনেক কঠিন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এশিয়াতে কোনো যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র যদি জিতেও যায়, তবু তাদের বিধ্বস্ত সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠনে বহু বছর লেগে যাবে। এই সময়ে ইউরোপকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। যে কোনো মূল্য এ ধরণের সামরিক বিপর্যয় এড়াতে ইউরোপের সতর্ক হওয়া উচিত। তারা বলছেন, চীনের সামরিক বাহিনিকে সরাসরি বা পরোক্ষ সহায়তা করলে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্যই সেটা বিপর্যয় নিয়ে আসবে।