অস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে বড় ধরনের বেকায়দায় পড়েছে ইউক্রেন। এ-পর্যন্ত ঠিকাদারদেরকে তারা শত শত মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। কিন্তু এখনও সে-সব অস্ত্র হাতে পায়নি। এদিকে, পশ্চিমারা মাঝেমাঝেই ঢাকঢোল পিটিয়ে কিয়েভকে বহু অস্ত্র সরঞ্জাম দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেগুলোর অবস্থাও খারাপ। পশ্চিমাদের অনেক অস্ত্রই ব্যবহারের উপযোগী নেই। সেগুলো মেরামত করে পাঠাতে অনেক সময় লাগছে। আবার অনেক অস্ত্র একেবারেই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বড়জোর সেগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ কাজে লাগাতে পারবে ইউক্রেনের সেনারা। এ-সব নিয়ে ইউক্রেনের নেতাদের ক্ষোভ থাকলেও সম্পর্ক নষ্টের ভয়ে প্রকাশ্যে তারা মুখ খুলছে না।
ইউক্রেন সরকারের নথিপত্র বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত বছরের শেষ নাগাদ তারা অস্ত্র সরবরাহকারী ঠিকাদারদেরকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দিয়েছে। কোন অর্ডারের বিপরীতে পেয়েছে আংশিক। আবার কোন অর্ডারে পায়নি কিছুই। আবার এমন ঘটনাও আছে, যেখানে অস্ত্র দিতে না পেরে ঠিকাদাররা অর্থ ফেরত দিয়েছে। শত শত মিলিয়ন ডলার যাদের দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে নামিদামি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিও আছে। এগুলোর অনেকগুলোই তারা হাতে পাননি।
অস্ত্র কেনার সাথে জড়িত আছেন ইউক্রেনের ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভোলোদিমির হাভরাইলভ। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, "অনেক ক্ষেত্রে আমরা অর্থ দিয়েছি, কিন্তু অস্ত্র পাইনি। সরকার এবার আগের বছরের চুক্তিগুলো যাচাই করে দেখছে। যে সব ঠিকাদার অস্ত্র দিতে পারেনি, আগামীতে তাদেরকে বাদ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
ইউক্রেন এখন যেভাবে অস্ত্র কেনার চেষ্টা করছে, তাতে সমস্যা কিছু হবেই। গত বছর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা মিত্ররা তাদেরকে বহু বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র একাই ৪০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এর বাইরে আর্থিক ও মানবিক সহায়তার পরিমাণও অনেক। ইউরোপিয় মিত্ররাও দিয়েছে বহু বিলিয়ন ডলারের সহায়তা। এর বাইরে, ইউক্রেন নিজেও প্রাইভেট অস্ত্র বাজারে খরচ করেছে বহু বিলিয়ন ডলার ।
পশ্চিমা মিত্রদের থেকে যে সব অস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেন, তার মধ্যে মার্কিন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো আধুনিক অস্ত্রও রয়েছে। ইউক্রেনিয়রা বলছে, রাশিয়ার ড্রোন ও মিসাইলের বিরুদ্ধে এগুলো যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মিত্ররা অস্ত্রাগারে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা অস্ত্র দিয়েছে। ভালোমতো মেরামত ছাড়া যেগুলো ব্যবহার করাই সম্ভব নয়। ইউক্রেনের অস্ত্রের প্রায় ৩০ শতাংশই সব সময় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে থাকে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধের মাঠে মোকাবেলার জন্য যাদের প্রতিটি অস্ত্র তৈরি থাকা দরকার, তাদের জন্য এই অবস্থা খুবই শঙ্কার।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্থল যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ বেন ব্যারি বলেছেন, যে সব সেনাবাহিনী ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে, আমি যদি তাদের প্রধান হতাম, তাহলে অস্ত্রের মানের কারণে খুবই বিব্রত হতাম। ইটালি সরকার সম্প্রতি ইউক্রেনকে ৩৩টি স্বচালিত হাউইটজার বা কামান দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, একটির ইঞ্জিন থেকে প্রবল ধোঁয়া বের হচ্ছে। আরেকটির ইঞ্জিনের কুলার লিক করেছে। ইটালির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, এই হাউইটজারগুলোকে আরও আগেই বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও ইউক্রেন নিতে চেয়েছে বলে তাদেরকে সেটা দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের মাঠে তাদের যেহেতু জরুরি অস্ত্রের দরকার, তাই এগুলো মেরামত করে ব্যবহার করতে হবে।
ইউক্রেন সরকারের নথিপত্রে দেখা গেছে, তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আমেরিকার এক অস্ত্র ডিলারকে ১৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ৩৩টি কামান মেরামতের জন্য ফ্লোরিডা-ভিত্তিক আলট্রা ডিফেন্স কর্পোরেশানকে তারা এই অর্থ প্রদান করে। সরকারের নথিতে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে ১৩টি কামান তারা ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেগুলোও যুদ্ধে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
কিয়েভের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে মেরামতের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আলট্রা ডিফেন্স সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ক্রয় বিষয়ক ডিরেক্টর ভোলোদিমির পিকুজো ৩ ফেব্রুয়ারি পেন্টাগনের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছে একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি বলেছেন, যে সব আমেরিকার কোম্পানি ইউক্রেনকে সেবা দিতে চেয়েছে, সময়মতো কাজ শেষ করার ব্যপারে তাদের কোন পরিকল্পনাই নেই।
আলট্রা ডিফেন্সের সিইও ম্যাথিউ হেরিং অবশ্য অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। এক টেক্সট মেসেজে তিনি লিখেছেন, আমরা যখন কামানগুলো হস্তান্তনর করেছি, তখন প্রত্যেকটিই ভালোমতো কাজ করেছে। তিনি বলেন, কামানগুলো হাতে পাওয়ার পর ইউক্রেনিয়রা সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। ইউক্রেনকে সবগুলো বুঝিয়ে দেয়ার পর, ইঞ্জিনের কুলার লিক করা কামানটি ম্যাজিকের মতো কোত্থেকে হাজির হলো, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ভাঙ্গা বা অকার্যকর অস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা সাধারণত কোন কথা বলেননি। দাতাদেরকে তারা বিব্রত করতে চান না। হাভরিলভ বলেছেন, কিছু কামানের মান নিয়ে সমস্যা আছে। তবে, আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে যে, এগুলো দেয়া হয়েছে উপহার হিসেবে। তবে ইউক্রেনের আরেক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, কিয়েভের সরকারের ভেতরে অবশ্য এগুলো নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, যথেষ্ট পশ্চিমা অস্ত্র তারা পেয়েছে। কিন্তু কিছু অস্ত্রের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। সেগুলো যুদ্ধে ব্যবহারই করা যাবে না।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর অস্ত্র সমস্যা সেই সোভিয়েত পরবর্তী সময় থেকেই চলে আসছে। দেশের অস্ত্র শিল্পের সাথে জড়িতদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী চিন্তা ভাবনার কারণে এই সমস্যা কখনই তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর অর্থের জন্য সোভিয়েত আমলের অনেক অস্ত্র বিক্রি করে দেয় ইউক্রেন। দেশের অস্ত্রের মজুদ তখনই কমে গেছে। বিশেষ করে ২০১০ এর দশকের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানিকোভিচের আমলে অস্ত্রের মজুদ কমেছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়ার দখল নেয়ার পর পুরনো বিতর্ক নতুন করে চাঙ্গা হয়। ইউক্রেনের অস্ত্র শিল্পকে কতটা ব্যবহার করা দরকার, এই প্রশ্ন তখনই উঠেছে।
ইউক্রেনের ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হাভরিলভ জানান, গত বছর যখন যুদ্ধ শুরু হয়, ইউক্রেন তখন অস্ত্র আর গোলাবারুদের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিয়েভের নেতারা তখন সম্ভাব্য সব জায়গায় অস্ত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বহু ঠিকাদার তখন ইউক্রেনের কাছে প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিল। যাদের অনেকই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সরকারের নথিপত্রে দেখা গেছে, যে সব অস্ত্র এখনও হাতে আসেনি, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি হয়েছিল খোদ ইউক্রেনের অস্ত্র কোম্পানিগুলোর সাথে। ইউক্রেনের ওই রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিগুলো ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে, এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সাথে চুক্তি করেছিল। সময়মতো অস্ত্রের ডেলিভারি দিতে না পারায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অন্তত দুটো রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করে। পরে বাধ্য হয়ে ইউক্রেন সরকার সম্প্রতি এই কোম্পানিগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
পশ্চিমাদের দেয়া অস্ত্র নিয়েও সমস্যা আছে। কিছু অস্ত্র হাতে এসেছে অনেক দেরিতে। কিছু অস্ত্র হঠাৎই এসে হাজির হয়েছে। এ সব কারণে পাল্টা হামলার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই সব অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে জটিলতায় পড়েছে ইউক্রেন।
গত গ্রীষ্মে মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটকে বলা হয়, ২৯টি হামভি যান ইউক্রেনে পাঠাতে। কুয়েতের ক্যাম্প আরিফজান থেকে ওগুলো পাঠানোর কথা। ইউনিটের প্রধান জানান, একটি ছাড়া বাকি কোন হামভিই অভিযানে অংশ নেয়ার অবস্থায় নেই। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২৬টি হামভিই ভেঙ্গে পড়ে আছে। আগস্টের শেষ দিকে, ঠিকাদাররা হামভিগুলো মেরামত করে। দেখা গেছে কোনটার ব্যাটারি শেষ, কোনটাতে লিক করেছে, কোনটার লাইট ভাঙ্গা, দরজাতে সমস্যা, কিংবা সিটবেল্ট নেই।
মেরামতের পর কুয়েত থেকে পাঠানো হামভিগুলো প্রথমে পোল্যান্ডের একটি ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। সেখানে কর্মকর্তারা দেখেন ২৫টি হামভিরই টায়ার পচে গেছে। বিকল্প টায়ার খুঁজে বের করতে তাদের এক মাস লেগে যায়। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সব কারণে ইউক্রেনে হামভি পাঠাতে দেরি হয়েছে। আবার এর পেছনে অনেক সময় আর শ্রমও গেছে।
কুয়েতের একই সেনা ইউনিটকে ছয়টি এম৭৭৭ হাউইটজার বা কামানও দিতে বলা হয়েছিল। দেখা গেছে, সেগুলোও ব্যবহারের অনুপযোগী। ১৯ মাস সেগুলোর কোন সার্ভিস চেকআপ হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি কামান এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে, কেউ সেটা ব্যবহারের চেষ্টা করলে সে নিজেই মারা পড়তে পারে।
তিন মাস ধরে মেরামত করে সেগুলো পোল্যান্ড পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও কর্মকর্তারা ছয়টি কামানে ত্রুটি খুঁজে পান। পরে পোল্যান্ডেই ঠিক করার পর সেগুলো ইউক্রেনে পাঠানো হয়। কিছু সামরিক সিস্টেম খুবই দুর্লভ। এ ধরনের অস্ত্র সরঞ্জাম ভাঙ্গা বা অচল হলেও সেগুলো নিয়েছে ইউক্রেন। যাতে সেগুলোর যন্ত্রাংশগুলো অন্তত ব্যবহার করা যায়।
ব্রিটেনের দশাও একই রকম। জানুয়ারিতে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস জানান, ইউক্রেনকে কিছু এএস-৯০ হাউইটজার দেবে তারা। তবে, মন্ত্রণালয় এটাও জানায় যে, সবগুলোর কার্যকারিতা 'এক অবস্থায় নেই'। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা এমন যে, ইউক্রেনকে সেগুলো পুরোপুরি মেরামত করে নিতে হবে। অথবা সেগুলো থেকে যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হবে।