ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই পারমাণবিক হুমকি দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। বিশ্লেষকরাও শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধকে পারমাণবিক যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করছেন বারবার। কেউ বলছেন, সেই যুদ্ধ হতে পারে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের একমাত্র সিদ্ধান্তদাতা দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তার হাতে রয়েছে এ-সংক্রান্ত বিশেষ একটি যোগাযোগ মডিউল। যেটি মূলত একটি ব্রিফকেস। নাম তার চেগেট। যার মাধ্যমে পুতিন দেশের বাইরে থাকলেও প্রয়োজনের সময় পারমাণবিক হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। আবার কখনো কোনো আকস্মিক হামলায় রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা সবাই নিহত হলেও পাল্টা হামলার ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে দেশটি, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে তৈরি করা সিস্টেম নিজেই পাল্টা হামলা চালাতে পারবে।
উত্তরাধিকার সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশিরভাগ পারমাণবিক অস্ত্র পেয়েছে রাশিয়া। বিলুপ্তির আগে সোভিয়েত শাসকদের কাছেই ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের সবচেয়ে বড় মজুদ। বর্তমানে রাশিয়ার হাতেও রয়েছে বিশে^র সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বোমা।
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট- এর ২০২২ সালের এক হিসাবে বলা হয়েছে, ভøাদিমির পুতিনের দেশের হাতে ৫ হাজার ৯৯৭টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজার ওয়ারহেডকে অবসরে পাঠানো হয়েছে, তবে এগুলো এখনো সুরক্ষিত এবং ব্যবহার উপযোগী রয়েছে। বাকিগুলোর মাঝে ২ হাজার ৮৮৯টি রয়েছে রিজার্ভ হিসেবে। এবং অবশিষ্ট ১ হাজার ৫৮৮টি মোতায়েন রয়েছে যুদ্ধের জন্য।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাণ্ডারে পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা ৫ হাজার ৪২৮টি। অর্থাৎ জো বাইডেনের চেয়ে পুতিনের হাতে এই অস্ত্র বেশি আছে ৫৬৯টি।
বুলেটিন অব অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টের তথ্য মতে, রাশিয়ার মোতায়েনকৃত দেড় হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেডের মধ্যে ৮১২টি রয়েছে স্থলভিত্তিক ব্যালেস্টিক মিসাইলে, ৫৭৬টি রয়েছে সাবমেরিনে থাকা ব্যালেস্টিক মিসাইলে এবং ২০০টি রাখা হয়েছে বোমারু বিমানের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র মোতয়েন রেখেছে ১ হাজার ৬৪৪টি পারমাণবিক ওয়ারহেড। এর অর্থ হচ্ছে, মস্কো কিংবা ওয়াশিংটন চাইলে বিশ^কে কয়েকশো বার ধ্বংস করে দিতে পারে। অন্য দেশগুলোর মাঝে চীন ৩৫০টি, ফ্রান্স ২৯০টি ও ব্রিটেন ২২৫টি ওয়ারহেড মোতায়েন রেখেছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমানবিক বোমার সংখ্যা পৌঁছেছিল ৪০ হাজারে, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল ৩০ হাজার। তবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির অধীনে উভয় দেশ এই সংখ্যা কমিয়ে এনেছে পরবর্তীতে।
বোমার সংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো- কীভাবে হামলা চালানো বা টার্গেটে পাঠানো যাবে বোমাগুলো। এক্ষেত্রেও রাশিয়া তৈরি করেছে বিশাল সংখ্যক মিসাইলের বহর। অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট বুলেটিন জানিয়েছে, রাশিয়ার হাতে আছে প্রায় ৪০০টি পারমাণবিক অস্ত্রবাহী আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল। যেগুলো প্রায় ১ হাজার ২০০টি ওয়ারহেড বহন করতে পারবে। এছাড়া রুশ বাহিনীর আছে ১০টি পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সাবমেরিন, যাতে ৮০০টি পর্যন্ত পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করা যায় । এ ছাড়াও আছে ৬০ থেকে ৭০টি পারমাণবিক বোমারু বিমান।
ব্যবহারের প্রশ্ন এলে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। দেশটির নিউক্লিয়ার ডকট্রিন বা পারমাণবিক মতবাদে বলা হয়েছে, কৌশলগত কিংবা অন্য যে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের একমাত্র সিদ্ধান্তদাতা হবেন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। তার অনুমতি ছাড়া আর কারো নির্দেশে কোনো কমান্ডার পারমাণবিক অস্ত্র ছুড়তে পারবে না। এই অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে থাকে গোপন কোড, যার মাধ্যমে তিনি এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেবেন।
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের রয়েছে একটি ব্রিফকেস। যেটির নাম চেগেট। এটিকে অনেকে নিউক্লিয়ার ব্রিফকেসও বলে থাকেন। ককেশাস অঞ্চলের চেগেট পাহাড়ের নাম থেকে এটির নামকরণ করা হয়েছে। চেগেট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নিজে সরাসরি পারমাণবিক হামলা চালাতে পারেন না, তবে এর মাধ্যমে হামলার নির্দেশ দিতে পারেন।
সব সময় ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে থাকে এই ব্রিফকেস, এমনকি বিদেশ সফরে গেলেও এটি হাতছাড়া করেন না তিনি।পুতিন ছাড়া অন্য কেউ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলে, তখন তার কাছে যাবে চেগেট। প্রেসিডেন্টেরআস্থাভাজন একজন কর্মকর্তা সব সময় এটি বহন করেন।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের কাছেও একই রকম দুটি ব্রিফকেস রয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার কর্মকর্তারা কখনো প্রকাশ্যে কথা বলেন না।
চেগেট নামের এই ব্রিফকেসটি মূলত একটি যোগাযোগ যন্ত্র, যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট তার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা এবং রকেট ফোর্সের সাথে জরুরী যোগাযোগ করতে পারেন। কাজবেক নামে পরিচিত একটি ইলেকট্রনিক কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চলে এই যোগাযোগ। যা এতটাই গোপনীয় ও সুরক্ষিত যে- বিশে^র কোনো গুপ্তচর সংস্থার পক্ষেই তাতে আড়ি পাতা সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়।
২০১৯ সালে রাশিয়ার জেভেজদা টেলিভিশনে প্রচারিত একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, এই ব্রিফকেসে রয়েছে বেশ কয়েকটি সেকশন। যার একটি সেকশনের নাম কমান্ড, যেখানে রয়েছে দুটি বাটন। সাদা বাটনটির ওপর লেখা রয়েছে লঞ্চ, আর লাল বাটনটির ওপর লেখা রয়েছে ক্যানসেল। জেভেজদার খবরে বলা হয়, পুতিনের এই ব্রিফকেস খুলতে হয় একটি ফ্লাশকার্ডের মাধ্যমে। যা শুধু তার কাছেই থাকে।
যদি রাশিয়া কখনো মনে করে তারা কোনো দেশের কাছ থেকে কৌশলগত পারমাণবিক হামলার শিকার হচ্ছে, তখন দ্রুততার সাথে প্রেসিডেন্ট ফ্ল্যাশকার্ডের সাহায্যে তার নিউক্লিয়ার ব্রিফকেস চালু করবেন। এরপর তিনি জেনারেল স্টাফ কিংবা রিজার্ভ কমান্ড ইউনিটের কাছে পাল্টা পারমাণবিক হামলার আদেশ পাঠাবেন।
এই দুটি জায়গায় সুরক্ষিত আছে পারমাণবিক হামলার গোপন কোড। এ আদেশ দ্রুত পাঠানো হয় স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্সের কাছে, যারা পারমাণবিক হামলা চালাতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। আদেশ পাওয়া মাত্র তারা মিসাইল ফায়ার করবে। এসব কিছুতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। সিস্টেমটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, শত্রুরাষ্ট্র মিসাইল ছোড়ার পর সেটি রাশিয়ার ভূখণ্ডে আঘাত হানার আগেই তারা পাল্টা মিসাইল ছুড়তে পারবে।
রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের জরুরী প্রয়োগের জন্য চেগেট নামের ব্রিফকেসটি তৈরি করা হয় ১৯৮৩ সালে। ক্রেমলিনে রুশ প্রেসিডেন্টের জন্য অত্যন্ত সুরক্ষিত মিলিটারি কমান্ড সেন্টার রয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট যখন ক্রেমলিনের বাইরে- এমনকি বিদেশ সফরেও থাকেন, তখন যাতে কোনোভাবে রাশিয়ার আত্মরক্ষার হাতিয়ার দুর্বল হয়ে না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করতেই তৈরি করা হয় চেগেট। এখন পর্যন্ত একবারই চেগেট ব্যবহার করতে হয়েছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে। ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের।
আজকের রাশিয়া তখন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বরিস ইয়েলিৎসিন। সেবারই প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র বার চেগেট খোলা হয়েছিলো। নরওয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা কাজের জন্য একটি মিসাইল উৎক্ষেপণ করেছিলেন। দেশটির আকাশে আলোর খেলা ‘অরোরা’ বা নর্দান লাইটস নিয়ে গবেষণার জন্য মিসাইলটি ছোড়া হয়।ভুলবশত রাশিয়ার রাডার সেটিকে বিপদ সঙ্কেত হিসেবে চিহ্নিত করে। বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে মিসাইল ছোড়া হয়েছে। এরপরই প্রেসিডেন্ট ইয়েলিৎসিন তার নিউক্লিয়ার ব্রিফকেসের ডালা খোলেন।
ঘটনার পরদিন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ইমারজেন্সি বাটনওয়ালা যে ছোট স্যুটকেসটি সব সময় আমার কাছে থাকে সেটি গতকাল প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছি।দ্রুততার সাথে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করি এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা মিসাইলটির গতিপথের ওপর নজর রেখেছি। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, একটু পরেই তারা বুঝতে পারেন যে- নরওয়ের মিসাইলটি মস্কো থেকে বহুদূরের কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে ছোড়া হয়েছে। তারপর তারা সেটিকে ভূপাতিত করার সিদ্ধান্ত বাদ দেন।
নরওয়ের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তারা আগেই এমন একটি মিসাইল উৎক্ষেপণের বিষয়ে রাশিয়ার কর্মকর্তাদের অবহিত করেছিলেন; কিন্তু ভুলবশত রুশ কর্মকর্তারা তাদের আর্লিওয়ার্নিং রাডারকে এ সংক্রান্ত ডেটা সরবরাহ করেনি। যার ফলে রাডার বিপদসঙ্কেত হিসেবে চিহ্নিত করে মিসাইলটিকে।সম্ভবত এরপর থেকেই রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণের বিষয়টি কয়েক ধাপে যাচাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তাই এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে জেনারেল স্টাফের কাছে বার্তা পাঠানো হবে, সেখান থেকে বার্তা যাবে কমান্ডাদের কাছে।
নিজেদের পারমাণকি অস্ত্রভাণ্ডারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও চালু করেছে রাশিয়া। তাদের সেই ব্যবস্থার নাম ‘ডেড হ্যান্ড’। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের এই প্রযুক্তিটি ‘পেরিমিটার’ নামেও পরিচিত। এটি এতটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি যে, কখনো কোনো আকস্মিক হামলায় রাশিয়ার নেতাদের হত্যা করা হলে, এই যন্ত্র নিজে নিজেই পারমাণবিক হামলা চালাতে পারবে।
১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম এই ব্যবস্থা চালু করে। যা কম্পন পর্যালোচনা, রেডিয়েশন লেভেল পরিমাপ, বাতাসের চাপ ও তাপমাত্রা- ইত্যাদি পরিমাপ করে এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ও মিসাইল আর্লি ওয়ার্নিং ডাটা অনুধাবন করে মোবাইল কন্ট্রোল সিস্টেমকে কার্যকর করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা দেখলে এর কম্পিউটার জেনারেল স্টাফের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। যদি জেনারেল স্টাফ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়া যায়, তাহলে সে নিজেই পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নেবে।