ক্ষেপণাস্ত্র আর বিমান হামলার বৈপ্লবিক উন্নতির পরও যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কবহর যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা আরও একবার দেখা গেল ইউক্রেন-যুদ্ধে। এই যুদ্ধে ট্যাঙ্কই হয়ে উঠেছে ফ্রন্টলাইনের প্রধান হাতিয়ার। রাশিয়ার বাহিনী যেমন ট্যাঙ্কের বিশাল বহর পাঠিয়েছে ইউক্রেনে, তেমনি কিয়েভের বাহিনীও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রধান অবলম্বন বানিয়েছে এই যুদ্ধযানটিকে। রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ইউক্রেনকে হারাতে হয়েছে ট্যাঙ্কবহরের বিরাট একটি অংশ। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ব্যাটল ট্যাঙ্কগুলোও এখন পুড়ছে রুশ গোলায়। কোথাও বা ট্যাঙ্ক ফেলেই পালাচ্ছে কিয়েভের বাহিনী।
সোভিয়েত সেনাবাহিনীর অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি ছিল ইউক্রেনে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সব কিছুর মালিক হয় ইউক্রেন। নতুন জন্ম নেওয়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর কাছে তখন ছিল ৮ হাজার ৭০০ ট্যাঙ্ক। যা ওই সময়ে বিশে^র সবচেয়ে বড় ট্যাঙ্কবহর হয়ে ওঠে। এছাড়া ১১ হাজার আর্মারড ও ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকেলস, ৮ হাজার কামান এবং প্রায় তিন হাজার বিমান ও হেলিকপ্টারের মালিক হয় দেশটি। এসবই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পত্তি। ইউক্রেনের স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশটির মাটি থেকে রাশিয়া তাদের বিমানবহরের বড় একটি অংশ ফিরিয়ে নিলেও স্থলযুদ্ধের উপকরণগুলো নেয়নি।
এই বিশাল সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ করার দক্ষতা ছিল না ইউক্রেনের। যে কারণে এর বড় একটি অংশ তারা বিক্রি করে দেয়। আবার কিছু ভেঙে ফেলে স্টিল কারখানাগুলোতে কাজে লাগানো হয় কাঁচামাল হিসেবে। ইউরোপীয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিরও ভূমিকা ছিল এসব পদক্ষেপের পেছনে।
সোভিয়েত যুগের প্রসিদ্ধ দুটি অস্ত্র কারখানা খারকোভ লোকোমোটিভ ফ্যাক্টরি ও খারকোভ মেশিন বিল্ডিং ডিজাইন ব্যুরো উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল ইউক্রেন। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে অবস্থিত এই কারখানা দুটি। এই কোম্পানি দুটি তৈরি করেছিল বিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ট্যাঙ্ক। টি-৩৪, টি-৬৪, টি-৮০র মতো ওই সময়ের সেরা ট্যাঙ্কগুলো তৈরি হয়েছিল ইউক্রেনের মাটিতে।
তবে ইউক্রেনের মালিকানায় যাওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের জৌলুশ হারাতে শুরু করে। একসময় যে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কয়েকশ ট্যাঙ্ক উৎপাদন করত, সেটি কমতে কমতে বছরে এক ডজনে নেমে আসে। এক সময়ের ৬০ হাজার কর্মীর প্রতিষ্ঠানে ২০১৫ সালে এসে কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজারে। স্বাধীনতার পর থেকে সামরিক শক্তিবৃদ্ধির বদলে ইউক্রেন আসলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকেই বেশি নজর দিয়েছিল, যে কারণে অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে বিশে^র নামকরা এই প্রতিষ্ঠান দুটি।
২০২২ সালের আগ পর্যন্ত ইউক্রেনের ট্যাঙ্কবহরের মেরুদণ্ড হয়ে ছিল টি-৬৪ সিরিজের ট্যাঙ্কগুলো। ১৯৮৪ সালে এই ট্যাঙ্ক সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার পর ২০১৭ সালে এর আধুনিকায়ন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের তথ্য মতে, যুদ্ধ শুরুর আগে কিয়েভের কাছে ৭২০টি টি-৬৪ ট্যাঙ্ক ছিল। এছাড়া রিজার্ভ হিসেবে মজুদ ছিল ৫৮০টি। এর বাইরে ২০০টি টি-৮০ এবং এক ডজন টি-৮০ অপলোট মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক ছিল। মূলত ২০০০ সালের পর থেকে এগুলোই ছিল ইউক্রেনের সর্বাধুনিক ট্যাঙ্ক।
টি-৭২ ট্যাঙ্কেরও বড় একটি বহর রয়েছে ইউক্রেনের। এই ধরনের ট্যাঙ্কের অন্তত ছয়টি সংস্করণ তৈরি করে দেশটি। ক্রমশ এগুলোর কিছু কিছু উন্নতি করা হয়। সব মিলে সাড়ে সাতশ টি-৭২ ছিল ইউক্রেনের। উত্তরাধিকার সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পাওয়া এবং সোভিয়েত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেরা তৈরি করেছিল এসব ট্যাঙ্ক।
২০১৪ সালে ডোনবাস নিয়ে রাশিয়ার সাথে ছায়াযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা দেয়া শুরু করে ন্যাটোভূক্ত পশ্চিমা দেশগুলো। প্রথম দিকে নিরবে দেয়া হলেও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রকাশ্যেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আসতে থাকে দেশটিতে।
যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে শুধুমাত্র সোভিয়েত মডেলের ট্যাঙ্কগুলোই পাঠানো হয় দেশটিতে। কারণ হিসেবে বলা হয়, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সোভিয়েত মডেলের সমরাস্ত্র চালাতে অভিজ্ঞ। এর অংশ হিসেবে শুরুতেই আসে টি-৭২ ট্যাঙ্কের অনেকগুলো চালান।
১৭০টির বেশি টি-৭২ পাঠায় চেকপ্রজাতন্ত্র। ৩১টি পাঠায় উত্তর মেসিডোনিয়া। বুলগেরিয়া থেকে আসা ট্যাঙ্কের সংখ্যা গোপন রাখা হয়। পোল্যান্ড থেকেও আসে আড়াইশোর বেশি ট্যাঙ্ক। স্লোভেনিয়া থেকে আসে কয়েক ডজন। তবে এসব ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি ইউক্রেনের বাহিনী। ফলে কাউন্টার অফেন্সিভের জন্য তারা পশ্চিমাদের কাছে দাবি করে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ট্যাঙ্ক। এক পর্যায়ে ব্রিটেন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আসে উন্নত প্রজারিত মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক।
জার্মানির তৈরি লিওপার্ড ১ ট্যাঙ্ক হাতে পায় ইউক্রেন। জার্মানি ছাড়াও ডেনমার্ক ও নেদাল্যান্ড থেকে দেড় শতাধিক লিওপার্ড ১ দেয়া হয় কিয়েভকে। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি ভলোদিমির জেলেনস্কির দেশ। তারা দাবি করে লিওপার্ড ২ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক।
অনেক দেনদরবারের পর জার্মানি ছাড়াও কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, স্পেন, ও সুইডেন নিজ নিজ অস্ত্রাগার থেকে লিওপার্ড টু ট্যাঙ্ক দেয়ার অঙ্গীকার করে। কোন কোন দেশ ইতোমধ্যে ট্যাঙ্কের চালান পাঠিয়েও দিয়েছে। ব্রিটেন পাঠিয়েছে ১৪টি চ্যালেঞ্জার মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের একটি বহর। জুন মাসে প্রথমবারের মতো এই ট্যাঙ্কগুলো দেখা গেছে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে।এছাড়াযুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে ৩১টি এম-১ আব্রামস ট্যাঙ্ক দেওয়ার।
যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে এই ট্যাঙ্ক দিতে না চাইলেও জার্মানির জিদের কাছে হার মানতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের তৈরি ট্যাঙ্ক ইউক্রেনে না পাঠালে জার্মানিও তাদের লিওপার্ড ২ ট্যাঙ্ক ইউক্রেনে পাঠাবে না বলে স্রেফ জানিয়ে দেয়। চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় ওয়াশিংটন। তবে আগামী শরতের আগে মার্কিন ট্যাঙ্ক ইউক্রেনে পৌছানোর কোন সম্ভাবনা নেই।
সব মিলে ইউক্রেন ন্যাটোর জোটের কাছ থেকে কী পরিমান ট্যাঙ্ক পেয়েছে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এই সংখ্যা আটশোর কাছাকাছি হতে পারে। এর মধ্যে অন্তত ৪৮০টি সোভিয়েত যুগের ট্যাঙ্ক এবং ৩০০টি আধুনিক মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক। এরপরও রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে কাউন্টার অফেন্সিভের শুরুতে আরো ট্যাঙ্ক দাবি করে কিয়েভ।
ইউক্রেন এই যুদ্ধের শুরু থেকে কখনোই নিজেদের কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর প্রকাশ করেনি। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিদিন প্রেসব্রিফিং করে তাদের হামলায় ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব প্রকাশ করে। সংবাদ মাধ্যমগুলো এসব হিসাব নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে না পারলেও যুদ্ধের একটি চিত্র তাতে পাওয়া যাচ্ছে। জুলাই মাসের ১ তারিখে রাশিয়া জানিয়েছে, তারা এই দেড় বছরের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ট্যাঙ্ক, সাজোঁয়া যানসহ ১০ হাজার ৪৩০টি সামরিক যান ধ্বংস করেছে।
জুনের ৪ তারিখে কাউন্টার অফেন্সিভ শুরু হওয়ার পর এই তালিকায় নাম উঠেছে লিওপার্ড ট্যাঙ্ক, ব্রাডলে ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকেলসহ অনেক পশ্চিমাসামরিক যানের। যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংস কিংবা আটক হওয়া এমন অনেক যুদ্ধযানের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। রুশ সামরিক ব্লগাররাও অনেক পশ্চিমা যুদ্ধযানের ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রকাশ করেছে।
জুনের শেষ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এক বক্তৃতায় কাউন্টার অফেন্সিভ প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, কাউন্টর অফেন্সিভ শুরু হওয়ার পর প্রথম চার সপ্তাহে ২৫৯টি ট্যাঙ্ক এবং ৭৮০টি সাজোঁয়া যান হারিয়েছেইউক্রেন। আর এ সবের মধ্যে ছিল অনেকগুলো পশ্চিমা আধুনিক সামরিক যান। অনেক জায়গায় ট্যাঙ্ক ও সাজোঁয়া যান ফেলে ইউক্রেনের সেনাদের পালানোর ঘটনাও ঘটেছে। ইউক্রেনের সেনাদের গুড়িয়ে দেয়ার জন্য পুতিন তার বাহিনীর প্রশংসাও করেছেন।
পশ্চিমা দেশগুলোও এখন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সমরাস্ত্রের অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছে। রুশ বাহিনীর আক্রমণের সামনে তাদের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে সেটি তারা আশা করেনি। ইউক্রেনের বাহিনী বহুল পরিকল্পিত কাউন্টার অফেন্সিভের এক মাস পার করলেও তেমন কোন সফলতা দাবি করতে পারেনি। বরং জুলাই মাসের শুরুতে অন্তত ৫টি ফ্রন্টে রাশিয়ার বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারাও সেকথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী হান্না মালিয়ার নিজেই স্বীকার করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে রুশ বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার কথা।
অবশ্য কিছু জায়গায় পশ্চিমা ট্যাঙ্কবহরের ভালো পারফরম্যান্সও দেখা গেছে। বাখমুতে তারা কিছুটা সফলতা দাবি করেছে। তবে ইউক্রেনে বিশাল যুদ্ধক্ষেত্র এবং রুশ বাহিনীর সফলতার তুলনায় তা সামান্যই।
রাশিয়ার বাহিনীকেও এই যুদ্ধে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে তারা ঠিক কী পরিমাণ ট্যাঙ্ক হারিয়েছে সে তথ্য প্রকাশ করেনি। কিয়েভ দাবি করেছে, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি রুশ ট্যাঙ্ক তারা ধ্বংস করেছে। কিছু বেসরকারি হিসাবে এই যুদ্ধে ২ হাজার রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। যদিও মস্কো এই দাবি প্রত্যাখান করেছে।
জুন মাসের মাঝামাঝিতে ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের কাউন্টার অফেন্সিভের প্রথম দুই সপ্তাহে রাশিয়া ৫৪টি ট্যাঙ্ক হারিয়েছে। যে সময়ে ইউক্রেনের হারিয়েছে ১৬০টি ট্যাঙ্ক ৩৬০টির বেশি সাজোঁয়া যান। তবে এই যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া উভয় দেশের ট্যাঙ্ক বহরের সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই জানা যাবে।