যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমুদ্রপথে যদি বড় পরিসরে যুদ্ধ হয়, তাহলে তা কেমন হতে পারে- সেই ধারণা ও আশঙ্কা থেকে কাছাকাছি একটি আয়োজন করে চীন। সম্প্রতি একটি সিমুলেশন বা যুদ্ধ মহড়ার আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত নৌবাহিনী তাদের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে এলে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌবাহিনীর সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই এই মহড়ার আয়োজন করা হয়।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পিপলস লিবারেশন আর্মির ৯১৪০৪ ইউনিটের গবেষকরা একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে চীনের উদ্ভাবিত নতুন অস্ত্রের সক্ষমতা ও মান যাচাই করেছে। এই ৯১৪০৪ ইউনিটটি মূলত সমুদ্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে থাকে। ইউনিটটি নৌখাতের নতুন সব অস্ত্রেরও পরীক্ষা চালায়। যদি কোনো সমরাস্ত্র থেকে পর্যাপ্ত সার্ভিস না পাওয়া যায়, তাহলে তার ধারাবাহিক উন্নতি করা কিংবা সেই অস্ত্রের পরিবর্তে নতুন অস্ত্রের নকশা করাও এই ইউনিটের উদ্দেশ্য।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট আরও জানায়, এই গবেষকরা জেড-ডে নামের একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ চীনের পিআর-রিভিউড জার্নাল অব শিপ রিসার্চে প্রকাশ করেন। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মহড়ার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে চীনের গবেষকরা ধরে নিয়েছিলেন, চীনা সামরিক বাহিনী আর্লেই বার্ক-ক্লাসের ডেস্ট্রয়ারের সাথে একটি সম্ভাব্য ব্লু অ্যালায়েন্সের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এই যুদ্ধ মহড়ায় পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে ৫০টি ডেস্ট্রয়ার ছিল যেগুলো ১১টি মিসাইল এবং তিনটি টর্পেডো দিয়ে নানাদিক থেকে ক্রমাগতভাবে আক্রমণ করে গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাধারণভাবে পিপলস লিবারেশন আর্মির যুদ্ধজাহাজ যে ধরনের সিগনাল ব্যবহার করে, এবারের মহড়ায় ব্লু অ্যালায়েন্স তার তুলনায় ৩০ গুণ শক্তিশালী জ্যামিং তৈরি করে। অন্যদিকে, চীনের রাডারের রেঞ্জও স্বাভাবিক রেঞ্জের তুলনায় ডিটেকশন মাত্রাও ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়।
এই ধরনের পরিস্থিতি চীনের ডেস্ট্রয়ারগুলোর এয়ার ডিফেন্স সক্ষমতা প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস করে দেয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসকল সারফেস টু এয়ার বা স্যাম মিসাইল এই মহড়ায় অংশ নিয়েছে তার মধ্যে মাত্র অর্ধেক যথাযথভাবে টার্গেটে হিট করতে পেরেছে।
চীনের নৌ বিশেষজ্ঞরা এই মহড়া শেষে তাদের নির্মোহ মূল্যায়নে জানায়, মহড়ার যে ফলাফল বা পরিসংখ্যান তাদের হাতে এসেছে তা অনেকটাই বাস্তবসম্মত। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে মহড়া পরিচালনার মাধ্যমে একটি সামরিক বাহিনী একদিকে যেমন নিজেদের সমরাস্ত্র সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারে তেমনি সংঘাতময় পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের দিক থেকে সম্ভাব্য হুমকিগুলো শনাক্ত করতে পারে। এমনও হয় যে, এ-রকম মহড়া দেখে প্রতিপক্ষ সরাসরি যুদ্ধ করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও সরে আসে। ৯১৪০৪ নম্বর ইউনিটের এই মহড়ার আগে চাইনিজ ইউনিভার্সিটি আরেকটি মহড়া চালিয়েছিল যেখানে চীনের পারদর্শিতা অনেকক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
এশিয়া টাইমস ২০২৩ সালের মে মাসে এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, চীনের নর্থ ইউনিভার্সিটির গবেষকরা আরেকটি যুদ্ধ মহড়া চালিয়েছিল, যেখানে একটি ইউএস ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের ওপর চীনা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই মহড়ায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যেখানে ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড সুপার ক্যারিয়ার এবং এর এসকর্টগুলি বারবার সতর্ক করার পরও বেপরোয়াভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন-নিয়ন্ত্রিত একটি দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসে। সেই পরিস্থিতিতে, চীন তিনটি ওয়েভে ২৪টি হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে আক্রমণ করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড, ইউএসএস সান জ্যাকিন্টো টিকন্ডেরোগা-ক্লাস ক্রুজার এবং চারটি আরলে বার্ক ফ্লাইট আইআইএ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
এর মধ্যে প্রথম ওয়েভের মিসাইলটি মার্কিন বহরের টু সিক্সটি ফোর ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করে দেয় এবং ইউএসএস সান জাকিন্টোকেও ডুবিয়ে দেয়। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ওয়েভটি ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডকে ডুবিয়ে দেয়। আর শেষ তরঙ্গটি আরলে বার্ক ডেস্ট্রয়ারদের ধ্বংস করে দিয়েছিল।
নর্থ ইউনিভার্সিটি অফ চায়না এই মহড়ার মাধ্যমে সমুদ্র-ভিত্তিক নজরদারি, টহল মিশন এবং লক্ষ্য শনাক্ত করার গুরুত্ব প্রদান করে। একইসঙ্গে এমন কৌশল অবলম্বনের জন্যেও তাগিদ দেয় যাতে করে মিসাইলের সংখ্যা অক্ষুণ্ন রাখা যায় এবং ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের সংখ্যাও কমিয়ে নিয়ে আসা যায়।
এর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের সাথে এ-ধরনের একটি যুদ্ধসৃদশ সিমুলেশন বা মহড়া পরিচালনা করে। এই সিমুলেশনে ফলাফল স্বাভাবিকভাবে আমেরিকার পক্ষেই যায়। তবে এই ধারণা পাওয়া গেছে এ অঞ্চলে এ ধরনের কোনো যুদ্ধ বেঁধে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। এই অর্থের পরিমাণ এতটাই বেশি যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তা বহন করাও বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, সিএসআইএস একটি সিমুলেশন পরিচালনা করেছিল। যেখানে পরিস্থিতিটি এমন ছিল, যদি চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন চালায় সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভূমিকা কেমন হবে? এতে ফলাফল আসে যে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চীনকে দমন করতে পারবে তবে সে জন্য তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে।
সিমুলেশনে আরও দেখা যায়, মার্কিনীদের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক ফলাফলও যদি আসে তাতেও যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান যৌথভাবে ৪৪৯টি যুদ্ধবিমান এবং ৪৩টি জাহাজ হারাবে। যার মধ্যে দুটি বিমানবাহী রণতরীও রয়েছে। পাশাপাশি, আমেরিকার ৬ হাজার ৯৬০ জন কর্মী এবং ৩ হাজার ২০০ জন সেনা নিহত হবে।
তাইওয়ানের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ বিমান আছে তারও অর্ধেক সংখ্যক বিমান ধ্বংস হয়ে যাবে। পাশাপাশি, ২২টি জাহাজ এবং ৩,৫০০ পদাতিক সেনাও তাদেরকে হারাতে হবে। সিমুলেশন বলছে, প্রতি তিনজনে একজন তাইওয়ানিজ সেনা এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, চীনের ১৩৮টি জাহাজ, ১৫৫টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হবে এবং ৫২ হাজার সেনা নিহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই মহড়ায় চীনের ৭ হাজার পদাতিক সেনাও নিহত হওয়ার চিত্র উঠে আসে। গড়ে প্রতি তিনজনে একজন পদাতিক সেনা এই যুদ্ধে নিহত হবে। নৌসেনা নিহত হয়েছে ১৫ হাজার। আবার তাইওয়ান ল্যান্ডিং ফোর্সের ৩০ হাজার সেনা যদি যুদ্ধবন্দি হয় তাহলে এরও অর্ধেককেও হয়তো হারাতে হবে চীনকে। সিমুলেশনে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমত চীনের রশদ সরবরাহের মাত্রা কমাতে হবে। তাইওয়ানকেও চীনের সমুদ্র সৈকত ধরে পাল্টাআক্রমণ জারি রাখতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে, ইউক্রেন আর তাইওয়ানের বাস্তবতা এক নয়। চীনের পক্ষে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাইওয়ানকে টানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস অবরোধ করে রাখা কঠিন নয়। এর বিপরীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সরবরাহ লাইন ধরে রাখতেই হয়তো বেগ পেতে হতে পারে।
চীনের সাথে নৌযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই জাপানের ঘাঁটি পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। কেননা, তাইওয়ানের আশপাশে মার্কিন অভিযান পরিচালনায় এই ঘাঁটিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার অ্যান্টি-অ্যাক্সেস এরিয়া ডিনায়াল বাবলের বাইরে থেকে চীনের যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাইওয়ানের হাতে সর্বাধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি থাকায় হয়তো ভূমির সুরক্ষায় তাইওয়ান কিছুটা সুবিধা পাবে তবে এতে যুদ্ধের ফলাফলে আহামরি কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে এশিয়া টাইমস জানায়, মার্কিন বিমান বাহিনীর ওয়ার ফাইটিং ইন্টেগরেশন ক্যাপাবিলিটি অফিস এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান র্যান্ডও তাইওয়ান সংঘাতের একটি সিমুলেশন পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, এ যুদ্ধে গুচ্ছ ড্রোনের একটি কার্যকরী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সিমুলেশনে যে গুচ্ছ ড্রোনগুলো মোতায়েন করা হয়েছিল তা কার্যকারিতার দিক থেকে ছিল স্বায়ত্তশাসিত। ড্রোনগুলো নিজেদের মধ্যে ফ্লাইট ও ডাটাগুলো সফলভাবে বিনিময় করেছে। গুচ্ছ ড্রোনগুলো মানুষ-চালিত মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-টুয়েন্টি টু বা এফ-থার্র্টি ফাইভের জন্য একটি ডেকয় স্ক্রীন তৈরি করেছিল। এতে করে যুদ্ধবিমানগুলোর সেন্সরের রেঞ্জ বেড়ে গিয়েছিল আর সেন্সরের সাইলেন্সও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল।
মানুষ-চালিত যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য প্লাটফর্মের পরিস্থিতিগত সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং টার্গেট নির্ধারণের সক্ষমতাও বেড়ে যায়। বিভিন্ন উৎস থেকে আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষের রাডারকে ব্যস্ত রাখা হয়। একইসাথে, প্রতিপক্ষের মিসাইলগুলো খরচ হয়ে যায়। এ সুযোগ নিয়ে মনুষ্যচালিত বিমানের চূড়ান্ত কিলিং মিশনগুলো নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে পারে। মেশিন লার্নিং বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় গুচ্ছ ড্রোনগুলো এখন একাধিক অ্যাংগেল থেকে টার্গেটে আঘাত হানতে পারে। এরপরও বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, গুচ্ছ ড্রোনগুলো সম্ভাব্য তাইওয়ান সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরকে অনেকটা সুবিধা দিলেও লোকসান কমাতে পারবে না।