যুদ্ধবিমান নির্মাণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে টানাপড়েন ক্রমাগত বাড়ছেই। চীন ও রাশিয়া এরইমধ্যে তাদের নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের বিমান তৈরি নিয়ে কার্যক্রম জোরদার করেছে। এর বিপরীতে স্বাভাবিকভাবেই এখন যুক্তরাষ্ট্রকেও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। চলতি মাসেই এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিশেল ইন্সটিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজ মার্কিন সার্ভিস এবং পেন্টাগনকে অনুরোধ করেছে যাতে দেশটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যেসব ক্রেতারাষ্ট্র এই বিমানের অর্ডার দিয়েছেন তাদেরকে যেন বিমানটি পাওয়ার জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করতে না হয়।
এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রথম তৈরি হওয়ার পর মার্কিন বিমান বাহিনী প্রথম অর্ডার করে ১১০টি এফ-৩৫ বিমানের। এরপর থেকে প্রতি বছর অর্ডারের পরিমাণ কমতে থাকে, প্রথমে ৮০, এরপর ৬০ এরপর ৪৮ এভাবে সংখ্যা কমতেই থাকে। ইতোমধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন এফ-৩৫ জয়েন্ট প্রোডাকশন অফিস, জেপিও-র সাথে ১৮ এবং ১৯টি লট নির্মাণের জন্য একটি সমঝোতায় আসে।
এ ধরনের প্রতিটি লটে ১৫৬টি এয়াক্রাফট থাকে। লকহিড মার্টিন দাবি করছে, বাড়তি কিছু সম্পদ ও উপকরণ ব্যবহার করে তারা বছরে এফ-৩৫-এর নির্মাণ সর্বোচ্চ ২২০টিতে উন্নীত করতে পারে। এই প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, মার্কিন এয়ারফোর্স একুইজিশন চিফ এন্ড্রিউ হান্টার সিনেটের আর্মড সার্ভিস কমিটিকে জানিয়েছেন, বছরে ১৫৬টি যুদ্ধবিমান নির্মাণ করতে গেলে লকহিড মার্টিনকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
এই নির্মাণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হলে লকহিড মার্টিনকে নতুন নতুন উপকরণ যোগ করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে দক্ষ শ্রমিক। প্রয়োজনীয় উপকরণ বা দক্ষ শ্রমিক- দুটোই জোগাড় করা বেশ কষ্টসাধ্য। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বিমানের চালান দিতে লকহিড মার্টিনের দেরি হয়েছে, কারণ তাদের কাছে প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি ছিল। কোভিড মহামারির কারণে কোম্পানিটি এই সংকটে পড়ে।
এয়ার অ্যান্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন আরো জানায়, এফ-৩৫ প্রকল্পের বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু উপকরণ নির্মাণের জন্য তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার দায়ে ২০১৯ সালে তুরস্ককে এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই হোঁচট খাওয়ার পরও জার্মানির প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান রেইনমেটাল জানায়, তারা এফ-৩৫ বিমানের বাহ্যিক কাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে নর্থ রাইনে-ওয়েস্টফালিয়ার উইজে একটি অত্যাধুনিক কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে।
জার্মান প্রতিষ্ঠান রেইনমেটাল জানায়, ২০২৫ সাল থেকেই নরথ্রুপ গ্রুম্যান এবং লকহিড মার্টিনের সাথে মিলে যৌথভাবে ৪০০টি এফ-৩৫ বিমানের কাঠামো নির্মাণ শুরু করবে। বিশাল এই নির্মানযজ্ঞ এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান যতটা অত্যাধুনিক, উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে তেমনটা হয়নি। এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কারণ, এর সফটওয়্যারগুলো জটিল এবং এর ইঞ্জিনেও অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। একটি মিশনে উড়ে যাওয়ার পর এফ-৩৫ বিমানটিকে আবার উড্ডয়ন করাতে হলে কিংবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে হলে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য তিনদিন সময় লাগে। পুরনো বিমানগুলোর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান একদিনে তিন থেকে পাঁচটি মিশনের জন্য উড়ে যেতে পারে। গত মে মাসে ডিফেন্স ওয়ান প্রতিবেদনে জানায়, সুরেলা অনুরণনের কারণে গত ডিসেম্বরেও একটি এফ-৩৫ বিমান ধসের ঘটনা ঘটে। এই ক্র্যাশের ফলে জেটের জ্বালানি টিউব ভেঙে গিয়েছিল। একটি ব্যান্ড-এইড ফিক্স ‘অরিফিস’ হিসাবে এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে হারমোনিক অনুরণনের কারণে যদি জ্বালানি টিউব ফেটেও যায়, তাহলেও ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষতির প্রভাব অনেকটাই হ্রাস করা যায়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, পেন্টাগন এরইমধ্যে এফ-৩৫-এর ইঞ্জিন এবং এফ ওয়ান থার্টি ফাইভের ইঞ্জিন নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এই বাস্তবতায় এ মুহূর্তে ডিউটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এ-রকম এফ-৩৫ বিমানের সংখ্যা ৭০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিকে মিশনে যাওয়ার মতো সক্ষম অবস্থায় রয়েছে মাত্র ৫৬ শতাংশ বিমান।
২০২১ অর্থবছরের শেষেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রায় ৮০০টি এফ-৩৫ বিমানের সংকট ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি প্রতিকারের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। অথচ তেমনটা হয়নি। ফলে মার্কিন মিত্র দেশগুলো যখন বিমান ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদান করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাছে প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র তখন বিদ্যমান বিমানগুলো চালু রাখতেই হিমশিম খাচ্ছিল। এছাড়া এফ-৩৫ বিমান বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধসেরও শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই এফ-৩৫-এর যতগুলো ভেরিয়্যান্ট ছিল, সবগুলোই অন্তত একবার বিধ্বস্ত হয়েছে।
এফ-৩৫ বিমানগুলোতে থাকা ব্ল্যাক বক্স নিয়ে আছে জটিলতা। এগুলোর হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার এতটাই জটিলভাবে তৈরি করা হয়েছে, ব্যবহারকারীরা সহজে এর ভেতর প্রবেশ করতে পারে না কিংবা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতেও পারে না। সম্ভবত এমনটা করা হয়েছিল এই উদ্দেশ্য নিয়ে যাতে ক্রেতা রাষ্ট্রগুলো বরাবরই বিমানগুলো ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে।
এফ-৩৫ নিয়ে নানা ধরনের জটিলতার মধ্যে চীন এবং রাশিয়া তাদের নিজ নিজ পঞ্চম- প্রজন্মের ফাইটার কর্মসূচিতেও ব্যাপক অগ্রগতি করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে যদি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে হয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে এফ-৩৫ বিমানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।
চীন উন্নত ডব্লিউএস-১৫ ইঞ্জিন যুক্ত করে জে-২০ স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরি করছে, যা রাশিয়া বা চীনের পূর্ববর্তী সবগুলো মডেলকে শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে পেছনে ফেলে দেবে। এখনো পর্যন্ত ডব্লিউএস-১৫-এর কার্যকারিতা স্পষ্ট হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের এফ-২২ র্যাপটর বিমানগুলোতে যে প্র্যাট ও হুইটনি এফ ওয়ানওয়ান নাইন ইঞ্জিন ব্যবহার করে, চীনের ডব্লিউএস-১৫ ইঞ্জিনটিও কাছাকাছি মানের কোনো ইঞ্জিন হবে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়া টাইমস জানায়, চীন পালসড প্রোডাকশন লাইন ব্যবহার করে জে-২০ বিমানের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। চীন উৎপাদনের টেকনিকে যেমন আধুনিকতা নিয়ে এসেছে, একইসাথে দেশে তৈরি ইঞ্জিনগুলোও উন্নত করছে। জে-২০ বিমানগুলো যাতে এফ-২২ বিমানের সমকক্ষ হতে পারে এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে এফ-২২-কে ছাপিয়েও যেতে পারে, তার জন্য চীন চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৮৭টি এফ-২২ বিমান তৈরির পর এই বিমানগুলোর উৎপাদন ২০১১ সালে বন্ধ করে দেয়।
২০২২ সালের এয়ারশোতে জে-২০ বিমানের যে সিরিয়ালগুলো দেখা গেছে, তা হিসেব করে ধারনা করা যায়, চীনের হাতে এরইমধ্যে ২০০টিরও বেশি জে-২০ বিমান পুরোপুরি প্রস্তুত অবস্থায় চলে এসেছে। ডিফেন্স পোস্ট গত এপ্রিলে রিপোর্ট করেছে, রোস্টেক কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রাসেলেক্ট্রনিক্স আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ রেডিও সিস্টেম তৈরি করেছে, যাতে নতুন কিছু রেডিও প্রযুক্তি যেমন নয়েজ-প্রতিরোধক কোডিং, উন্নত ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং রিয়েল-টাইম সিগন্যালের মতো প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে এসইউ-৫৭-এর সক্রিয়তা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাশিয়ার এসইউ-৫৭-এর আপগ্রেড যুদ্ধ বিমানটিকে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ, সংযোগের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং আকাশ ও স্থল ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগের প্রক্রিয়া উন্নত করার সক্ষমতা প্রদান করে। অতি সম্প্রতি এসইউ ৫৭-কে ষষ্ঠ প্রজন্মের ইঞ্জিন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। নতুন এই আপগ্রেডেশনে এই বিমানে নজেল যুক্ত করা হয়েছে আর একইসাথে বিমানের পারদর্শিতা এবং স্টেলথ কাঠামোও মজবুত করেছে।
জে-২০ এবং এসইউ-৫৭ এই দুটো যুদ্ধবিমানকেই সাউথ চায়না সি এবং ইউক্রেন যুদ্ধে দেখা গেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। জে-২০ বিমানগুলো পেট্রোল মিশনে অংশ নিয়েছে আর এসইউ-৫৭ বিমানগুলোকে শত্রুপক্ষের এয়ার ডিফেন্স মিশনকে অকার্যকর করার উদ্দেশ্য নিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।
এর আগে এশিয়া টাইমস জানিয়েছিল, চীন ও রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলোর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা মোকাবিলার অংশ হিসেবে যুত্তরাষ্ট্রকেও প্রতিবছর অন্তত ৭২টি যুদ্ধবিমান নির্মাণ করতেই হবে। একইসঙ্গে মিত্রদেশগুলোকেও একটি সক্ষম অবস্থায় রাখতে হবে। প্রতিটি মিত্রদেশের কাছে যাতে এফ-২২ সিরিজ, এফ-৩৫ সিরিজ, এফ-১৫ ইএক্স সিরিজ, এফ-১৬ সিরিজ এবং এ-১০ সিরিজের বিমানগুলো থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও এই বিমানগুলোর নিয়মিত উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে।