ইউরোপে মোতায়েন মার্কিন সেনাসংখ্যা কমিয়ে আনার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একপক্ষ বলছে, ইউক্রেন-যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে রাশিয়া। ন্যাটোর ওপর তাদের হামলার আশঙ্কা আর আগের মতো নেই। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ইউরোপে মোতায়েন সেনা সংখ্যা কমিয়ে এনে চীনের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া। তবে অন্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা কমালে সেটা ন্যাটোর শক্তিবৃদ্ধির পরিকল্পনা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক পরিকল্পনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের যুক্তি হলো- ইউক্রেন-যুদ্ধ পরিস্থিতি যেদিকেই যাক, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ইউরোপে সেনা কমানো যুক্তরাষ্ট্রের মোটেই উচিত হবে না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। তাদের সেনা হতাহত হয়েছে প্রায় লাখের মতো। এর মধ্যে আছে রাশিয়ার দক্ষ কিছু ইউনিট। সম্প্রতি মোকাবেলা করতে হয়েছে প্রিগোজিনের ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহ প্রচেষ্টা। এখন চলছে ইউক্রেনের পাল্টা অভিযান। পশ্চিমারা দাবি করছে, ইউক্রেনের এই অভিযান ধীরে ধীরে অগ্রগতি করছে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এই শক্তি ক্ষয়ের কারণে কমে গেছে ন্যাটোর জোটের উপর রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ইউরোপ থেকে সেনা সংখ্যা কমিয়ে চীনা হুমকির দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া।
অন্য কিছু বিশ্লেষক বলছেন, আরও তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপে মার্কিন উপস্থিতির দরকার পড়বে। এর তিনটি কারণ রয়েছে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ন্যাটোকে দেওয়া মার্কিন প্রতিশ্রুতি রক্ষা। তৃতীয় কারণ হলো অংশীদার দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া। কারণ, এই মিত্র দেশগুলোকে ভবিষ্যতে বড় দায়িত্ব নিতে হবে।
এক দশক আগে ইউরোপে মার্কিন সেনার সংখ্যা কমে ৬০ হাজারে নেমে আসে। শীতল যুদ্ধকালীন সময়ে যে পরিমাণ সেনা মোতায়েন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, সেই তুলনায় এটা অনেক কম। শীতল যুদ্ধের সময় শুধু জার্মানিতেই দুই লাখ ৮৫ হাজার সেনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তবে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিত্ররা ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলের ফ্রন্টে সেনা সংখ্যা বাড়িয়েছে। অন্যান্য ইউনিটের সাথে মার্কিন সেনাবাহিনী পোল্যান্ডে একটি রোটেশনাল সাঁজোয়া ব্রিগেড, এবং একটি কমব্যাট অ্যাভিয়েশান ব্রিগেডের অংশবিশেষ মোতায়েন রেখেছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে আরও ২০ হাজার সেনা পাঠায়। এর মধ্যে আরও দুটো রোটেশনাল ব্রিগেড কমব্যাট টিম রয়েছে। আরেকটি ডিভিশন সদর দপ্তরও বসানো হয়েছে। মার্কিন ইউরোপিয়ান কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ক্রিস ক্যাভোলি সম্প্রতি এই সেনা সংখ্যা বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ওয়েস্টার্ন মিলিটারি ডিস্ট্রিক্টে রাশিয়ার যে স্থল সেনা রয়েছে, সেটা আঞ্চলিক সামরিক বাহিনী ও ন্যাটোর সেনাদের চেয়ে বেশি। এ কারণে, রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসন মোকাবিলায় বাড়তি মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
রাশিয়ার মোকাবিলা করার জন্য অতিরিক্ত মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হলেও তাদের আরও কিছু দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইউক্রেন যাতে ঠিক মতো মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তা পেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণের দিক। ইউক্রেন পাল্টা অভিযান শুরুর পর কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন কিয়েভকে দেওয়া সহায়তার মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে। তাদের মতে, ওয়াগনার বিদ্রোহ রাশিয়ার দুর্বলতাকে প্রমাণ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যুদ্ধ বহু মাস এমনকি বহু বছর দীর্ঘায়িত হতে পারে। ইউক্রেনের সামরিক অগ্রগতি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে কারণে তাদের সামরিক বিজয় লাভের আগ পর্যন্ত ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তুতি থাকা উচিত, যাতে তারা ইউক্রেনীয় সেনাদেরকে সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে পারে।
ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর দ্বিতীয় কাজ হলো সংকট মোকাবেলা। বিশ্বের সব জায়গাতেই এই দায়িত্ব আছে তাদের। ইউরোপে স্থায়ীভাবে যে দুটে ব্রিগেট কমব্যাট টিম মোতায়েন করা আছে, তার একটি হলো ১৭৩তম এয়ারবর্ন ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের দায়িত্বই হলো ইউরোপ, আফ্রিকা, এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংকটকালীন সময়ে ভূমিকা রাখা। ইউরোপে সেনাসংখ্যা কমিয়ে আনলে এই ধরনের মিশন বাধাগ্রস্ত হবে। এই মিশনের অন্যতম কাজ হলো সংকটকালে বেসামরিক জনতাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া। এই ধরনের মিশনের জন্য সবসময় দ্রুত সেনা মোতায়েনের দরকার হয়।
ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর তৃতীয় কাজ হলো, ফ্রন্টলাইন দেশগুলোকে সেনা দিয়ে সাহায্য করা। গত বছর রাশিয়ার অভিযানের প্রেক্ষিতে ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রোমেনিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, ও শ্লোভাকিয়ায় নতুন বাহিনী পাঠানো হবে। ন্যাটো জোট ভাবছে, ব্যাটালিয়ন গঠন না করে তারা ব্রিগেড গঠন করবে। লিথুয়ানিয়াতে ঠিক এটাই করেছে জার্মানি ।
চলমান যুদ্ধের কিছু অনিশ্চয়তাও আছে। পোল্যান্ডে ভুল করে ইউক্রেন যে মিসাইল ফেলেছিল, তখনই তা বোঝা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ন্যাশনাল ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজিতে মিত্র ও অংশীদারদের ওপর জোর দিয়েছে। এখন যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে তারা গরিমসি করে, তাহলে এই দেশগুলোও সম্মিলিত ন্যাটো মিশনে সেনা দিয়ে সহায়তা করার ক্ষেত্রে উৎসাহ হারাবে। ন্যাটোর অন্য দেশগুলো সেনা পাঠাক বা না পাঠাক, ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইউরোপের বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে।
মার্কিন সেনার উপস্থিতি ইউরোপে আরেকটি ভূমিকা রাখবে। তা হলো সার্বিকভাবে ইউরোপের শক্তিকে শক্তিশালী করবে। মার্কিন সেনার উপস্থিতি ইউরোপীয় বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। পোল্যান্ডে আব্রামস ট্যাঙ্ক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে সেটা দেখা গেছে। বহুজাতিক মহড়ায় মার্কিন ইউনিটগুলো অংশ নেয়ার সময়েও সেটা বোঝা গেছে। ন্যাটোর লক্ষ্য যদি হয় ইউরোপীয় মিত্রদের সাথে দায়িত্ব ভাগাভাগি করা, তাহলে মার্কিন সেনা সংখ্যা কমালে তা ব্যাহত হবে। কারণ তাদের অনুপস্থিতিতে ইউরোপীয়দের শক্তি অর্জনের প্রক্রিয়া শিথিল হয়ে যাবে।
ইউরোপে মার্কিন সেনার উপস্থিতির আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা আছে। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের যত সংখ্যক সেনা থাকবে, ন্যাটোর উপর মার্কিন প্রভাব ঠিক ততটাই হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তাকে বাদ দিয়ে ন্যাটো সমন্বিত কোন সামরিক নীতি বা পরিকল্পনা নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের অবদানের মাত্রা কমিয়ে আনতে চায়, তাহলে ইউরোপীয় মিত্রদেরকে তারা যে বার্তা দিয়েছে, সেটারও গুরুত্ব থাকবে না। ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মিত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের যৌক্তিক দিকও আছে। ইউরোপে জোরালো মার্কিন উপস্থিতি থাকার অর্থ হলো অন্যান্য ন্যাটো দেশগুলোতে তাদের উপর নির্ভর করে পার পেতে চাইবে। এই যুক্তি অনুযায়ী, মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি যতটা জোরালো হবে, ইউরোপীয়রা তাদের প্রতিরক্ষায় বিনিয়োগ তত কম করবে।
মার্কিন বাহিনী পুরোপুরি সরে গেলে ইউরোপীয় দেশগুলো কী করবে, সেটা স্পষ্ট নয়। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি সেটা যাচাই করতে যায়, তাহলে ঝুঁকি হবে অনেক বেশি। এটা স্পষ্ট যে, বহু ইউরোপীয় দেশ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেও মার্কিন বাহিনীর শূণ্যতা পূরণ করতে পারবে না। আর সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে ইউরোপীয়দের সামরিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্য আরেকটি বিষয় তুলনা করে দেখতে হবে। ইউরোপ থেকে সেনা কমালে তাদের কি লাভ হবে। আর সেনা বহাল রাখলে কতটা ব্যায় বহন করতে হবে।
যারা সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে, তারাও স্বীকার করেন, ইউরোপে সেনা মোতায়েনের ব্যায় কম। মিলিয়নের অঙ্কেই ব্যায়টা চলে যায়, বিলিয়নে যেতে হয় না। এছাড়া ইউরোপে যাদের মোতায়েন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে হালকা পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনী প্রধান। এরা চীনের ফ্রন্টিয়ারে খুব বেশি কাজে আসবে না। কারণ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো নৌ ও বিমান শক্তি। সেনা হ্রাসের পক্ষের লোকেরা বলছেন, ইউরোপে দীর্ঘমেয়াদি মোতায়েনের কারণে চীনা ফ্রন্টিয়ারের জন্য দরকারি অস্ত্র সরঞ্জাম কেনা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেনা কমাতে চাইলে তাদের স্পষ্ট করা উচিত ঠিক কোন জায়গা থেকে তারা শক্তি কমাতে চাচ্ছে। ইউক্রেনকে দেয়া সহায়তা, সংকটকালীন অভিযান, ফ্রন্টলাইন রাষ্ট্রগুলোকে দেয়া মার্কিন প্রতিশ্রুতির দিক আছে। ন্যাটো মিত্রদেরকে দেয়া প্রশিক্ষণ ও মহড়া - এগুলোর মধ্যে ঠিক কোন জায়গায় তারা সেনাবল কমাবে।
এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে মিত্র দেশগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাবে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ইউরোপে সেনা বহাল রাখাটাই বরং শেষ বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক হবে। ইউক্রেন যতক্ষণ যুদ্ধে আছে, ততক্ষণ অন্তত ইউরোপে মার্কিন সেনার উপস্থিতি কমানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের গতি যেদিকেই যাক, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত সেনা সংখ্যা কমানো যুক্তরাষ্ট্রের মোটেই উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন তারা।