পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে নানাভাবে সাহায্য করছে তাদের প্রধান মিত্র চীন। চীনের কাছ থেকে অ্যাটাক সাবমেরিন ও অত্যাধুনিক ফ্রিগেট নিচ্ছে পাকিস্তান নৌবাহিনী। এগুলোর অনেকগুলোই এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলোও ধারাবাহিকভাবে বহরে যুক্ত হবে। এসব অত্যাধুনিক জাহাজ পাকিস্তানের নৌবাহিনীর শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং সমুদ্রসীমায় দূর-দূরান্তে স্থায়ী টহল ও অভিযানে অংশ নেওয়ার সক্ষমতাও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন তাদের কৌশলগত স্বার্থেই পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল পরিবহনের পথকে তারা নিরাপদ রাখতে চায়। কিছু বিশ্লেষক এটাও বলেছেন যে, পাকিস্তানের নৌশক্তি এই মুহূর্তে ভারতের সমপর্যায়ের না হলেও, আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া জারি থাকলে শিগগিরই ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে উঠে আসবে পাকিস্তানের নৌবাহিনী।
গত এক দশকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্যের বিষয়টি খবরের শিরোনাম হয়েছে নানাভাবে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর উন্নয়নে কতটা এগিয়েছে, সে দিকে খুব একটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি। বিস্ময়ের ব্যপার হলো, দারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কট আর রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও ইসলামাবাদ তাদের নৌবাহিনীর বহরের উন্নতির কাজ চালিয়ে গেছে। তাদের নৌবাহিনীর এই উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকায়নে বেইজিং বরাবরাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে পাক নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তারা সহায়তা করছে। তাদের প্রত্যাশা, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন কোন নিরাপত্তা সঙ্কটের মুখে পড়লে পাকিস্তানের নৌবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করবে। একই সাথে ভারত মহাসাগরে চীন তাদের নিজেদের নৌ-উপস্থিতিও বাড়িয়েছে। দেশের বাইরে হর্ন অব আফ্রিকার জিবুতিতে প্রথম সামরিক পোস্ট গড়ে তুলেছে বেইজিং। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সামরিক সহযোগিতা ছিল, গত দুই দশকে তার মনোযোগ নৌশক্তির উন্নয়নের দিকে সরে গেছে।
পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে চীনের কাছ থেকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত নৌযান কিনে আসছে। ২০১৬ সালে তারা চীনের সাথে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তির অধীনে চীনের কাছ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ইউয়ান শ্রেণির ০৩৯/০৪১ টাইপের ডিজেল সাবমেরিন পাবে পাকিস্তান। চীনের কাছ থেকে এই ধরনের আটটি সাবমেরিন নিচ্ছে পাকিস্তান। এর মধ্যে চারটি তারা পাবে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ। প্রথম চারটি সাবমেরিন তৈরি করছে চায়না শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশান। বাকি চারটি তৈরি হবে পাকিস্তানে। করাচি শিপইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস এগুলো তৈরি করবে। পাকিস্তানে এগুলো তৈরির অর্থ হলো, তাদের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে।
চীনা এই সাবমেরিনগুলোতে অ্যাডভান্সড সেন্সর আর আধুনিক অস্ত্রপাতি যুক্ত আছে। এগুলো হাতে পেলে কৌশলগত ক্ষমতার ভারসাম্য কিছুটা পাকিস্তাানের দিকে ঝুঁকে যাবে। পাকিস্তান নৌবাহিনী জলসীমার জন্য যে আক্রমণাত্মক কৌশল অনুসরণ করে, এই ডিজেল অ্যাটাক সাবমেরিনগুলো তার সাথে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাকিস্তানের এই কৌশল অনুসারে নৌযুদ্ধের ক্ষেত্রে সাবমেরিন এবং মিসাইলবাহী নৌটহল বিমানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
পাকিস্তান তাদের সাগরপৃষ্ঠে বিচরণশীল বহরেরও সম্প্রসারণ করছে। তারা বহরে যুক্ত করেছে জুলফিকার-শ্রেণির ফ্রিগেট। এই শ্রেণির ফ্রিগেটগুলো মূলত চীনের ০৫৩এইচ৩ টাইপের নৌযান। এই জাহাজগুলোকে সাবমেরিনবিরোধী যুদ্ধসহ আরও নানা কাজে ব্যবহার করা যায়। সাগরপৃষ্ঠের যুদ্ধের জন্য এগুলোতে ওয়াইজে-৮২ মিসাইল যেমন যুক্ত আছে, তেমনি আত্মরক্ষার জন্য এই জাহাজগুলোতে রয়েছে এফএম-৯০এন স্বল্পপাল্লার সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান নৌবাহিনী তাদের সবচেয়ে অত্যাধুনিক নৌযান বহরে যুক্ত করে। এটা হলো গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট তুগরিল। তুগরিল হলো শক্তিশালী ০৫৪এ পি টাইপের ফ্রিগেট। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য এই ফ্রিগেটগুলো তৈরি করা হচ্ছে সাংহাইতে। এই টাইপের মোট চারটি ফ্রিগেট পাবে পাকিস্তান। এই ফ্রিগেটগুলোতে সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং সুপারসনিক সার্ফেস-টু-সার্ফেস মিসাইল যুক্ত থাকবে। বহুমুখী এই যুদ্ধজাহাজগুলো বিভিন্ন ধরনের অভিযানে অংশ নিতে পারবে। এই শ্রেণির দ্বিতীয় জাহাজ তৈমুর নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয় ২০২২ সালের জুনে।
আগামীতে পাকিস্তান তাদের নৌবাহিনীর বহরে এই ধরনের ফ্রিগেট আরও দুটো যুক্ত করবে। নৌবাহিনীর দৃষ্টিতে এই যুদ্ধজাহাজগুলো তাদের শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এই জাহাজগুলোতে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা গেছে বলে খবর প্র্রকাশ হয়েছে। তুগরিল-শ্রেণির ফ্রিগেট যদিও পাকিস্তানের ভাসমান বহরের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু ভারতীয় নৌশক্তির মোকাবেলায় এই জাহাজ দিয়ে যথেষ্ট প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা যাবে না বলে মনে করেন কিছু বিশ্লেষক।
ভারতীয় নৌবাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেশি এবং তাদের কিছু বারতি সুবিধা আছে। তবু, ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, নয়াদিল্লীর উচিত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাকিস্তানের বিবর্তনশীল নৌশক্তির দিকে গভীর নজর রাখা। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে অত্যাধুনিক এই ফ্রিগেট যুক্ত হওয়ার কারণে তারা বহু দূরের জলসীমায় তৎপরতা চালাতে পারবে। পূর্ব চীন সাগরে চীনের নৌবাহিনীর সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়ে তারা তাদের এই সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছে। চলতি বছরেই এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চীনের বাইরে পাকিস্তানের নৌবহরের আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তুরস্ক । ২০১৮ সালে পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির অধীনে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য চারটি মিলজেম শ্রেণির করভেট তৈরি করবে তুরস্ক। এই করভেট জাহাজগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে তুরস্কের আদা শ্রেণির জাহাজের আদলে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাকিস্তানকে চারটি জাহাজ হস্তান্তর করবে তুরস্ক।
পাকিস্তান যে ভাবে ধারাবাহিকভাবে তাদের নৌবাহিনীর বহরে উচ্ছ ক্ষমতার জাহাজ যুক্ত করে চলেছে, তাতে বোঝা যায় এই অঞ্চলের জলসীমায় তারা তাদের শক্তির প্রদর্শণী করতে চায়। নৌবাহিনীর শক্তির ভারসাম্য না থাকলে সেটা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে। এছাড়া পাকিস্তান প্রথমবারের মতো যে নৌ-নীতিমালা গ্রহণ করেছে, সেটিও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এই নীতিমালার মূল প্রতিপাদ্য হলো প্রিজারভিং ফ্রিডম অব সিজ, বা সাগরের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
পাকিস্তানের নৌসীমার কৌশল সময়ের সাথে সাথে বদলেছে। আক্রমণাত্মক নীতি থেকে তারা এখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থায়ীভাবে টিকে থাকার কৌশল গ্রহণ করেছে। চীন তাদের নৌবাহিনীর জন্য যে জে-১০ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করে, পাকিস্তান নৌবাহিনীও আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে নৌ-অভিযান চালানোর জন্য এই বিমান ব্যবহার করতে পারে। এই জঙ্গি বিমানগুলো জাহাজ-বিধ্বংসী মিসাইল বহন করতে পারে। এগুলো হাতে পেলে পাকিস্তান নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও বড় সক্ষমতা অর্জন করবে।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং গোয়াদর বন্দরের উন্নয়নকে শুধু বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে সাগর পথের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য চীন-পাকিস্তান সহযোগিতার অংশ হিসেবে দেখা উচিত হবে না। বরং একইসাথে সেটা ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতিকে সহায়তা করবে।
গোয়াদরে আধুনিক নৌঘাঁটি থাকলে সাগরপথে টহল দেওয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌটহলের উপর নজর রাখা চীনের জন্য সহজ হয়ে যাবে। কারণ এই ভারত মহাসাগরই হলো এই অঞ্চলে তেল পরিবহনের জন্য আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে প্রধান কৌশলগত সংযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন নৌবাহিনী যে ফ্রিডম অব নেভিগেশান অভিযান চালিয়েছে, সেটা এমনিতেই বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ, ওই অঞ্চলের বড় এলাকাকে নিজেদের সার্বভৌম অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে বেইজিং। সে কারণে, গোয়াদরে নৌঘাঁটি গড়ে তোলার মাধ্যমে বেইজিং ভারত মহাসাগরে কৌশলগত শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা ভারসাম্য বজায় থাকে।
এই মুহূর্তে পাকিস্তান তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ভারতের নৌশক্তির কাছাকাছি যেতে পারবে না। কিন্তু পাকিস্তান যদি তাদের আধুনিকায়ন জারি রাখে, এবং চীন ও তুরস্কের সহযোগিতা নিয়ে কৌশলগত সহযোগিতাকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে নেয়, তাহলে পাকিস্তান সত্যিকারের আঞ্চলিক নৌশক্তি হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নৌশক্তির স্থিতিশীলতার সমীকরণটাই বদলে যাবে।
পাকিস্তানের নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি এবং তাদেরকে অত্যাধুনিক ফ্রিগেট ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা বেইজিংয়ের মহাপরিকল্পনার অংশ। পারস্য উপসাগর থেকে তেলের আমদানির ক্ষেত্রে চীনকে যেন কোন নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়তে না হয়, সে জন্য এই পরিকল্পনা নিয়ে তারা কাজ করছে। একই সাথে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথের উপর যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে, সেটিও তাদের বিবেচনায় রয়েছে।