চীনের নৌশক্তি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে চীন গভীর সমুদ্র বন্দর ও নৌঘাঁটি স্থাপনের দিকে মনোযোগী হয়েছে। ২০১৭ সালে চীনা নৌবাহিনীর জন্য আফ্রিকার জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি তৈরি করা হয়। এটি ছিল দেশের বাইরে চীনের প্রথম কোনো নৌঘাঁটি। চীন সে-সময় বলেছিল, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় শান্তিরক্ষা ও মানবিক সাহায্য প্রদানে চীনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এই ঘাঁটি। একইসাথে এটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে নয় বলেও দাবি করে চীন। কিন্তু পরবর্তীতে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী নীতি ও বিশ্বশক্তির প্রতিযোগিতায় চীনের অবস্থান তার সামরিক উচ্চভিলাসকে সামনে এনেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, চীনের পরবর্তী নৌঘাঁটি কোথায় স্থাপন করা হবে।
বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিজের শক্তিমত্তার জানান দিতে বিভিন্ন মহাদেশে নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে চীন। চীনের সাম্প্রতিক সামরিক অগ্রগতির ও বেশকিছু পদক্ষেপ থেকে এই পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিভিন্ন মহাদেশে মোট আটটি নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। এজন্য চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৪৬টি দেশে ৭৮টি বন্দরে ১২৩টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। আর এসব প্রকল্পে ২৯ দশমকি ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বেইজিং।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করেছে চীন। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চীনা অর্থায়নে নির্মিত পোতাশ্রয় এবং এ ধরনের অবকাঠামোগুলো যে কোনো সময়ে চীন তার সামরিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
চীনা আইন অনুসারে এসব বেসামরিক বন্দরগুলো বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজনের সময় চীনা নৌবাহিনীকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করবে। এসব প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ যত বড় হবে সেখানে বেইজিং তত বেশি সুবিধা চাইবে।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা এইডডেটার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য সম্ভাব্য আটটি স্থানকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। স্থানগুলো হলো- শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, নিরক্ষীয় গিনির বাটা, পাকিস্তানের গোয়াদর, ক্যামেরুনের ক্রিবি, কম্বোডিয়ার রিম, ভানুয়াতুর লুগানভিল, মোজাম্বিকের নাকালা ও মৌরিতানিয়ার নোয়াকচট।
এইডডেটার গবেষকরা দাবি করেছেন, নৌঘাঁটি গড়ে তোলার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদেশি নৌঘাঁটির উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। এটি চীনের সমুদ্র বাণিজ্যের পথগুলোকে নিরাপত্তা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিষেধাজ্ঞাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে তাতে নিজস্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার দিকটি চীনের কাছে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে আগামি দিনে নৌরুট ও বন্দর স্থাপনের দিকে আরো গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে।
নৌঘাঁটি স্থাপনে বেইজিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেওয়া। এর বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং কোয়াড জোট চেষ্টা করছে ভারত মহাসাগরে চীনকে চাপে ফেলতে। চীনের সম্ভাব্য এই আট নৌঘাঁটির অর্ধেকেরও বেশি ইন্দো-প্যাসিফিকভিত্তিক। আফ্রিকার আটলান্টিক প্রান্তে বন্দরসহ চীনা বিনিয়োগ অনেক বেশি। এই অঞ্চলে চীনা কার্যক্রম অনেক বেশি সক্রিয়। স্বাভাবিকভাবে এ অঞ্চলে চীন তার ভূরাজনৈতিক মনোযোগ বৃদ্ধি করেছে।
আমেরিকাকে প্রতিহত করার জন্য মৌরিতানিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ দিকে গিনি উপসাগর হয়ে ক্যামেরুন, অ্যাঙ্গোলা এবং গ্যাবন পর্যন্ত বন্দর নির্মাণ করছে চীন। নির্দিষ্ট আটটি জায়গাকে কেন বেঁছে নিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রথমে আছে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা। ২০১৭ সালে ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানটোটা বন্দর ইজারা নেয় চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। চীন এই বন্দরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে। যা এককভাবে কোনো বিদেশি বন্দরে চীনের সর্বোচ্চ খরচ। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের ভবিষ্যত পরিকল্পনার একটি অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। এখান থেকেই চীন ভারত মহাসাগরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনির বাটা বন্দর শহরটিতে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। এখান থেকে পশ্চিম আটলান্টিকে চীন তার সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। এই ঘাঁটি আমেরিকা মহাদেশের খুব কাছে হওয়ায় এটি চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তার ও চীনা বাণিজ্যিক পথকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই নৌঘাঁটি চীনের জন্য জরুরি।
চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক উভয় ধরনের সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রধান অংশীদার পাকিস্তান। পাকিস্তানের নৌবাহিনী চীনা অস্ত্রের বৃহত্তম বিদেশি ক্রেতা এবং পাকিস্তানের নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের কাজ করছে চীন। চীনা যুদ্ধজাহাজগুলো ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে অবস্থান করছে। পাকিস্তান চীনা নকশার আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিন পরিচালনা করছে।
গোয়াদর বন্দর পাকিস্তানের সুদূর পশ্চিমে অবস্থিত এবং কৌশলগতভাবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি হরমুজ প্রণালিকে সুরক্ষা প্রদান করে। চীন-পাকিস্তানের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে গোয়াদর বন্দর একটি বড় বাণিজ্যরুট। যা মধ্যপ্রাচ্যর সাথে চীনের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। এই বন্দর থেকে চীনের কাশগড় পর্যন্ত সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। গোয়াদর বন্দর হয়ে উঠবে মধ্যপ্রাচ্যর সাথে চীনের যোগাযোগের প্রধান নৌরুট। গোয়াদর বন্দরে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য বড় ধরনের মাধাব্যাথার কারণ। এখান থেকে চীন এশিয়ার একটি বিশাল অংশের ওপর তার প্রভাব বজায় রাখতে পারে।
ক্যামেরুনের ক্রিবি বন্দরেও চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। এখান থেকে মধ্য আটলান্টিকে চীন তার বাণিজ্যিক ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে এই বন্দর চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের মিত্র। সম্প্রতি তিনি ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেছেন। দেশটির দায়িত্ব নিয়েছে হুনসেনের পুত্র। কম্বোডিয়ার ক্ষমতার পালাবদল হলেও দেশটির চীনা নীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার ওপর নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে।
কম্বোডিয়ার অভিজাতরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে ভালো কাজ করেছেন এবং চীনের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের প্রবেশমুখে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াডকে মোকাবিলায় এই বন্দর চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভানুয়াতুর এসপিরিতু সান্টো দ্বীপের পোর্ট লুগানভিলে অর্থায়ন করেছে চীন। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিজের সামরিক অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে ছোট্ট এই দ্বীপ দেশের বন্দরে চীনের সামরিক ঘাঁটির সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত দ্বীপটি প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় নৌঘাঁটি ছিল। মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো মেরামতের একটি আবাসস্থল ছিল এটি। এখন এখানে চীনা উপস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্বেগ বাড়ছে।
মোজাম্বিকের নাকালা বন্দরে চীনের বিনিয়োগ খুব বেশি নয় তবুও এখানের অভিজাত এবং সাধারণ জনগণের কাছে চীন অনেক জনপ্রিয়। তাই চীনে এখানে নৌঘাঁটি গড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ মৌরতানিয়ায় বাড়ছে চীনের প্রভাব। এই দেশটি ইউরোপের কাছাকাছি এবং জিব্রাল্টার প্রণালির মতো চোকপয়েন্টগুলোর- কাছাকাছি হওয়ায় এখানে চীন তার উপস্থিতি জরুরি বলে মনে করে।
চীনের বিনিয়োগ বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশে করা হয়েছে তবুও বেইজিং উন্নত বিশ্বেও একটি ঘাঁটির জন্য চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে চীন একাধিক রাশিয়ান নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারে । এমনকি রুশ নৌঘাঁটিগুলোকে রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে ব্যবহার করতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এমন সামরিক সহযোগিতা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। চীন স্পষ্টভাবেই পশ্চিমাবিরোধী একটি উত্থান চায়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে একটি কমন হুমকি হিসেবে দেখিয়ে চীন রাশিয়ান নেতৃত্বকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে রাজি করাতে পারে।