গুয়াম দ্বীপের মিসাইল সিস্টেমকে কার্যকর ও উন্নত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপটিকে উত্তর কোরিয়া ও চীনের সম্ভাব্য মিসাইল হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য একটি সুরক্ষা দুর্গে পরিণত করতে চায়। চলতি মাসে দ্য ওয়ারজোন এই সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র গুয়াম দ্বীপের অন্তত ২০টি স্থানে মিসাইল ডিফেন্স সাইট তৈরি করতে চায়, যেখানে তারা সারফেইস টু এয়ার ইন্টারসেপ্টর, রাডার এবং এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তথা ইআইএএমডি-র নানা উপকরণও স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে।
এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা ইআইএএমডি সিস্টেমে থাকছে অ্যাজেস অ্যাশোর, টার্মিনাল হাই অ্যাল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স বা থাড নিরাপত্তা ব্যবস্থা। টাইফুন, প্যাট্রিয়ট এবং দীর্ঘস্থায়ী শিল্ড সিস্টেম। এগুলোর মাধ্যমে মূলত কয়েক স্তরবিশিষ্ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি কার্যকর থাকে।
ওয়ারজোনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি আগামীতে নতুন ধরনের এয়ারস্পেস রেস্ট্রিকশন এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফেয়ারেন্স ভোগান্তি মোকাবিলায় বেশ কাজ করবে। ওয়ারজোন দাবি করছে, চলতি মাসের শুরুতেই মার্কিন সামরিক বাহিনী একটি বৈঠক করে। সেখানে উপস্থিতিদের কাছে এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা ইআইএএমডি সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়। এই প্রযুক্তির বিষয়ে তাদের মতামত, সমালোচনা এবং উদ্বেগের বিষয়গুলো জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে পরিবেশের ওপরও এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বৈঠকে বলা হয়, এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তথা ইআইএএমডি সিস্টেমটি ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে গুয়ামকে রক্ষা করবে। সিস্টেমটির নানা উপকরণ দ্বীপের নানা স্থানে রেখে এই নিরাপত্তা কার্যক্রম নিশ্চিত করা হবে।
জানা গেছে, আলোচিত এই প্রতিরক্ষা সিস্টেমটি মূলত গুয়ামের পরিকল্পিত অ্যাজেস অ্যাশোরকে ভিত্তি করে পরিচালিত হবে। গুয়ামের একটি বিশেষত্বই হলো এই অ্যাজেস অ্যাশোর। যদিও এখনও পর্যন্ত গুয়ামের অ্যাজেস অ্যাশোরের সঠিক কনফিগারেশন নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু বলা যায়, পূর্ববর্তী যে কোনো সিস্টেমের তুলনায় নতুন এই সিস্টেমের কাঠামো অনেক বেশি উন্নত হবে।
ওয়ারজোন জানায়, এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা ইআইএএমডি সিস্টেমে অন্তত চারটি এএন বা টিপিওয়াই-সিক্স পর্যায়ভুক্ত অ্যারে রাডার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই ধরনের একটি অ্যারে রাডার এখন আলাস্কার লং-রেঞ্জ ডিসক্রিমিনেশন রাডার তথা এআরডিআর থেকে প্রযুক্তি সহায়তা গ্রহণ করছে। এর আগে এশিয়া টাইমস ২০২৩ সালের মে মাসে একটি রিপোর্ট করেছিল, যাতে বলা হয়, গুয়াম দ্বীপটি সমন্বিত এয়ার এবং মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য এএন/টিপিআই-সিক্স এর-একটি রোড-মোবাইল সংস্করণ পাবে, যা একটি পৃথক অ্যাজেস অ্যাশোরের সাথে যুক্ত থাকবে। গুয়ামের দক্ষিণ প্রান্তে একটি ভূগর্ভস্থ সুবিধাকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে, যাতে পাহাড়ের ছিদ্র থেকে ছোড়া ইন্টারসেপ্টর মিসাইলগুলো মোকাবেলা করা যায়। এআরডিআর হলো একটি টু-ইন-ওয়ান সিস্টেম, যা কম এবং উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির রাডারকে একত্রিত করে। কম ফ্রিকোয়েন্সির এলআরডিআর একাধিক স্পেস অবজেক্টকে ট্র্যাক করতে পারে, কিন্তু কোনটি আসলে হুমকি হয়ে আসছে তা নির্ণয় করতে পারে না।
কিন্তু বেশি ফ্রিকুয়েন্সির রাডারটি এই পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে এবং নির্দিষ্ট কোনো হুমকি থাকলে তাও শনাক্ত করতে পারে। প্রতিপক্ষের ব্যালিস্টিক, ক্রুজ এবং হাইপারসনিক মিসাইলের হুমকি মোকাবিলায় এই সক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাজেস অ্যাশোর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র অ্যাজেস-সজ্জিত অফশোর যুদ্ধজাহাজ এবং দ্বীপের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের মেরুদণ্ড হিসেবে বর্তমানে গুয়ামে মোতায়েন থাকা থাড প্রযুক্তিটিও উন্নত করার পরিকল্পনা করেছে।
ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস সিস্টেম মার্কিন প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের কাছ থেকে একটি কন্ট্রাক্ট নিয়েছে। এবার ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস সিস্টেম প্রথমবারের মতো থাড ইন্টারসেপ্টর মিসাইল প্রযুক্তির নকশা ও পরবর্তী প্রজন্মের ইনফ্রাড প্রযুক্তি উন্নয়নের কাজ পেয়েছে। এর ফলে, ব্যালিস্টিক মিসাইলের হুমকি মোকাবিলায় ক্রিটিকাল সেন্স এবং গাইডেন্স সক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যাবে।
ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস সিস্টেমের এই উদ্যোগটি সফল হলে প্রতি ঘণ্টায় ২৭ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বেগে আসা মিসাইলগুলোর অস্তিত্ব টের পেলেই থাড গাইডেন্স সিস্টেমটি সক্রিয় হয়ে যাবে। থাড সিস্টেমের অবিস্ফোরক হিট টু কিল মেকানিজম অযাচিত ডিটোনেশনের ঝুঁকি হ্রাস পাবে এবং একইসাথে প্রতিপক্ষের দিক থেকে আসা ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক মিসাইলের ঝুঁকিও কমাবে।
এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা ইআইএএমডি কিংবা থাড সিস্টেম ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র হয়তো গুয়ামে টাইফুন নামক সড়কে পরিবহনযোগ্য মিসাইল লঞ্চারও চালু করবে। এটি করা সম্ভব হলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিসাইল দেয়াল প্রতিষ্ঠিত হবে।
মার্কিন সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রথম চারটি প্রোটোটাইপ টাইফুন মিসাইল লঞ্চার হাতে পেয়েছে। এগুলো দিয়ে এসএম-সিক্স ইন্টারসেপ্টর নিক্ষেপ করা সম্ভব হবে। সর্বশেষ তৈরি হওয়া এসএম সিক্স ব্লক আইবি-ও এই লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা যাবে। নতুন এই এসএম সিক্স ব্লক আইবিতে একটি বড় আকৃতির রকেট মোটর থাকবে, যা এর অ্যান্টি এয়ার এবং অ্যান্টি মিসাইল সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বে নির্মিত প্যাট্রিয়ট মিসাইলগুলো নতুন এই সিস্টেমের সম্পূরক হিসেবে গুয়ামের নিরাপত্তা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। গুয়ামকে মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার মিসাইল থেকে পুরোপুরি নিরাপত্তা দেবে। যদিও নতুন এই সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়ে এরইমধ্যে সাংঘর্ষিক তথ্য পাওয়া গেছে।
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনী প্যাট্রিয়ট মিসাইলের কার্যকারিতা নিয়ে অতিরঞ্জন করেছিল। প্রথমে তারা বলেছিল, প্রতিপক্ষের ছোড়া ৪৭টি মিসাইলের মধ্যে ৪৫টিই তারা ভূপাতিত করতে পেরেছে। কিন্তু পরে জানা যায়, প্যাট্রিয়ট দিয়ে তখন প্রতিপক্ষের ছোড়া মিসাইলগুলোর ৫০ শতাংশ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল।
টার্মিনালের কাছাকাছি গিয়ে ইন্টারসেপ্ট করায় প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের আরো কিছু সমালোচনা আছে। কেননা, ইন্টারসেপ্টের এই দুর্বলতা সার্বিকভাবে প্যাট্রিয়টের কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে এবং দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল মোকাবিলায়ও এর অকার্যকারিতা সামনে এসেছে। তবে প্যাট্রিয়টের পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এসব দুর্বলতার অনেকগুলোই কমে আসায় এর সক্ষমতা ও কার্যকারিতা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ডিফেন্স নিউজ জানায়, আরবে যে প্যাট্রিয়ট সিস্টেমটি ব্যবহৃত হয়, তা ২০১৫ সাল থেকে ১০০টির ওপর ব্যালিস্টিক মিসাইলকে অকার্যকর করে দিয়েছে। প্যাক টু গাইডেড মিসাইলের ৯০ শতাংশও এই প্যাট্রিয়ট দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের মে মাসে একাধিক বার্তা সংস্থা প্যাট্রিয়ট নিয়ে সংবাদ প্রচার করে, যাতে বলা হয়, রাশিয়া থেকে আসা কিনঝালের অনেকগুলোই অকার্যকর করে দিতে পেরেছে সিস্টেমটি। এতে হাইপারসনিক অস্ত্র মোকাবিলায় প্যাট্রিয়টের সক্ষমতাও প্রমাণ হয়।
চীন ২০২২ সালের নভেম্বরে একটি এয়ার লঞ্চড হাইপারসনিক মিসাইল চালু করেছে। যেহেতু একই ধরনের রাশিয়ান কিনঝালকে প্যাট্রিয়ট দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে, তাই ধরে নেওয়া যায়, চীনের এই নতুন হাইপারসনিক মিসাইলকেও প্যাট্রিয়ট ভূপাতিত করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র একইসঙ্গে গুয়ামে একটি স্বল্পপাল্লার এয়ার ডিফেন্স ক্যাপাবিলিটি বা শোরাড সিস্টেমও চালু করবে। এতে নিচ দিয়ে উড়ে আসে এমন যেকোনো বস্তুর হুমকি থেকে গুয়াম নিরাপদে থাকবে। শোরাড সিস্টেমটি সাধারণত মিসাইল-ভিত্তিক অথবা লেজারের মতো ডিরেকটেড-এনার্জি কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে এখনও দীর্ঘস্থায়ী ইনডাইরেক্ট ফায়ার প্রোটেকশন সিস্টেম, মাল্টি মিশন লঞ্চার এবং এআইএম নাইন এক্স সাইড উইন্ডার মিসাইলও চালু করেছে এবং এগুলোকে ব্যাটেল কমান্ড সিস্টেমের সাথে একীভূত করেছে। নতুন এসব সিস্টেমের নকশা ও কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে ওয়ারজোন জানায়, প্রতিটি প্লাটুনের জন্য ১৮টি করে এআইএম নাইন এক্স মিসাইল বরাদ্দ থাকবে। এভাবে ব্যাটেল কমান্ড নেটওয়ার্কের সাথে উন্নত সব সিস্টেম ও প্রযুক্তিকে একীভূত করা হলে গুয়ামের নিরাপত্তা অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে।
অ্যাডভান্সড ধরনের অস্ত্র বিশেষ করে ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং হাইপারসনিক অস্ত্রের হাত থেকে দ্বীপটিকে রক্ষা করাও তখন সম্ভব হবে। তবে এত সব সিস্টেমকে একীভূত করতে হলে স্পেস বা সাইবার স্পেসের মতো এক্সক্লুসিভ ফিউশন বসাতে হবে, যা বেশ সময়সাপেক্ষ।