যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন সামরিক জোট হচ্ছে এশিয়ায়

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:১৫

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বৈরথ চলছে তার রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকাতে বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই মুহূর্তে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এখন তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে নজর দিচ্ছে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। আর এ-কারণেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় তার মিত্রদেরকে নিয়ে একটি নতুন সামরিক জোট গঠনে মনোযোগী হয়েছে।

বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশই পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থান এই অঞ্চলে। সবমিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির নতুন রঙ্গমঞ্চ। এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে চীন সারা বিশে^ই তার সামরিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই তা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।



ইন্দো-প্যাসিফিক নৌপথ যদি চীনের সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক-সামরিক স্বার্থ ও কর্তৃত্ব মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশগুলো আছে। সংগত কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ঘোষণা করে তাতে এই অঞ্চল দেশটির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে।

দুটি ঘটনাকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শক্তির কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের জোরালো উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে কোণঠাসা করার মার্কিন কৌশলের কারণে সারাবিশে^ নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যেই এই দুটি ঘটনা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়োন সুক ইয়োলকে নিয়ে ক্যাম্প ডেভিডে ত্রিদেশীয় শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছেন।

ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তিন দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। ত্রিপক্ষীয় এই চুক্তিতে ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য উচ্চ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

‘মালাবার’ নামের বার্ষিক নৌমহড়ায় কোয়াড নিরাপত্তা জোটের সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতের নৌবাহিনী অংশ নিচ্ছে। প্রথমবারের মতো এই নৌমহড়ার আয়োজন করেছে অস্ট্রেলিয়া। এই নৌমহড়া থেকে এই ধারণা জোরালো হয়ে উঠেছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি নৌ প্রতিরক্ষা জোট গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে কোয়াডের এই সদস্যরা।

যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ব্রিটেন ও অষ্ট্রেলিয়াকে নিয়ে ‘অকাস’ নামে যে সামরিক জোট গঠন করেছে, তাতে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হতে পারে বলে মনে করেন ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষক এম কে ভদ্রকুমার। তার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলন থেকেই দেশ দুটিকে এই প্রস্তাব দিতে পারে। এর মাধ্যমে এশিয়ায় চীনবিরোধী একটি বৃহত্তর একটি সামরিক জোট গঠনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক-কারিগরি এবং বৈজ্ঞানিক-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে এই দুটি মিত্র দেশকে ‘অকাস’ জোটে সহজেই আনতে পারবে বাইডেন প্রশাসন।

চলমান ‘মালাবার’ নৌ মহড়া সম্পর্কে বলা যায়, এই মহড়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যৌথ সমুদ্র নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে সাবমেরিন-বিরোধী যুদ্ধসহ ৫টি অগ্রাধিকারমূলক ক্ষেত্রে ‘কোয়াড’-এর অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এম কে ভদ্রকুমার মনে করেন, অকাস ও কোয়াডের আদলে বিভিন্ন মডেলের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এশিয়ায় একটি বৃহত্তর প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র, যেটার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ হাসিল করা যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ঘোষণা করেছে, তাতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপাইনসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিকের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কৌশলে চীনকে না রেখে বরং দেশটিকে ওই অঞ্চলে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিজের সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তির সমন্বয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে চীন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এর প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য এবং আধিপত্যের ওপর। তাই যুক্তরাষ্ট্র সেখানে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু এখানে জাপান-ভারতের মতো দেশগুলোর স্বার্থ কোথায়? চীনের সঙ্গে বিরোধ আছে জাপানের, বিরোধ আছে দক্ষিণ কোরিয়ারও। চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ে সংঘাত আছে ভারতের সঙ্গে।

চীনের উত্থানে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র। জাপান মনে করে, চীনের সামরিক বাহিনী এখন ভারত মহাসাগরেও নজরদারি করতে সক্ষম। ফলে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করতে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র । এর পাশাপাশি কোয়াড নামে সামরিক জোটকে সক্রিয় রাখার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন স্বার্থ আছে, তেমনি ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও আসিয়ানভুক্ত কোনো কোনো দেশেরও আছে নিজস্ব স্বার্থ। আর এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অভিন্ন নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে শেষ পর্যন্ত এই এলাকায় চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব কোনদিকে গড়ায় তার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু।

যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া মনে করে, ভারতের নেতৃত্ব দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের দীর্ঘদিনের জোটনিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে এসে তার কোয়াড অংশীদারদেরকে সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের ভূ-কৌশলগত স্বার্থের কথা চিন্তা করেই নয়াদিল্লি এ-ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক টম করবিন। সম্প্রতি নিক্কেই এশিয়া পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে তিনি এই মন্তব্য করেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবেই এই অঞ্চলে কোয়াডভুক্ত চার দেশের নৌবাহিনী বৃহত্তর পরিসরে ‘মালাবার’ নামের এই নৌমহড়া শুরু করে। এর মাধ্যমে এই দেশগুলোর নৌবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি এবং এসব দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে। কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এখন এই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে, চীন তাদের জন্য একটি অভিন্ন সামরিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, যেটাকে সমন্বিত নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।

ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনবিরোধী এই নৌমহড়ার মধ্যেই গত ১৩-১৪ আগস্ট চীন-ভারত সীমান্তের চুসুল-মোলদো এলাকায় ভারতীয় অংশে দুই দেশের সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এটি দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে অনুষ্ঠিত ১৯তম সীমান্ত বৈঠক। এই বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে জানানো হয় এবং দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় সামরিক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা অব্যাহত রাখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

চীন ও ভারত কেউই যুদ্ধে জড়াতে চায় না। এ কারণে দুই পক্ষই পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রেখে আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি সমাধানে পৌঁছাতে চায় যেখানে উভয় পক্ষই নিজেদেরকে বিজয়ী দাবি করতে পারবে। এজন্যই দুই দেশের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং অংশীদার। আবার একই সাথে চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত নিরাপত্তা জোট কোয়াডেও যোগ দিয়েছে ভারত।

১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতার মধ্যে আটকে আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক এম কে ভদ্রকুমার। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই মানসিকতা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্থিতিশীলতা অর্জনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের অন্তরায় এবং সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে অকাস ও কোয়াড জোট গঠনের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিযেছে বলে মনে করেন এম কে ভদ্রকুমার।