রাশিয়ার প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ বেলারুশ তার দুই প্রতিবেশী পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার সীমান্তের কাছে গ্রোদনো অঞ্চলে বড় ধরনের সামরিক মহড়া শুরু করেছে। এই এলাকাটি সোয়ালকি গ্যাপ নামে পরিচিত একটি জনশূন্য বা ফাঁকা এলাকার কাছে অবস্থিত। পশ্চিমা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সম্ভাব্য সামরিক সংঘাত শুরুর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে বেলারুশের এই সোয়ালকি গ্যাপ। তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া যে কোনো সময় এই গ্যাপটি দখলে নিয়ে পোল্যান্ডসহ ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশ থেকে বাল্টিক অঞ্চলের তিনটি দেশকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে। এই এলাকায় বেলারুশের সাথে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার ৬০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এই সীমান্ত এলাকায় গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হয় সামরিক মহড়া। এই মহড়া রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন গত বছর ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে শুরু করা হামলাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া সীমান্তে তাদের সামরিক মহড়া রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের সাথে সংশ্লিষ্ট করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বেলারুশের এই মহড়ায় ড্রোন, ট্যাঙ্ক বহর ও মটরাইজড রাইফেল ইউনিটসহ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট অংশ নিচ্ছে। একে প্রতিবেশী দেশে হামলা চালানোর পূর্ব প্রস্তুতিরই সুস্পষ্ট আভাস বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে বেলারুশের দুটি সামরিক হেলিকপ্টার সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডের দুই কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এরপরই নিজেদের সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এই দেশ দুটি। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়াকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, বেলারুশের বিরুদ্ধে যে কোনো আগ্রাসন রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। বেলারুশের প্রতি যে কোনো শত্রুতার প্রতিক্রিয়া জানাতে মস্কো সব ধরনের পন্থা ব্যবহার করবে বলেও সতর্ক করে দেন তিনি। পুতিনের এই হুমকির সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের হুমকিও।
গত জুন মাসে মস্কোর বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর ওয়াগনার গ্রুপের কয়েক হাজার সদস্য বেলারুশে আশ্রয় নেয়। এদেরকে নিয়েও আতঙ্কে আছে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া। কারণ ওয়াগনার যোদ্ধারা এরইমধ্যে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়াসহ বেলারুশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে হামলা চালিয়ে এ-সব দেশ দখল করার হুমকি দিয়েছে। এই গ্রুপের বেশ কিছু সদস্য পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে বেলারুশের সেনাদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এই আগ্রাসীদের তাড়িয়ে দিতেই তার দেশ বেলারুশ সীমান্তে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করছে।
পোল্যান্ডের অভিযোগ হলো, ২০২১ সালের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে বেলারুশে আগত অভিবাসীদেরকে দেশটির সরকার অবৈধভাবে পোল্যান্ডের ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধেও এই অভিবাসীদের পোল্যান্ডে চলে যেতে উৎসাহিত করার অভিযোগ উঠেছে। পোল্যান্ডের সীমান্তরক্ষা বাহিনী জানায়, শুধু এ-বছরই ১৯ হাজার অভিবাসী সীমান্ত পার হয়ে তাদের দেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার। বেলারুশের এই কৌশলকে ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে পোল্যান্ড সরকার।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই নিজেদের সীমান্তের কাছে বেলারুশের সামরিক মহড়া আতঙ্কিত করে তুলেছে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়াকে। কেননা, ইউক্রেনের সীমান্তে সামরিক মহড়া চালানোর ছল করেই দেশটিতে হামলা শুরু করেছিল রাশিয়া। বেলারুশও সেই একই কৌশল অবলম্বন করবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত ন্যাটোর সদস্য এই দেশ দুটি।
এরইমধ্যে বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্রও মোতায়েন করেছে রাশিয়া। এছাড়া বেলারুশ সীমান্তের কাছেই বাল্টিক সাগরের উপকূলে লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডের মাঝখানে অবস্থিত রাশিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ কালিনিনগ্রাদ। ফলে পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বলে মনে করছে পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়া সরকার। এ-কারণে বেলারুশ ও ওয়াগনার বাহিনীর দিক থেকে যে কোনো ধরনের উস্কানিমূলক আচরণ ঠেকাতে নিজেদের সীমান্তে শক্তি বাড়িয়েছে দেশ দুটি।
সম্প্রতি বেলারুশের দুটি সামরিক হেলিকপ্টার সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডে প্রবেশ করে বলে অভিযোগ করে দেশটির সরকার। এরপরই তাদের সীমান্তে অতিরিক্ত ১০ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে পোল্যান্ড। পোলিশ সরকার বলছে, বেলারুশের সামরিক বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ১ আগস্ট খুব নিচ দিয়ে উড়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করে সীমান্তের দুই কিলোমিটার ভেতরে বিয়াওভিয়েজা অঞ্চলে চলে আসে। সেই সময় বেলারুশের সশস্ত্র বাহিনী সীমান্ত এলাকায় মহড়া পরিচালনা করছিল।
বেলারুশ সীমান্ত অতিক্রমের অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, তাদের এম-৮ এবং এম-২৪ এই দুটো হেলিকপ্টার পোল্যান্ডের ভেতরে যায়নি। কোনো ধরনের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি। পোল্যান্ডের আনা অভিযোগকে তারা ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করে। কিন্তু পোল্যান্ডের বিয়াওভিয়েজা এলাকার বাসিন্দারা সোশ্যাল মিডিয়াতে এম-৮ এবং এম-২৪ এই দুটো হেলিকপ্টারের ছবি প্রকাশ করেছে। এ-সব হেলিকপ্টারের গায়ে বেলারুশের চিহ্ন রয়েছে। বাসিন্দারা বলছেন, এই দুটি হেলিকপ্টারকে তারা তাদের শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছেন।
বিবিসি-র ভেরিফাই বিভাগ এই দুটো হেলিকপ্টারের সিরিয়াল নম্বর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে যে, এগুলোর একটিকে ২০১৮ সালে বেলারুশের মাচুলিশচি এয়ারফিল্ডের কাছে দেখা গিয়েছিল। বেলারুশ থেকে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী যখন সীমান্ত পার হয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশ করছে তার মধ্যেই বেলারুশের সামরিক হেলিকপ্টার পোল্যান্ডের ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটল।
ওয়াগনারের যোদ্ধারা যেন পোল্যান্ডের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জুলাই মাসেও সীমান্তে অতিরিক্ত এক হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি জানান, ওয়াগনারের ১০০ জন সৈন্যের একটি দল বেলারুশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রদেনা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই শহরটি পোলিশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত। সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতিকে তিনি বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেন।
পোল্যান্ড সতর্ক করে জানিয়েছে, অভিবাসীর রূপ ধরে ওয়াগনারের এই যোদ্ধারা পোল্যান্ডের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। এছাড়াও তারা বেলারুশের সীমান্তরক্ষীর বেশ ধরে আরও বহু অবৈধ অভিবাসীকে পোল্যান্ডের ভেতরে ঠেলে দিতে পারে। কিন্তু বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ওয়াগনার বাহিনীর সৈন্যরা দেশটির দক্ষিণে ব্রেস্টসকি ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এই এলাকাটি পোলিশ সীমান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আরও দাবি করা হয় যে, ওয়াগনারের যোদ্ধারা সেখানে তাদের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. বারবারা ইয়োক্সনের মতে, ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী হওয়ার কারণে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা সীমান্ত এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য রাশিয়া ও বেলারুশকে সরাসরি দায়ী করা যাবে না বলে উল্লেখ করেছেন।
অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, পোল্যান্ডে বেলারুশের সামরিক হেলিকপ্টার ঢুকে পড়ার ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় যে, রাশিয়া বাল্টিক দেশগুলোতে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। রাশিয়া ও বেলারুশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়াও রাশিয়ার সৈন্যরা বেলারুশের সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনে ঢুকে আক্রমণ চালিয়েছে এবং বেলারুশে রাশিয়ার কৌশলগত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশনের বিশ্লেষক অধ্যাপক ম্যালকম চামার্স বলছেন, রাশিয়া এবং বেলারুশ পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখার অংশ হিসেবে ন্যাটোর সদস্য দেশের ভেতরে ঢুকে পড়ার এই মহড়া চালিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা দেখতে চাইছে ন্যাটো জোট কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানায়।
লন্ডনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আনাইস মারিন বলছেন, পোল্যান্ডের ভেতরে বেলারুশের সামরিক হেলিকপ্টার ঢুকে পড়ার ঘটনা সম্ভবত রাশিয়ার পরিকল্পনা। তিনি বলেন, বেলারুশের সঙ্গে পোল্যান্ড ও ন্যাটোর শত্রুতা বজায় রাখা এবং মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় করার জন্য এটা করা হয়ে থাকতে পারে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, পোল্যান্ডের রাজনীতিবিদরা হয়তো আসন্ন নির্বাচনের কারণে ওয়াগনার গ্রুপের হুমকিকে একটু বাড়িয়ে বলছেন। পোল্যান্ডের জনগণকে তারা দেখাতে চান যে, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান খুবই কঠোর। রাশিয়া, বেলারুশ এবং ওয়াগনার গ্রুপের যে কোনো ধরনের হুমকি মোকাবিলায় তারা সদা প্রস্তুত।