মার্কিন সামরিক বাহিনী নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সংকট মোকাবিলা করছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো বাহিনীর সদস্যদের চীন ও অন্যান্য শত্রু-দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে আমেরিকান মিলিটারি নিউজ জানিয়েছে, ২০২০ সালে মার্কিন সেনা সদরদপ্তর পেন্টাগনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের যে-সব শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পূরণ করে অধিকাংশ তরুণ-যুবক পাস করতে পারছে না। ফলে, চীনের মতো অন্যান্য শত্রুদের মোকাবিলায় মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ-প্রস্তুতি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। গত ৬ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে এ-সব তথ্য জানিয়েছে এশিয়া টাইমস।
এশিয়া টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, নিয়োগে অযোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রধান কারণের মধ্যে স্থূলতা, মাদক ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার, স্বাস্থ্যগত ইস্যু উল্লেখযোগ্য। এ দুটো সমস্যার কারণে সামরিক বাহিনীতে যোগদানে আসা তরুণদের বেশিরভাগই অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তরুণ-যুবকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তিতে অযোগ্যতার বিষয়ে পরিচালিত এক সমীক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য ও ওজন- এই দুটি বিষয় সামনে চলে আসে।
নতুন সেনা সদস্য নিয়োগদানের চ্যালেঞ্জের কথা মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরও স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে আমেরিকান মিলিটারি নিউজ। দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তর বলছে, সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে আগের প্রজন্মের তুলনায় এখনকার তরুণরা বেশি যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন ও কম আগ্রহী।
এবারের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগাদানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
গত জুলাই মাসে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বেন কেনসলিং জানিয়েছেন, এ বছর ৬৫ হাজার সৈনিক নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ হাজার কম সৈনিক যোগদান করবে। এছাড়া মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী যথাক্রমে ৩৮ হাজার ও ২৭ হাজার করে নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ও ৩ হাজার করে কম নিয়োগ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সামরিক বাহিনীতে প্রতি বছর নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান এই প্রবণতার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, একদিকে সামরিক বাহিনী থেকে অবসারপ্রাপ্ত ভেটেরানদের সংখ্যা দিন দিন কমছে, অন্যদিকে নতুন করে লোকবল নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হচ্ছে না। এটা মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মনে করছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এর ফলে দেশে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে যা শত্রুদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা অর্জনের ভিত্তিকেই দুর্বল করে দেবে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, মার্কিন মেরিন কোর গত বছর নতুন রিক্রুটদের মধ্য থেকে ৩৩ হাজার জনকে বুট ক্যাম্পে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্র্তারা রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পেন্টাগনের তথ্যে দেখা যায় যে, ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ সামরিক বাহিনীতে ভর্তির যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অথচ কোভিড-১৯ মহামারির আগে এই হার ছিল ১৩ শতাংশ।
সামরিক বাহিনীতে রিক্রুটমেন্টের এই সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায় , প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব, অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থার ঘাটতি মার্কিন সামরিক বাহিনী লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব এবং ক্রিমিনাল রেকর্ডও অনেক অনেক তরুণকে সেনাবাহিনীতে ভর্তিতে অযোগ্য করে দেয়।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের জন্য লেখা এক নিবন্ধে থমাস স্পোয়ার ও ব্রিগেট হ্যান্ডি উল্লেখ করেছেন, সামরিক বাহিনীতে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে হাই স্কুল ডিপ্লোমা অথবা জেনারেল ইকুইভ্যালেন্সি ডিপ্লোমা বা জিইডি থাকতে হয়। কিন্তু অনেকেরই এই সার্টিফিকেট না থাকায় তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীতে ভর্তি হতে পারছে না।
থমাস স্পোয়ার ও ব্রিগেট হ্যান্ডি তাদের নিবন্ধে আরো উল্লেখ করেছেন যে, ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবছরে সমন্বিত স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের হার ৮৩ শতাংশ হলেও এতে মেধার ক্ষেত্রে নিম্নমানের শিক্ষার্থীদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মেধার ঘাটতির কারণে চীন ও রাশিয়ার মতো শত্রুদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন্য ২০২২ সালের এপ্রিলে যৌথভাবে লেখা এক নিবন্ধে গ্যাব্রিয়েলা অ্যাথানাশিয়া ও জিলিয়ান কোটা উল্লেখ করেছেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও অংকের মতো বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জনে চীন ও রাশিয়াসহ অন্য নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তারা ২০১৯ সালের ডেটা উল্লেখ করে বলেন, এতে দেখা যায় যে, গণিতে নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে ১৫ তম স্থানে আছে। এ ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর ও রাশিয়ার পরে।
থমাস স্পোয়ার ও ব্রিগেট হ্যান্ডি বলেছেন, মার্কিন তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার পূর্ববর্তী রেকর্ডের কারণে প্রতি ১০ জনে একজন যুবক সামরিক বাহিনীতে যোগদানে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪ লাখ যুুবক অন্যান্য শর্তাবলীর পরীক্ষায় যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও তারা তাদের তরুণ বয়সের অপরাধমূলক কাজের কারণে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারছে না।
এসব কারণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বর্তমানে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা গেছে যে, বেকারত্বের হার বর্তমানে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এর কারণ হচ্ছে, গত জানুয়ারি মাসে দেশটিকে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ। এছাড়া গত দুই বছরে উৎপাদন খাতে ৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস।
মার্কিন বাািণজ্যমন্ত্রী গিনা রেইমনডো বলেছেন, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির এই পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কাজ করছে ভালোভাবেই। কারণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেকারত্বের হার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলের ঘাটতির অন্যতম কারণ। অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় চাকুরির সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় সামরিক বাহিনীতে যোগদানে আগ্রহী যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
গত জুলাই মাসে জনমত জরিপকারী সংস্থা গ্যালাপের জন্য লেখা এক নিবন্ধে মোহাম্মেদ ইউনিস বলেছেন, মার্কিন জনগণের দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রতি আস্থা দিন দিন কমছে। আর এই আস্থার সংকটের কারণে সামরিক বাহিনীর সম্ভাবনাময় পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গত ৫ বছর ধরে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে নিজের নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন মোহাম্মেদ ইউনিস।
গ্যালোপের লেখায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেনের হামলার পর সামরিক বাহিনীর জনগণের আস্থার হার ছিল ৭০ শতাংশের উপরে। কিন্তু ২০২১ সালে এসে তা ৬৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে চরম আস্থার সংকটে পড়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন সামরিক বাহিনীর ওপর রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের আস্থা সব সময়েই বেশি ছিল। আগে এই হার ছিল ৯০ শতাংশের উপরে। কিন্তু গত তিন বছরে তা ৯১ শতাংশ থেকে কমে ৬৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া সামরিক বাহিনীর প্রতি দল নিরপেক্ষ মার্কিনীদের আস্থার ঘাটতিও প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে তাদের আস্থার হার ৬৮ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ডেমোক্রেটদের চেয়েও কম বলে জানিয়েছেন মোহাম্মেদ ইউনিস।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া এবং তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন সময়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর লোকবলের ঘাটতির এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে দেশটির অবস্থানকে নাজুক করে তুলবে বলে মনে করেন অনেক মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক।