চলছে ভারতের অর্থনীতিতে। অনেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বর্তমান মন্দা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফসহ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ভারতের অর্থনীতির মন্দায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহনের আহবান জানিয়েছেন। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ মন্দা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। ভারতে ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বেও হার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। কমে গেছে ঋনপ্রবাহ। ২০১৪ সালের পর গ্রাহকের আস্থা নেমে গেছে সর্বনি¤œ পর্যায়ে। মন্দ ঋনের ভারে জর্জরিত ভারতের ব্যাংকিং খাত। মন্দ ঋনের পরিমান বিশ্বে ভারতের সবচেয়ে বেশি। দেউলিয়ার পথে অনেক বড়বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। উচ্চ মূল্যেল রুপি বাতিলের পর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রিয়েল স্টেটসহ আরো অনেক খাত।
অর্থনীতর এ দুরবস্থার মধ্যে বর্তমানে যোগ হয়েছে পর্যটন খাতের ভয়াবহ ধ্বস। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় লাখ লাখ পর্যটন বাতিল করেছে ভারত সফর। পর্যটন খাত থেকে আয়ের এ ধ্বস চলমান অর্থনৈতিক মন্দাকে আরো তীত্র করে তুলছে। আন্তর্জাতিক মনিটারি সংস্থা আইএমএফ তাদের বার্ষিক পর্যালোচনায় ভারতের অর্থনীতি বিষয়ে জানিয়েছে বর্তমানে ব্যয়, বিনিয়োগ এবং রাজস্ব খাতে আয় কমছে। এর সাথে আরো কিছু বিষয় মিলে আইএমএফের দৃষ্টিতে ভয়ানক পরিস্থিতে ভারতের বর্তমান অর্থনীতিতে। আইএমএফের এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের রনিল সালগাদো বলেছেন, ভারত এখন উল্লেখ করার মত অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে রয়েছে। দেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। তার মতে এ মন্দা কাঠামোগত কারনে নয় বরং চক্রীয়। মন্দা দ্রুত কাাটিয়ে ওঠা যাবে না । তবে এ মন্দাকে তিনি সঙ্কট বলতে রাজি নন।
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেছেন ভারতের অর্থনীতির জন্য তাদের প্রবৃদ্ধির অনুমান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে যাচ্ছে এবং আগামী মাসে তা প্রকাশ করা হবে। ২০১৯ সালে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ে হত অক্টোবরে আইএমএফ যে পূর্বাভাস দিয়েছিলো তা বাতিল করেছে সংস্থাটি।
ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক বার্ষিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬ দশমিক ১ থেকে ৫ এ নামিয়ে এনেছে। গত জুলাই থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে ভারতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গত ছয় বছরের মধ্যে ছিল সর্বন্মি পর্যায়ে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ সময়ে এক বছর আগে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ৭ ভাগ এ বছর তা নেমে দাড়িয়েছে শতকরা ৪ দশমিক ৫ এ। গ্রাম পর্যায়ে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় কমেছে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের হারও। আইএমএফের বার্ষিক পর্যালোচনায় অবশ্য রেকর্ড পরিমান রিজার্ভের কারনে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্ট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হারভার্ড কেনেডি স্কুলের প্রফেসর অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন ভয়াবহ মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারতের অর্থনীতি। তিনি তার একটি এ্যাকাডেমিক পেপারে উল্লেখ করেছেন, এটা কোনো সাধারণ মন্দা নয়। বরং ভয়ানক মন্দা। মনে হচ্ছে ভারতের অর্থনীতি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সুব্রানিয়ামের মতে এ মন্দার জন্য প্রথমত দায়ী ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যখন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জোয়ার চলছিল, তখন স্টিল, বিদ্যুত এবং অবকাঠামো খাতে বিপুল ঋন প্রদান। দ্বিতীয় যে কারণটিকে তিনি ভারতের অর্থনীতির দুরবস্থার জন্য দায়ী করেছেন । তা হলো সরকারের উচ্চ মূল্যের নোট বাতিলকরন। এর ফলে আর্থিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপর্যয় নেমে আসে। উচ্চ মূল্যের রুপি বাতিলের কারনে গত বছর সেপ্টেম্বরে দেশের সবচেয়ে বড় শ্যাডো ব্যাংক আইএল অ্যান্ড এফএস বিধ্বস্থ হওয়াকে সুব্রামানিয়ান ভূমিকম্পের ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উচ্চ মূল্যের মুদ্রা বাতিল করায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে রিয়াল স্টেট খাতে। শীর্ষ আটটি শহরেই ২০১৯ সালে দশ লাখ বাড়ি ও ফ্ল্যাট অবিক্রিত থেকে যায় যার মূল্য ৮ লাখ কোটি রুপি।
সুব্রামানিয়াম একে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং খাতের দুরবস্থার ভারতীয় ভার্সন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুদ্রা বাতিল করার ফলে ব্যাংিকং খাত, নন ব্যাংক ফাইন্যানসিয়াল কোম্পানী বা এনবিএফসি, রিয়েল স্টেট খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। মুদ্রা বাতিলের আগে এনবিএফসি ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায় ঋনের প্রধান উৎস। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তাদের বানিজ্যিক ঋন সর্বোচ্চ ২০ লাখ কোটি রুপিতে পৌছে । মুদ্রা বাতিলের পরে তাদের ঋন প্রদনে ধ্বংস নেমেছে। মুদ্রা বাতিলের পরে ভোক্তা পন্যের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সরকারের রাজস্ব আয় সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করেছেন সুব্রামানিয়াম। ১৯৯১ সালের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সঙ্কটকে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক সঙ্কট বলে মনে করেন সুব্রামানিয়ান। বর্তমান আর্থিক মন্দাকে তিনি ১৯৯১ সালের সঙ্কটের কাছকাছি বলে মনে করেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর রঘুরাম রাজান ভারতের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন ও গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরনের পদক্ষেপ গ্রহনের আহবান জানিয়েছেন। এ ছাড়া মূলধন, ভূমি ও শ্রমবাজার উদারীকরনে সংস্কারেরও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি । তিনি বলেছেন মোদী সরকার অর্থনৈতিক মন্দাকে অস্বীকার করছে। অপর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যেখানে ২০১২ সালে দেশে মোট কর্মসংস্থা হয়েছে ৪৭২ দশমিক ৫ মিলিয়ন সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা কমে দাড়িয়েছে ৪৭১ দশমিক ৩ মিলিয়নে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম।
অইএল অ্যান্ড এফএসসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দৈন্যদশা তুলে ধরে এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে অন্যতম বৃহৎ বন্ধকী প্রতিষ্ঠান দেওয়ান হাউজিং করপোরেশনের ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে বাতিল করে প্রতিষ্ঠানটিকে দেউলিয়া কোর্টে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনের কারনে ধ্বস নেমেছে পর্যটন খাতে। পর্যটন খাতের এই ধ্বস প্রভাব ফেলছে দেশটির অর্থনীতিতে। পর্যটন মৌসুমে চলা দেশব্যাপী এই আন্দোলনের ফলে এ খাতে এ বছর যে ক্ষতি হলো তা সারা বছর আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। দেশব্যাপী চলা আন্দোরনের কারনে সাতটি দেশ তাদের নাগরিকদের ভারত ভ্রমনের ওপর সতর্কতা অথবা ভ্রমন বাতিলের নোটিশ জারি করেছে। এ দশেগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, তাইওয়ান ও ইসরাইল।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ২ লাখ পর্যটক তাজমহল ভ্রমন বাতিল অথবা স্থগিত করেছে। তাজমহল এলাকায় বিশেষ পর্যটক পুলিশ স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী এ বছর ডিসেম্বর মাসে গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যটক কম এসেচে তাজমহলে। আগ্রায় অবস্থিত তাজমহল দেখতে প্রতি বছর ৬৫ লাখ পর্যটক আসে এবং শুধুমাত্র প্রবেশমূল্য থেকে আয় হয় ১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আসাম টুরিজম ডেভেলপমন্ট করপোরেশনের প্রধান জয়ন্তা মাল্লা জানিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় একসিংওয়ালা রইনোসর দেখতে বছওে গড়ে ৫ লাখ পর্যটক আসে। কিন্তু এ বছর তা ৯০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতের জিডিপির ৯.২ শতাংশ বা ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয় পর্যটন খাত থেকে। আর বর্তমান ভারতজুড়ে চলমান আন্দোলনের কারনে এ বছর ধ্বস নেমেছে এ খাতের আয়ে।