কিছুদিন আগেও যেটা কল্পনা করাই ছিল অসম্ভব, বাস্তবে তাই ঘটলো। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ২০ ডলারের নীচে নেমে এসেছে। গত দুই দশকে এটাই সর্বনিম্ন দাম। তবে এখানেই হয়তো থেমে থাকবে না দরপতন। তেলের দাম ১০ ডলারের নীচে নেমে আসতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, দাম নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবের অর্থনীতির কী হবে? অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য সৌদির দরকার প্রতি ব্যারেল তেল থেকে ৮০ ডলার আয় করা। অথচ দাম কম রাখার যুদ্ধে সৌদি সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
বৈশ্বিক রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক তেল। বলা হয়, তেলের জন্য বহু যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের ক্রীড়নক ছিল সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক সরকার। অন্যদিকে তেল বিক্রির টাকায় ফুল ফেপে উঠেছে বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশটি সৌদি। সম্ভবত সেদিন এখন অতীত হতে চলছে।
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। কলকারখানা বন্ধ, সড়ক খা খা করছে। চলছে না বিমান ও নৌযান। ফলে তেলের কোনো চাহিদাই নেই। এ অবস্থায় তেলের দাম ৭০ শতাংশ কমে গেছে। তেল রাখার মত দুনিয়ায় কোনো ডিপো আর খালি নাই। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। ফলে তেলের দাম আরও কমবে। করোনা সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে তেলের ক্রেতা পাওয়াই কঠিন হতে পারে।
বিশ্বে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৩০ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে সৌদি আরব ও রাশিয়া জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত সরবরাহ বাজারকে সয়লাব করে দিচ্ছে। তবে দৈনিক ১ কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। বর্তমান হারে উৎপাদন বহাল থাকলে চলতি এপ্রিল মাসে দৈনিক ২ কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল ও আগামী মাসে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল বাড়তি তেল সরবরাহ হবে বাজারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯ অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও সামাজিক দূরত্বের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমেছে। এ অবস্থায় অনেক তেল উৎপাদনকারী কোম্পানিকে হয়তো তেল ক্ষেত্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
এ অবস্থায়র মধ্যেও তেল নিয়ে জুয়াখেলায় মেতে উঠেছে সৌদি আরব। এর কারণ একাধিক। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের নেতৃত্ব নিজের কব্জায় রাখতে চায় সৌদি আরর। এর মাধ্যমে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রিয়াদ। আরব জাহানে সৌদির প্রতিপক্ষ ইরান ও তাদের মিত্র রাশিয়াকেও শায়েস্তা করতে চায় রিয়াদ। ও দুটো দেশও তেল রফতানি আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে সম্প্রতি তেল উৎপাদন কমানোর জন্য ওপেকের একটি বৈঠক হলেও তাতে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছানো যায়নি। ফলে তেলের উৎপাদন না কমানোর নীতিতে অটল রয়েছে সৌদি আরব। এরফলে তেলে সয়লাব হবে বাজার আর দাম আরও কমবে। কিন্তু কী করছে রাশিয়া
রাশিয়াও তেল নিয়ে জুয়া খেলতে চায়। রাশিয়ার তেল কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এখন সেই সুযোগ সমাগত। নিজের দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে জেনেও পুতিন চাচ্ছেন তেলের দাম আরও কমে আসুক।
এর পেছনের কারণ অত্যন্ত চমকপ্রদ। যুক্তরাষ্ট্র আগে তেল আমদানিনির্ভর ছিল। ফলে কম দামে তেলের আমদানি নিশ্চিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সব মার্কিন নেতাকে জোর চেষ্টা চালাতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা চান কম দামে তেল। এটা নিশ্চিত করতেই তেলের আধার মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে ওয়াশিংটনকে জটিল আর অনৈতিক খেলায় জড়িতে পড়তে হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সেই সমীকরণ এখন পাল্টে গেছে। দেশটি এখন আর তেল আমদানিনির্ভ নয়। গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেল রফতানিকারকে পরিণত হয়েছে। দেশটিতে এখন যে পরিমাণ তেল উৎপাদন হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা তার চেয়ে কম।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তেল উত্তোলন খাতে জড়িত আছে ৫ লাখ লোক। তেল কোম্পনিগুলোকে লাভের মুখ দেখতে হলে প্রতি ব্যারেলের দাম হতে হবে ৭০ ডলার। তেলের দাম কমে গেলে তা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কোনো সুসংবাদ নয়। বরং দারুণ দুঃসংবাদ। ফলে তেল নিয়ে সম্প্রতি সৌদি আরব ও রাশিয়া বিরোধে জড়িয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ট্রাম্প। তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও রুশ নেতা পুতিনকে ফোন করে বিরোধ অবসানের চেষ্টা করেন। তবে তাতে ব্যর্থ হন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তেল নিয়ে এ যুদ্ধে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে চীন। বিশ্বে চীন এখন বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। ফলে তেলের দাম যত কমবে, ততই তা তার জন্য আশীর্বাদ। তবে তেলের দরপতনে সর্বনাশ হবে ভেনিজুয়েলা, নাইজেরিয়া, ইরাক, ইরান, ওমান ও ইকুয়েডরের মত দেশগুলো। তেলের আয়ের ওপর তাদের জাতীয় বাজেট নির্ভরশীল। যেমন প্রতি ব্যারেল তেল রফতানি থেকে ইরাকের দরকার ৬০ ডলার। অন্যথায় সরকারি কর্মীদের বেতন দেয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। রাশিয়ার রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ আসে তেল থেকে। ব্যারেল প্রতি এক ডলার দাম কমলে রাশিয়ার ক্ষতি ২০০ কোটি ডলার।
আসলে জ্বালানি তেলের ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক অর্থনীতি। বিশ্বের বিদ্যুতের উৎসের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি দখল করে রেখেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। কয়লা, পরমাণু, জলবিদ্যুৎ এবং নবায়নযোগ্য শক্তি- এ চারটি উৎস মিলে যা হয় তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ মেলে তেল থেকে। সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম ধনী একটি দেশ তাদের তেল ক্ষেত্রের জন্য। দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর মূল্য অ্যাপল, গুগল কিংবা আমাজনের চেয়ে বেশি।
গত পাঁচ বছর ধরেই ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ওঠানামা করছে। ২০১৪ সালের জুন থেকে হঠাৎ করেই বিশ্ববাজারে কমতে থাকে পণ্যটির দাম। এর আগে ব্যারেল প্রতি দাম ছিল ১১৪ ডলার । এক বছরের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেকের নিচে নেমে যায়। ব্যারেল প্রতি মাত্র ৪০ ডলারে পৌঁছায়। এটা ছিল ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দর। সে সময় বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের সরবরাহ অনেক বেশি ছিল। সেই তুলনায় চাহিদা কমে গিয়েছিল। আর চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি থাকলে দাম কমে। দুই বছরের মধ্যে তেলের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
তেল উত্তোলন কমানোর বিষয়ে রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক এবং ওপেকবহির্ভূত ১১টি দেশ সম্মত হওয়ায় বিশ্ববাজারে আবারও বাড়তে থাকে জ্বালানি তেলের দাম। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে তেল উৎপাদন কমাতে শুরু করে ওপেকভুক্ত দেশ ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, ভেনেজুয়েলাসহ ১৪টি দেশ এবং রাশিয়া। তিন মাসের মধ্যে তেলের দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী দেশ হল যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিন ১ কোটি ৫৬ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে দেশটি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সৌদি আরব। দেশটি প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল উৎপাদন করে। অন্যদিকে ইরান প্রতিদিন প্রায় ৪৭ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মজুদ আছে ভেনিজুয়েলার । ৩০২ বিলিয়ন ব্যারেল রিজার্ভ আছে দেশটির। ২৬৭ বিলিয়ন ব্যারেল রিজার্ভ নিয়ে এর পরেই রয়েছে সৌদি আরব।
তেল নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ কোনো খেলোয়ার না হলেও দাম কম- বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ে এদেশের অর্থনীতিতে। এদেশে প্রতি বছর ৬০ লাখ টন জ্বালানি তেলের প্রয়োজন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়৷ অর্থনীতিবিদিরা বলছেন, তেলের দাম কমালে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে তেলের দাম কমলে নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে বাংলাদেশে। এদেশের প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ আসে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। আর তেলের দাম কমলে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে।