ভয়ানক এক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন এবারের মন্দা ২০০১ ও ২০০৮ সালের মন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে। করোনার কারনে যুক্তরাষ্ট্র পড়তে পারে মহামন্দার কবলে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বলেছেন, ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর বিশ্ব সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। আর এ ভয়াবহ মন্দাকবলিত একটি দেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি। করোনার প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কতটা মন্দার মধ্যে পড়তে পারে সে বিষয়ে আমরা আজ আলোচনা করবো।
করোনা ভাইরাস যদি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় তাহলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাড়ায় সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। বাস্তবতা হচ্ছে অনেক আমেরিকান বর্তমানে করোনার চেয়ে বেশি চিন্তিত অর্থনীতি নিয়ে। ইতোমধ্যে ত্রানশিবিরে গরিবের বিনামূল্যের খাবার কেন্দ্রের সামনে বিত্তবানদের লাইন কয়েক মাইল দীর্ঘ হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে করোনার কারনে অনেক আমেরিকানদের ঠাই হতে পারে রাস্তায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্ইু সপ্তায় ১ কোটি মানুষ বেকার ভাতার আবেদন করেছে। করোনার কারনে তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেবার বিভাগ জানিয়েছে ২১ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দুই সপ্তাহে মোট ১ কোটি কর্মহীন আমেরিকান বেকার ভাতার আবেদন করেছে। করেনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন তা আগে থেকেই অনুমান করা হয়েছিলো। কিন্তু এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করবেন তা ছিলো কল্পনাতীত।
শেষ পর্যন্ত সেন্ট লুইসের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এর অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন বেকারে সংখ্যা ৪ কোটি ৭০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। মোট বেকারের হার দাড়াবে ৩২ ভাগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণভাবে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫ ভাগ। চলতি মাস শেষে করোনার কারনে চাকরি হারানো আমেরিকানদের সংখ্যা ২ কোটি হতে পারে।
৯ এপ্রিল বিবিসি ও গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে ৯৫ ভাগ আমেরিকান কোনো না কোনো ভাবে লকডাউনের শিকার। সর্বশেষ তিন সপ্তাহে ১ কোটি ৬৮ লাখ আমেরিকান চাকরি হারিয়েছে।
মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্রের ৩৬ ভাগ শ্রমিক হলো গিগ শ্রমিক। স্বাধীন, চুক্তিভিত্তিক, অনলাইন, অনকল ভিত্তিক, অস্থায়ী শ্রমিকদের গিগ শ্রমিক বলা হয়। যেমন একজন উবার চালকও গিগ শ্রমিকের মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ গিগ এবং ঘন্টা চুক্তি শ্রমিকদের পক্ষে স্বল্প মেয়াদে কোনো মন্দা পরিস্থিতিতেও টিকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু করোনার প্রভাব হতে যাচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোটি কোটি স্বল্প আয়ের মানুষ বিপন্ন হওয়ার পথে।
দেড় কোটির বেশি আমেরিকান কাজ করে রেস্টুরেন্টে। এর মধ্যে ৩০ লাখের বেশি দরিদ্র। করোনা পরিস্থিতি মোমাবেলায় ২ লাখ কোটি ডলারের যে প্রণোদনা বিল পাস করা হয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে এপ্রিলের শেষ নাগাদ পৌছতে পারে। কিন্তু গিগ এবং ঘন্টা চুক্তি শ্রমিকদের দরকার এখনই নগদ অর্থ সহায়তা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ৭০ ভাগ নির্ভর করে ভোক্তাদের ব্যয়ের ওপর। মহামন্দার কারনে অস্বাভাবিকভাবে কমবে ভোক্তাশ্রেণীর ব্যয়। মহামন্দার কারনে লাখ লাখ গিগ এবং ঘন্টা চুক্তির কর্মজীবীরা হারাবে তাদের ভাড়াকৃত বাসা। অনেকে ব্যর্থ হবে ঋন পরিশোধে। অনেকে হবে গৃহহীন। অনেকের আশ্রয় হবে রাস্তায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউয়র্ক টাইমসের ৯ এপ্রিলেল একটি খবরের শিরোনাম ছিলো ফ্রি খাবার সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার গাড়ির কয়েক মাইল দীর্ঘ লাইন। এ খবরের সাথে একটি টুইটার ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় ফ্রি খাবার বিতরণ করছে এমন একটি ফুড ব্যাংকের সামনের রাস্তায় কয়েক মাইল দীর্ঘ ব্যক্তিগত গাড়ির লাইন।
অবিশ্বাস্য হলোও এটিই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান চিত্র। গরিমের বিনামূল্যেও খাবার কেন্দের সামনে হাজার হাজার বিত্তবান প্রাইভেটকার নিয়ে লাইনে দাড়িয়েছে খাবর সংগ্রহের জন্য। কোনো কোনো ফুড ব্যাংকের সামনে ক্ষুধার্ত মানুষের লাইন তিন মইল পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে বিনামূল্যে খাবার বিতরণকারী সবচেয়ে বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠান হলো ফিডিং আমেরিকা । এ সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে করোনার কারনে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ খাদ্যের অভাবে রয়েছে। করোনার পর থেকে রেকর্ডসংখ্যক আমেরিকানদের পক্ষ থেকে জরুরি খাদ্য সাহায্যের আবেদন করা হয়েছে তাদের কাছে।
কোনো কোনো এলাকায় আগের তুলনায় কয়েকশগুন পর্যন্ত বেড়েছে খাবারের চাহিদা। দীর্ঘ লাইনে মানুষ দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় শেষ হয়ে যাচ্ছে খাবার। এটি দেশব্যাপী বর্তমানে মার্কিনীদের ক্ষুধা বা খাদ্য সঙ্কটের একটি চিত্র।
ফুডব্যাংকে যেমন দেখা দিয়েছে খাদ্য সঙ্কট তেমনি ভলান্টিয়ারের অভাবে আবার বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ফুড ব্যাংক। ইন্টারফেথ নিউট্রিশন নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক জেন কেলি জানান, অধিকাংশ ফুড ব্যাংক পরিচালিত হয় ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে। ভলান্টিয়ারদের গড় বয়স সাধারণত ৭০ । কিন্তু করোনা থেকে রক্ষায় তাদের পক্ষে আর এ সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
করোনার ফলে ইতোমধ্যে ধ্বস নেমেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের বিদায় করে দিয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্টান পরিস্থিতি উন্নতির আশায় কম বেতনে কিছূদিন পর্যন্ত তাদের কর্মচারীদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে । কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে এই কর্মচারীরাও ছাটাইয়ের তালিকায় পড়বে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান করলে কমে যাবে সব ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়।
বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এয়ারলাইনস, শিপিং, হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়বে।
মানুষের হাতে অর্থ না থাকার কারনে সকল প্রকার বিনোদন আর বিলাস সম্পর্কিত ব্যবসা গুটিয়ে যাবে। ধ্বস নামবে পর্যটন ক্ষেত্রে। বড় বড় অনেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের গাড়ি বিক্রি কমে গেছে ৫০ ভাগ। হুন্দাই জানিয়েছে ২০১৯ সালের মার্চের তুলনায় ২০২০ সালের মার্চে তাদের বিক্রি কমেছে ৪৩ ভাগ।
করোনার আঘাতে ওয়াল স্ট্রিটে নেমে এসেছে চরম হতাশা। রকেট গতিতে কমছে শেয়ার মূল্য। ২ লাখ কোটি ডলার প্রনোদনা বিল পাসের পর ২০ ভাগ পর্যন্ত সূচক বাড়ে শেয়ার বাজারে। কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকে অব্যাহতভাবে কমছে শেয়ার সূচক। এপ্রিলের শুরুতে স্যান্ড পি ৫০০ হারিয়েছে ১১৪ পয়েন্ট। ডাউ জোন্স কমিয়েছে ৯৭৩ পয়েন্ট। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে আমেরিকানরা মার্চের মাঝামাঝি থেকে খাদ্য মজুদ শুরু করে। বিভিন্ন কারাখান তাদের সর্বোচ্চ সীমা ব্যবহার করেছে ভোগ্য পন্য উৎপাদনের জন্য। কিন্তু তারপরও চাহিদার তুলনায় তা ছিল কম।
খাদ্য মজুদের বিষয়ে ব্লূমবার্গ লিখেছে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রতি বছরের জরিপের চিত্র হলো অধিকাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক আমেরকিনাদের ১ হাজার ডলার সঞ্চয় নেই। চলতি বছরের এক জরিপে দেখা গেছে ৫৮ ভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক আমেরিকান জানিয়েছে তাদের ১ হজার ডলারের কম সঞ্চয় রয়েছে।
নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ এর তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক ঋন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে ২০১৯ সালে। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট পারিবারিক ঋনের পরিমান ১৪ লাখ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে পারিবারিক ঋনের পরিমান বেড়েছে ৬০১ বিলিয়ন ডলার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারি চাকরিজীবিদের অর্ধেক নিয়োজিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী করোনার কারনে যুক্তরাষ্ট্রে এক সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে ৫০ হাজার রিটেল স্টোর। এসব স্টোরে কর্মরত ৬ লাখ কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে।
অনেক স্টোর মালিক ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিজনেসের কাছে আবেদন করেছে তারা দেউলিয়ার আবেদন করবে কি না এ বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে। এ প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলছেন, এসব ইমেইল সামলাতে কান্না করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
প্রকৃতপক্ষে আমেরিকনারা বর্তমানে করোনা ভাইরাসের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তাদের অর্থনীতি নিয়ে। করোনা পরবর্তী জীবনের চিন্তায়।