থেমে গেছে সমস্ত যুদ্ধ, গোলাগুলি আর বোমার আঘাতে জীবন ও জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ। তবে শুরু হয়েছে নতুন এক যুদ্ধ। করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে গোটা পৃথিবীর সংঘাত আর যুদ্ধের চিত্র। করোনা জন্ম দিয়েছে নতুন কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব বহুরাষ্ট্রের সাথে বহুমুখী। করোনার কারনে বিশ্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে যাবার কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।
জাতিসংঘের বাইরে আধুনিক বিশ্বে দীর্ঘ সময় ধরে সবচেয়ে শক্তিশালী আর কার্যকর সংস্থা হিসেবে টিকে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন । কিন্তু করোনা ইতোমধ্যে ফাটল ধরিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। করোনায় এ সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি পারষ্পরিক স্বার্থপর আচরনে অনেকে হতাশ এর ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে। করোনায় বিধ্বস্ত ইতালী প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য সামগ্রীর জন্য সাহায্য চেয়েছিল। কিন্ত জার্মানি ও ফ্রান্স চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ব্রাসেলসে ইতালির রাষ্ট্রদূত মাউরিজিও মাসসারি বলছেন, 'অবশ্যই এটা ইউরোপীয়নের একাত্মতার কোন লক্ষণ নয়।
করোনায় ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব করেছিল ইতালি । ইতালীর এ প্রস্তাব নিয়েও বিরোধ দেখা দিয়েছে। জার্মানীসহ নেদারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড এ প্রস্তাবের বিপক্ষে। অপর দিকে স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, লুক্সেমবার্গ এ প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকায় তীব্র ক্ষুব্ধ এবং হতাশ ইতালীর প্রধানমন্ত্রী গিয়াসিপে কোন্টে। তিনি বলেছেন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক হয়ে উপযুক্ত পদক্ষে নিতে না পারে তাহলে এ সংস্থার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভূসিক বলেছেন, এখন আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন যে, ইউরোপীয় সংহতি কাজ করছে না। এটা কাগজে লেখা রুপকথার গল্প ছাড়া আর কিছূ নয়। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক গবেষক সোফিয়া গ্যাস্টন বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে বলছেন, ''নিয়ম অনুসারে বিশ্বের দেশগুলো সবাই মিলে এক সাথে সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে দেশগুলো অত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।
২৫ মার্চ গ্রুপ সেভেন সদস্য দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘উহান ভাইরাস’ শব্দটি যোগ করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফলে যৌথ বিবৃতি বাতিল হয় এবং বিভক্তি সৃষ্টি হয়। করোনা ভাইরাসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহান ভাইরাস, চীনা ভাইরাস আখ্যায়িত করাকে চীনা পরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে সরাসরি বর্ণবাদী আচরন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
করোনর কারনে কূটনৈতিক সম্পর্ক সবচেয়ে তিক্ত আর তীব্র আকার ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে। করোনা নিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ব্লেম গেমে শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘও জড়িয়ে পড়েছে। ৭ এপ্রিল হোয়াউট হাউজে নিয়মিত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীন ঘেষা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় অর্থ প্রদান বন্ধেরও হুমকি দেন। ট্রাম্প বলেন, সংস্থাটির কাছে আগেই অনেক তথ্য ছিল। কিন্তু করোনা যে এভাবে বিপজ্জনক রুপ নিতে পারে সে বিষয়ে আগে থেকে সংস্থাটি সতর্ক করেনি। অথচ তাদের কয়েক মাস আগেই সতর্ক করা উচিত ছিল। তাদের আগেই এ বিষয়ে জানা উচিত ছিল। সম্ভবত তারা জানতেও পেরেছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রতি খুবই বন্ধুভাবাপন্ন ছিল।
করোনা ভাইরাস নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রাথমিক পর্যায়ে চীন করোনা ভাইরাস বিষয়ে তথ্য গোপন করেছে। এ কারনে ভাইরাসটি এভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে সহায়ক হয়েছে।
অপর দিকে চীন প্রমান করার চেষ্টা করে চীনে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ময়না তদন্তে তা প্রমানিতও হয়েছে। তারপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে উহানে একটি মিলিটারি গেমে ৩০০ মার্কিন সৈন্য যোগ দেয়। তাদের মাধ্যমে উহানে করোনা ভাইরাসের আগমন ঘটতে পারে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে চীনের বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল উইপনস ওয়ার বা জীবানু অস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে তা সরাসরি বলেনি। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ এটিকে একটি জীবানু অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। হাইব্রিড ওয়ার এটাকের অধীনে ঘটেছে বলে মনে করে। এরপর চীন এর বিরুদ্ধে পিপলস ওয়ার ঘোষণা করে। ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াওপিং এর সংস্কার শুরুর পর এই প্রথম বারের মত বেইজিং প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি এ ভাইরাসকে ডেমন, ডেভল বা দানব ও শয়তান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চীনা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ডেভল বা শয়তান মানে সাদা শয়তান বা বিদেশী শয়তান বোঝানো হয়ে থাকে।
করোনার কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়েছে ইরানের। ইরানের পক্ষ থেকেও করোনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হয়েছে। অপর দিকে করোনায় বিপর্যস্ত হওয়ার সময়ও ইরানসহ আরো বিভিন্ন দেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবরোধের সমালোচনা হয়েছে। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের আহবান জানানো হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা কানেও তোলেনি। বিশ্বব্যাপী চলা এ দুর্যোগের মধ্যেও ট্রাম্প ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে হাজির করার জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।
করোনা ভাইরাস চিকিৎসায় পরীক্ষাকৃত ম্যালেরিয়া বিরোধী ঔষধ রপ্তানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারত এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার না করলে আমরাও ভারতকে দেখে নেব। ভারত আমাদের কাছ থেকে অনেক বানিজ্য সুবিধা নিয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে সেসব দেখে নেব। ট্রাম্প বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ভারতের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নরেন্দ্র মোদীর উচিত ছিল আমার সাথে কথা বলার । কিন্তু তিনি তা করেননি। এ নিয়ে ঘনিষ্ট মিত্র ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যরকম মনোভাবের প্রকাশ ঘটে
মোদী -ট্রাম্প ছিল বলা চলে গলায় গলায় খাতিরের বন্ধু। মাত্র দেড় মাস আগেও ট্রাম্প ভারত সফরের সময় দুইজন একে অপরকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। করোনায় মুহর্তে সব যেন উল্টে যায় । ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কঠোর হুশিয়ারির পর কোনো দেরি না করে মোদী সরকার আবার ম্যালেরিয়া বিরোধী ওষুধ রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
শুধু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সর্ম্পক নয়, রাশিয়ার সাথে ইউরোপের দেশগুলোর সর্ম্পকের ক্ষেত্রেও করেনার প্রভাব পড়ছে। করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত ইতালি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাহায্য পাঠিয়েছে রাশিয়া । এ নিয়ে চলছে নানা ধরনের বিতর্ক। যেসব লরি ও বিমানে করে রাশিয়া ইতালিতে সাহায্য পাঠিয়ে তাতে লেখা রয়েছে ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’। অভিযোগ উঠেছে করোনা ভাইরাস নিয়ে রাশিয়া ইউরোপে অবিশ্বাসের বীজ বপন করছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জার্মানি । চীন থেকে ২ লাখ ফেস মাস্ক জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল থাইল্যান্ড এয়ারপোর্টে তা আটক করা হয়। এরপর সেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। মাস্কগুলো চীনে তৈরির জন্য অর্ডার দিয়েছিল জার্মানি। চীনে অবস্থিত মার্কিন কোম্পানী থ্রিএম এগুলো তৈরি করে। ট্রাম্পের এ আচরণকে বার্লিন মেয়র দুই রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অনেক রাষ্ট্রের অনেক ধরনের অভিযোগ উঠছে শুরু থেকে। তথ্য গোপন ছাড়াও চীনের সরকারের দেয়া মৃত্যুর সংখ্যাও অনেকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। অনেক পশ্চিমা গনমাধ্যমে বলা হয়ে,ে চীনে আরো অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। লন্ডনের ডেইলি মেইল, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলার চেষ্টা চলছে চীনে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে মারা গেছে। এ ছাড়া চীনের উহানের একটি ল্যাব থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। এসব খবর চীনের সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতিতে যেমন ভূমিকা পালন করছে তেমনি সাধারণ জনসাধারনের মনেও নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনের অনেক সমালোচনা হলেও ভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত চীন আর্দশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দ্রুত ভাইরাসের লাগাম টানতে সক্ষম হওয়ায় চীনের প্রশংসাও চলছে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন দেশে চীনের চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো বিষয়েও প্রশংসা করা হয়েছে। মেডিকেল সরঞ্জাম, টেস্টিং কিটসহ চীনা চিকিৎসকদের একটি টাস্কফোর্স ইতালীতে পাঠিয়েছে চীন। ইতালির সামাজিক মাধ্যমে চীনের প্রশংসার বন্যা বইছে এ ঘটনায়। চীনকে ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যাশট্যাগ চালু করা হয়েছে।
তবে চীন বিষয়ে ব্রাজিলের অবস্থান বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার চীন। এরপরও করোনা নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের তিক্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। সম্প্রতি ব্রাজিলের শিক্ষামন্ত্রী আব্রাহাম ব একটি টুইটে অভিযোগ করেছেন যে, চীনামন্ত্রী তাকে বর্ণবিদ্বেষী বলেছেন। এর জবাবে ব্রাসিলিয়ার চীনা দূতাবাস বলেছেন, এ ধরণের বক্তব্য খুবই অযৌক্তিক, ঘৃণ্য এবং সেখানে বর্ণবাদী সুর রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর চীন থেকে ভেন্টিলেটর ও চিকিৎসা সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছে ব্রাজিলের স্বাস্থ্য বিভাগ।
অপরদিকে করেনা ভাইরাসের মধ্যে কাতার আর মিশরের মধ্যে পুরানো দ্বন্দ্ব আবার সামনে চলে এসেছে। কাতরে মিশরীয় যে অভিবাসী শ্রমিকরা আটকে পড়েছে তাদের বিশেষ বিমানে করে ফেরত পাঠাতে চায় দোহা। কিন্তু সিসি সরকার তাতে রাজি হচ্ছে না।