করোনাভাইরাসের তা-বে বিশ্ব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। তবে ভয়াবহ এ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো বেশিদিন চলবে না। তাতে কী, করোনার হানা থেমে গেলেও তার নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী। করোনা বিশ্ব অর্থনীতিকে ল-ভ- করে দিয়েছে। তাই করোনা পরবর্তী বিশ্বে প্রতিদিন হয়তো আমাদের দেখতে হবে অনাহারে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি মানুষ বেকার হয়ে দরিদ্র হয়ে পড়বে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, অর্থনীতি আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে। ত্রিশের দশকের চেয়েও ভয়াবহ মন্দা বিশ্বকে গ্রাস করবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
করোনা সঙ্কটে দরিদ্রদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে অন্তত তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকারের আর্থিক সহায়তায় বিশ্বে অন্তত ১০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় ডব্লিউএফপি। তার মধ্যে অন্তত ৩ কোটি মানুষ খাবার না পেলে অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। জীবন বাঁচাতে হলে তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি থমকে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ ডব্লিউএফপিকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। আর এতে করে বিপর্যয় আরো বেড়ে যাবে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে দিনে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। সে কারণে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গৃহীত পরিকল্পনার সাথে অর্থনীতির বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে।
ডব্লিউএফপি বলেছে, করোনার কারণে বিশে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে এবার দ্বিগুণ বা ২৬ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
করোনা মহামারি বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিবে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম দেশ-জাতি নির্বিশেষে বৈশ্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাবে।
অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে ১৯৯০ দশকের আগের পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারে বলেও সংস্থাটি আশঙ্কা করছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা আরও করুণ হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
অক্সফামের মতে, ধনী দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হয়তো কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে; কিন্তু, উন্নয়নশীল দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি চাঙ্গা না হলে উন্নত দেশগুলো তাদের বিনিয়োগের তেমন সুফল পাবে না।
করোনার তা-ব থামাতে লকডাউন হয়ে গেছে অধিকাংশ দেশ ও শহর। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তাতে বিশ্বে মোট কর্মক্ষম মানুষের ৮১ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও। জাতিসংঘের এই সহযোগী সংগঠন বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট বিশ্বে আর আসেনি। তবে বছরের শেষ ছয়মাসে অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়ালে এবং কার্যকর নীতিকৌশল অবলম্বন করা গেলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
করোনা মহামারির কারণে এ বছর সারাবিশ্বে রেমিট্যান্স কমবে ২০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে কমবে ২২ শতাংশ। বাংলাদেশে গত বছর প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগের বছরের চেয়ে যা ১৮ শতাংশ বেশি ছিল। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর বাংলাদেশে রেমিট্যান্স কমে ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স কমবে।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির কী দশা হবে, তার ভয়ংকর সব পূর্বাভাস এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ দেশভিত্তিক জিডিপি বৃদ্ধির হতাশাজনক পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। ২০১৯ এ কোন দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কেমন ছিল, ২০২০-তে কেমন হতে পারে এবং করোনা-উত্তর সময়ে অর্থনীতি বৃদ্ধির হার কেমন হতে পারে, তার আগাম পুর্বাভাস দিয়েছ আইএমএফ। তাতে দেখা যাচ্ছে, উন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেরই ২০২০ সালে ঋণাত্মক বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
আইএমএফ বলেছে, করোনার হানায় বিশ্বে মহামন্দার পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। এবার ১৭০টি দেশের কোনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না।
দেশভিত্তিক ছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির একটা দিকনির্দেশও রয়েছে আইএমএফের এই পূর্বাভাসে। তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। সেখান থেকে এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সেই হার নেমে যেতে পারে ৩ শতাংশ ঋণাত্মক বৃদ্ধিতে । এর মানে হলো বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি তো হবেই না, বরং ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। তবে ২০২১ সালে বৃদ্ধির হার হতে পারে ২০১৯-এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫.৮ শতাংশ।
আইএমএফ জানিয়েছে, গত ৬০ বছরের মধ্যে চলতি বছরে প্রথমবারের মতো এশিয়া মহাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে এ অঞ্চলের সেবাখাত এবং প্রধান রফতানি খাতগুলো ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
উন্নত দেশগুলির মধ্যে আমেরিকায় ২০১৯ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ২.৩ শতাংশ। আইএমএফ বলেছে, ২০২০ সালে সেই হার হতে পারে মাইনাস ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ইউরোপ অঞ্চলের মধ্যে ইটালি, ফ্রান্স, স্পেনে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। ফলে অর্থনীতিতেও তার ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে আইএমএফ। ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি হবে মাইনাস ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ।
ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলি বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ যেখান থেকে ছড়িয়েছিল সেই চীনের অবস্থা কিন্তু ততটা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই পূর্বাভাস আইএমএফের। এই পরিস্থিতিতেও চীনের জিডিপি বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হবে না এ বছর। ২০১৯ এ চীনে বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এ বছর সেটা নেমে আসতে পারে ১ দশমিক ২ শতাংশে। আর ২০২১-তে আবার পৌঁছে যেতে পারে ৯ দশমিক ২ শতাংশে।
অধিকাংশ দেশেই এ বছর ঋণাত্মক বৃদ্ধির পূর্বাভাস হলেও ভারতে তা হবে না বলে মত আইএমএফের। ২০১৯-এর জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে নেমে পৌঁছে যেতে পারে ১ দশমিক ৯ শতাশে। তবে ২০২১ সালে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
আইএমএফের হিসেবে কার্যত সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি হয়েছিল ২০১৯ সালে। এ বছর করোনার প্রভাবের মধ্যেও সেই হার ২ শতাংশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে বাংলাদেশ। আর ২০২১ সালে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। পাকিস্তানের এ বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে মাইনাস ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৩ দশমিক ৩ এবং ২০২১ সালে হবে ২ শতাংশ।
রাশিয়ায় ২০১৯ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ, এ বছর সেটা দাঁড়াতে পারে মাইনাস ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সৌদি আরবের জিডিপি এ বছর নেমে যেতে পারে মাইনাস ২ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত।
আইএমএফ এর মতে, মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।
ফলে করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতির অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে।
গত দুই মাসে বিশ্ব অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছে। এটা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চাইতেও ভয়াবহ। কেউ কেউ বলছে ১৯৩০ এর দশকে যে বিশ্ব মহামন্দার সূচনা হয়েছিল, এবারের অর্থনৈতিক সংকট সেটাকেও ছাড়িযে যাবে। এর আগের দুটি সংকটে শেয়ার বাজারে দর পড়ে গিয়েছিল ৫০ শতাংশ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকহারে দেউলিয়া হতে শুরু করেছিল। বেকারত্ব দশ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল তিন বছর সময় ধরে। আর করোনাভাইরাসের বিশ্ব মহামারি শুরু হওয়ার পর এবারের অর্থনৈতিক ধসটা ঘটেছে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার বিশ শতাংশ পড়তে সময় লেগেছে মাত্র ১৫দিন। এত দ্রুত আর কখনো মার্কিন শেয়ার বাজার এতটা পড়েনি। বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভ মানচিন। এর মানে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে একজন কাজ হারাবেন।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের প্রফেসর নুরিয়েল রুবিনি যে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, তা রীতিমত রক্ত হিম করা। তিনি বলছেন, ১৯৩০ এর বিশ্ব মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও গোটা পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। তিরিশের দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশনের’ চাইতেও ভয়ংকর এক অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে।
ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব সারে’র গবেষক সাইমন মেয়ার বলছেন, আগের অর্থনৈতিক সংকটগুলোর সঙ্গে এবারের সংকটের একটা বড় তফাৎ আছে। যখন অর্থনীতিতে এরকম সংকট তৈরি হয়, তখন সরকার নিজেই বেশি করে অর্থ খরচ করতে শুরু করে, যাতে মানুষের পকেটে টাকা যায় এবং লোকে বেশি করে জিনিসপত্র কেনা শুরু করে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়, মন্দা কাটতে শুরু করে। কিন্তু এবারের সংকটের কারণটাই হচ্ছে সরকার নিজেই সব অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ করে দিয়েছে লকডাউনের মাধ্যমে। অর্থাৎ সরকারের নীতির লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনীতিকে আপাতত নির্জীব রাখা।
লকডাউন যখন উঠে যাবে, পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু হবে, তখনও অর্থনীতিতে সরকারের এই বিরাট ভূমিকা অনেকদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে। কোন কোন অর্থনীতিবিদের মত হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহন সামনের বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে।