উপসাগরীয় দেশগুলো আমাদের দেশে 'তরল সোনার দেশ' কিংবা 'পেট্রোডলারের দেশ' হিসেবেই পরিচিত। তাদের মাটির তলায় আছে অঢেল তেলের ভান্ডার। সেই তেল রফতানি করে তাদের নাগরিকজীবনে এসেছে অভাবনীয় সমৃদ্ধি। মাটির তলার তেলসম্পদ একদিন ফুরিয়ে যাবে - এটা অন্য সবার মতো উপসাগরীয় দেশগুলোও জানতো। তাই তেলনির্ভর অর্থনীতির দিনশেষের করণীয় নিয়ে তারা নিজেদের মতো করে কিছু-কিছু প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছিল। কিন্তু তারা অথবা অন্য কেউই যেটা জানতো না বা কল্পনাও করতো না যে একদিন এক ঝড়ো হাওয়া এসে তেলের দামকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনবে, বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি হবে নিম্নমুখী আর তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের দেখতে পাবে অনেকটা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অবস্থায়।
উপসাগরীয় দেশগুলোকে এমন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে একদিকে মাটিতে লুটিয়ে পড়া তেলের দাম, অন্যদিকে করোনা মহামারীর অপ্রতিহত গতি। তেলের দরপতন এসব দেশ আগে দেখেনি, এমন নয়। ২০১৪ সালেও সর্বশেষ এ অভিজ্ঞতা তাদের হয়। সে-সময় উপসাগরীয় দেশগুলো অর্থাৎ সউদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমীরাত পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা ব্যবস্থা নেয়। এসব ব্যবস্থার মধ্যে ছিল বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, নতুন-নতুন ট্যাক্স চালু এবং তেলনির্ভর অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণে নানা নীতিমালা প্রণয়ন।
অবশ্য এ দুরবস্থা কেবল যে উপসাগরীয় দেশগুলোর একার, তা নয়। করোনা মহামারীর আঘাতে গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিই প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং বেশিরভাগ দেশই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে চাঙ্গা করতে প্রণোদনা দিচ্ছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই অনিবার্য কিন্তু বেদনাদায়ক সংস্কারে শামিল হওয়ার কোনো সুযোগ উপসাগরীয় দেশগুলোর নেই। কেন নেই - বুঝতে হলে ওসব দেশের শাসনব্যবস্থার দিকে একটু নজর দিতে হবে।
উপসাগরীয় এলাকার সবগুলো দেশই এখন পর্যন্ত শাসিত হয় কর্তৃত্ববাদী রাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এসব দেশে গণতন্ত্র নেই, জনগণের নেই পছন্দমতো সরকার বেছে নেয়ার বা পরিবর্তনের স্বাধীনতা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসন টিকিয়ে রাখতে তথা জনগণের মুখ বন্ধ রাখতে তেল বিক্রির টাকায় তাদের জন্য করেছে বিলাসব্যসনের ব্যবস্থা। ওসব দেশের মানুষ এ বিলাসী জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কারের নামে যদি এসব ভোগবিলাস কাটছাঁট করা হয়, তাতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে। রাজতন্ত্র এ ঝুঁকি কেন নিতে চাইবে?
প্রথমে আসা যাক সউদি আরবের কথায়। এটি উপসাগরীয় এলাকার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বিশ্বের সর্বাধিক তেল উৎপাদক দেশ। রাজতান্ত্রিক এ দেশের শাসক বাদশা সালমান হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি নামেমাত্র। দেশ চালান আসলে তাঁরই ছেলে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তরুণ ও অনভিজ্ঞ যুবরাজ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত কয়েক বছরে সউদি আরবে বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে।
২০১৫ সালে ইয়েমেনে সাথে এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সউদি আরব, যে যুদ্ধকে বলা হচ্ছে আনউইনেবল বা বিজয়-অযোগ্য। এ যুদ্ধের পরিণতিতে ইয়েমেন নামক দেশটির মানবিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে গুরুতর বিপর্যয়ের দিকে মোড় নিচ্ছে। করোনা ভাইরাস মহামারী শুরুর পর সউদি সরকার ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এ যুদ্ধবিরতি যুদ্ধ অবসানে সউদি আরবকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যেমন, তেমনি ইরানের সাথে শীতল দ্বন্দ্বে জড়িয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সউদি অর্থনীতি। শীতল এ দ্বন্দ্ব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সউদি তেলক্ষেত্রে এক ড্রোন হামলার পর। অনেকে ওই হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে থাকেন। ওই হামলায় সউদি আরবের তেল সরবরাহের ৫০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ, 'ওয়াশিংটন পোস্ট'-এর সউদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগীর হত্যা এবং সউদি এলিট ও সিভিল সোসাইটির ওপর পরিচালিত দমনপীড়ন কেবল বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরই সন্ত্রস্ত করেনি, দেশটির ভাবমূর্তিও গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০১৯এ বলা হয়, সউদি আরবে ফরেইন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই ২০১৭ সালের এক দশমিক চার মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে তিন দশমিক দুই মার্কিন ডলার হয়েছে। তবে তা ২০০৮ সালের তুলনায় অনেক কম। ওই বছর সউদি আরবে ফরেইন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই হয় সর্বাধিক - ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রিপোর্টে বলা হয়, এফডিআইর এ নিম্নগামিতার জন্য ''রাজনৈতিক কারণ এবং তেলের স্বল্প মূল্যই বহুলাংশে দায়ী''।
২০১৯ সালে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পরোক্ষ নেতৃত্বে পরিচালিত সউদি সরকার দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেট ঘোষণা করে। ২৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ বাজেটের লক্ষ্য ছিল সংস্কার ও বিনিয়োগ কর্মসূচিগুলোকে এগিয়ে নেয়া। তবে তার বেশিরভাগই ছিল তেলের অুনমান নির্ভর মূল্যভিত্তিক, যা শেষ পর্যন্ত টিকেনি।
সউদি অর্থনীতিকে 'আধুনিকীকরণের' লক্ষ্যে 'ভিশন-২০৩০' ঘোষণা করেছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য 'শ্বেত হস্তীতে পরিণত হয়। আর বর্তমানে করোনা মহামারী সউদি আরব ও বিশ্বকে যেভাবে গ্রাস করেছে, তাতে পুরো পরিকল্পনাটিকে মরীচিকা বলেই মনে হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সউদি সরকার যন্ত্রণাদায়ক কৃচ্ছ্রতা নীতি অবলম্বনের পথ ধরেছে। এর অংশ হিসেবে স¤প্রতি ভ্যাটের হার তিন গুণ বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ দুই বছর আগে সউদি আরবে ভ্যাট চালু করা হয়েছিল তেল খাত থেকে আসা রাজস্বের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা বলে। সেই ভ্যাট এখন ভোক্তাদের খরচের লাগাম টেনে ধরছে।
এ বছর সউদি আরবের পর্যটন এবং হজ-উমরাহ খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হজ্ব উমরাহ খাত থেকে প্রতি বছর দেশটির আয় হতো ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটা সেদেশের নন-অয়েল জিডিপি-র ২০ শতাংশ এবং মোট জিডিপি-র প্রায় সাত শতাংশ।
আইএমএফ-এর ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে সউদি আরবের আসন্ন অর্থনৈতিক দুর্দিনের একটি কঠিন ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশটির মোট অর্থসম্পদের মূল্য জিডিপি-র শূন্য দশমিক এক শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৮ সালের পূর্ববর্তী চার বছর ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় আসন্ন ভবিষ্যতে সউদি আরব পরিণত হবে একটি ঋণগ্রস্ত দেশে, এমনকি যদি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারেও পৌঁছায়। চলতি বছরের গোড়ার দিকে আইএমএফ পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, উপরে উলেখিত চার বছরে ছয়টি উপসাগরীয় দেশের মোট অর্থসম্পদের মূল্য ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে গেছে।
এবার তাকানো যাক সংযুক্ত আরব আমীরাত ও কাতারের দিকে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতের অর্থনীতিই সবচাইতে বহুমুখী। এর জিডিপি-র ৭১ ভাগেরও বেশি আসে তেলবহির্ভূত বিভিন্ন খাত থেকে। তবে সব কিছুই ব্যাপকভাবে নির্ভর করে তেলের বাজারের ওঠানামার ওপর। কাতারের চিত্র অনেকটা একই রকম।
দুবাইর অবস্থাও ভালো নয়। ব্রিটেনের একটি কন্সালটেন্সি ফার্ম গত মাসে তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, দুবাই ২০০৯ সালের মতো একটি সঙ্কটের আশঙ্কায় এবং তা থেকে উদ্ধারের জন্য প্রতিবেশী আমীরাত আবু ধাবির অর্থসাহায্যের আশায় আছে। রিপোর্টে বলা হয়, করোনা দমনে যে অর্থ ব্যয় হবে তা দুবাইর অর্থনীতিকে তীব্রভাবে আক্রান্ত করবে। এমনিতেই দুবাইর ঋণের পরিমাণ তার জিডিপি-র ৮০ ভাগের বেশি হয়ে গেছে। এ সঙ্কট কাটাতে আবু ধাবি হয়তো আবারও সাহায্য দেবে। কিন্তু এখানেও ২০০৯ সালের মত ঘটনা ঘটার ভয়টা থেকেই যায়। সেবারও সাহায্য এসেছিল, কিন্তু ধীরে। এবারও তেমনটি হলে বিপর্যয় নেমে আসবে।
দুবাইর সামনে এখন তিনটি হুমকি - লকডাউনের কারণে পর্যটক কমে যাওয়া, তেলের কম মূল্য এবং অভিবাসীদের দুবাই ছেড়ে চলে যাওয়ার ঝুঁকি। আমীরাতের একটি রেটিং এজেন্সির মতে, নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক টানাপোড়েন দুবাইয়ে সবচাইতে বেশি। তাদের এখন আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
উপসাগরীয় দেশ কাতারেও করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রতিদিন কম-বেশি এক হাজারের মতো মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় লকডাউন করা হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে শপিং ম্যলগুলো। ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার শিকার হয়েছে সেদেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা কাতার এয়ারওয়েজ। তারা লে অফ ঘোষণা করেছে।
কাতারের প্রধান পণ্য ত্লে ও তরলীকৃত গ্যাস। করোনা মহামারীর কারণে দু'টোরই চাহিদা এখন নিম্নতম পর্যায়ে। এর ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে দেশটির অর্থনীতিকে।
এতসব নেতিবাচক খবরের মধ্যেও কাতারের জন্য যা খানিকটা হলেও ইতিবাচক, তা হলো করোনা মহামারীর কারণে জাপান গ্রীস্মকালীন অলিম্পিক বাতিল ঘোষণা করলেও কাতার এখনও বিশ্বকাপ ফুটবল বাতিলের অবস্থায় পৌঁছায়নি। কারণ, আসরটি হওয়ার কথা ২০২২ সালে। ততো দিনে করোনা মহামারীর অবসান ঘটবে - এমন আশা তো করাই যায়।
এবার তাকাই কুয়েত ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকে। কুয়েতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কারফিউ জারি করে রেখেছে সরকার। এতে সেদেশের মানুষকে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। কারফিউ শিথিল করার কোনো লক্ষণও এখনও দেখা যাচ্ছে না।
করোনার কারণে তেলের দরপতনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্বিপাক সামাল দিতে কুয়েত সরকার বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে এবং স্বাধীনভাবে খরচ করতে না-পারায় যেসব সেক্টর সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তার মধ্যে আছে উড়োজাহাজ চলাচল, সেবা খাত এবং আবাসন খাত।
এ ছাড়া রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় দু'টোই কমে গেছে। সব মিলিয়ে তেলসমৃদ্ধ কুয়েতের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াল এক অনিশ্চয়তা।
এমন দুর্দিনে কেমন আছে বাহরাইন ও ওমান? বিভিন্ন রেটিং এজেন্সি বলছে, এ দুই দেশের অবস্থা এমন যে টিকে থাকতে হলে এদের প্রয়োজন হবে উপসাগরীয় এলাকার অন্য দেশগুলোর সহায়তা।
উভয় দেশ জিডিপি-র ৩০ শতাংশ প্রনোদান প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এছাড়া বাহরাইন ৩০ শতাংশ এবং ওমান ১০ শতাংশ ব্যয় হ্রাসেরও ঘোষণা দিয়েছে। জনকল্যাণমূলক অনেক কর্মসূচিও কাটছাঁট করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে