করোনায় চুরমার মিয়ানমারের অর্থনীতি

করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আগে সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের তরমুজ কিনছেন চীনা ক্রেতা - ফ্রন্টেয়ার মিয়ানমার ডটনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৬ মে ২০২০, ০৪:২৪

করোনার আঘাতে চুরমার হওয়ার পথে মিয়ানমারের অর্থনীতি। দেউলিয়া হওয়ার পথে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দেশটির ব্যাংকিং খাত ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারনে মায়মনারের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এর মধ্যে চ‚ড়ান্ত আঘাত করেছে করোনা। করোনা থেকে দেশটি রক্ষা পেলেও করোনার বৈশ্বিক প্রভাবে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটি।

করোনা মূলত আঘাত করেছে মায়নমারের অর্থনীতিতে। কারোনার কারনে বিপর্যস্ত হতে চলেছে মিয়ানমারের গার্মেন্টস খাত। ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছে অনেক প্রবাসী শ্রমিক। স্থবিরতা নেমে এসেছে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। বিপর্যস্ত পর্যটন খাক। বন্ধ হয়ে গেছে বিদেশী বিনিয়োগের বড় বড় অনেক প্রকল্প। নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশটির স্বাস্থ্য খাতে। অপর দিকে করোনা মোকাবেলায় দেশটি যে প্রনোদনা বিল ঘোষণা করেছে তা বিতরনের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি হিসেবে মায়ানমারে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৮১ জন। মারা গেছে ৬ জন। তবে মায়ানমারের সরকারি এ তথ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কারন দেশটিতে পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া এর আগে মায়ানমার সরকার দাবি করেছিল দেশটিতে কোনো করোনা নেই এবং এই দাবি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মায়ানমারে অনেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে এবং তাদের পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। দি ডিপলোম্যাটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০ সালের শুরুর দিকের তথ্য অনুসারে গোটা মায়ানমারের হাসপাতালে মাত্র ১৮০টি আইসিউ বেড রয়েছে। ১৮০ টি আইসিইউ বেডসহ মোট ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেড মাত্র ৬০০টি। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মায়ানমারে করোনা পরীক্ষার যে ক্ষমতা তাতে দৈনিক ৩৫০ জনের করোনা টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে।

করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়ে মায়ানমারে স্বস্তি বিরাজ করলেও স্বস্তি নেই দেশটির অর্থনীতি নিয়ে। মায়ানমারে করোনার মূল প্রভাব পড়েছে মূলত অর্থনীতিতে। শিল্প ও পর্যটন উভয় খাতেই এর প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড আ আইএমএফ এ বছর মায়ানমারের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছিল ৬ দশমিক ৪ ভাগ। কিন্তু এপ্রিলে তা নামিয়ে নির্ধারণ করেছে ১ দশমিক ৮ ভাগে। সামরিক জান্তা ২০১১ সালে আধা সামরিক প্রেসিডেন্ট থেন সেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর গত ১০ বছরে এটি হবে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি।

মিয়ানমারের শ্রম মন্ত্রণালয় এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে মায়ানামরে ৪৪ লাখ বিদেশী পর্যটক আসে। এর মাধ্যমে দেশটি আয় করেছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । মায়ানমারের পর্যটন খাতে নিয়োজিত রয়েছে ১৪ লাখ শ্রমিক। এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২০ সালে মায়ানমার পর্যটন খাত থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের আশা ছিল। কিন্তু করোনার কারনে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ার পথে দেশটির পর্যটন খাত। বেকার হয়ে পড়বে এ খাতে নিয়োজিত ১৪ লাখের মত জনবল।

সরকারি তথ্য অনুসারে মে মাস পর্যন্ত করোনার কারনে ৬০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। শ্রম মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী সেক্রেটারি মিও অং জানিয়েছেন, অর্ডার বাতিলের কারনে ১৫০ টির অধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। সরকারি হিসেবে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত ৪৬ হাজারের অধিক প্রবাসী শ্রমিক ফেরত এসেছে করোনার কারনে। তবে সরকারি হিসেবের বাইরেও আরো হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছে।
মায়ানমার গার্মেন্টস খাতে ৭ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। এ খাতে রপ্তানি আয় ৪ দশিক ৬ বিলিয়ন ডলার। দেশটির গার্মেন্টস খাতের কাচামালের ৯০ শতাংশ আসে চীন থেকে। মধ্য এপ্রিলে কাচামাল সরবরাহ শুরু হলেও দেশটির গার্মেন্টস পন্যের চাহিদা ধ্বস নেমেছে বিশ্ব বাজারে। মায়ানমারের গার্মেন্টস পন্যের ৭০ ভাগ রপ্তানি করে ইউরোপে। আর করোনায় বিধ্বস্ত ইউরোপের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময় লাগবে।

করোনার কারনে ধ্বস নামবে দেশটির বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। মায়ানমারে অনেক বড় বড় প্রকল্পে চীন, থাইল্যান্ড, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান এবং ভারতের বিনিয়োগ কর্মসূচী রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব দেশের অনেক প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। অনেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়া শুরু করেছে।

অনেক প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে দিয়েছে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন। চীন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়ার বিভিন্ন প্রকল্পও স্থগিত এবং পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। ১০ বিলিয়ন ডলারের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগ করেছিল থাইল্যান্ডের ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট। কিন্তু করোনায় এ প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মায়নমারে তাদের প্রকল্প পিছিয়ে দিয়েছে। ১ বিলিয়ন ডলারের ইয়াঙ্গুন এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে প্রকল্পের বিডিং থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে চীনের জেনেসিস জেমস কনসোরটিয়াম। চীন, জাপান এবং দক্ষিন কোরিয়ার প্রতিযোগীরা এ প্রকল্প পেছানো দাবি জানিয়েছে করোনার কারনে।

করোনায় ইয়াঙ্গুন-এর একটি চিত্র। ছবি : এএ ডটকম
করোনায় ইয়াঙ্গুন-এর একটি চিত্র। ছবি : এএ ডটকম

 

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি চেষ্টা করছেন দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক বাচাতে ধ্বংসের হাত থেকে। এপ্রিলের শেষে সুচী সরকার ঘোষণা করেছে ১৫ পৃষ্ঠার কোভিড -১৯ ইকনোমিক রিলিফ প্লান। তবে এ পরিকল্পনা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছ‚ নেই। এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে চলছে সমালোচনা।

মায়ানমারে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭ হাজার কোটি টাকার রিফিল প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এ ফান্ড পুরোপুরি সরকারি অর্থে গঠন করা সম্ভব হয়নি। সুচি জনগনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন এ ফান্ডে অর্থ দানের জন্য। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকেও সহায়তা নেয়ার চেষ্টা চলছে । ১৫ পৃষ্ঠার রিলিফ প্লানে সুচি বলেছেন, অনিবার্য অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা এবং অর্থনীতি দ্রæত পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করা এ পরিকল্পনার লক্ষ্য।

করোনার কারনে প্রান্তিক যেসব লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে, যারা চাকরি হারিয়েছে, বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে তাদের মত অসহায় লোকজন সরকারি ফান্ড থেকে সহায়তা পাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব লোকজন সরকারি রিলিফ ফান্ড থেকে সহায়তা পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুচি যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন তার লক্ষ্য ব্যবসায়ীয় সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। ইনকাম ট্যাক্স স্থগিত বা মাফ করাসহ ঋনের ক্ষেত্রে সুদের হার ৩ শতাংশ কমানো হয়েছে ।

আবার কোভিড-১৯ এমার্জেন্সি ফান্ড নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অর্থ বিতরনে অস্বচ্ছতা, বৈষম্য এবং কারা এ ফান্ড থেকে সহায়তা পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত এবং দরিদ্ররা এ ফান্ড থেকে সহায়তা পাবে না বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে কিছ‚ ব্যবসায়ী ভাল আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করেছে। ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ফরেন ইকনোমিক রিলেশনস মিনিস্ট্রির তথ্য অনুসারে দেশব্যাপী মাত্র ৩১০ টি কোম্পানী রিলিফ প্যাকেজ থেকে ঋন পেয়েছে।

ইয়াঙ্গুনে আইটি ফার্মের মালিক জ নেইং বলেন, এমনকি হোটেল এবং কারাখানা মালিকরা এ সহায়তা পাচ্ছে না যদিও তাদের পাওয়া উচিত। সরকারের উচিত সহায়তা নীতিমালা অবিলম্বে পরিবর্তন করা। সরকারি সহায়তা না পেলে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসবে। কোভিড ফান্ডের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ অর্থ সহায়তা, রেশন, ক্ষতিগ্রস্তদের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা বলা হচ্ছে না।

মায়নামারের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে গৃহযুদ্ধ। দেশটিতে সামাজিক কল্যান ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। জনগণের বিরাট অংশ অনিবন্ধিত । এসব কারনে সরকারি সহায়তা কর্মসূচী সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যেমন কঠিন তেমনি প্রকৃত ভুক্তভোগীরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে ।

মায়ানমার সামরিক জান্তা সীমিত যুদ্ধ বিরতি পালন করছে। কিন্তু রাখাইন ও শান প্রদেশকে যুদ্ধবিরতির বাইরে রেখেছে। করোনা প্রতিরোধে সর্বত্র যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান উপেক্ষা করে রাখাইন ও শান রাজ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি চালু রেখেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে করোনার কারনে মুদ্রাস্ফিতি বাড়বে এটি স্বাভাবিক। কিন্ত এটা কমোনা হবে সবচেয়ে বড় সমস্যা।
করোনার কারনে ধ্বংসের আশঙ্কা করা হচ্ছে মায়ানমারের ব্যাংকিং খাত। দেউলিয়া হওয়ার পথে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে মায়নমারে রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারনে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ব্বিস্ত দেশটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এর মধ্যে করোনার আঘাত দেশটির বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে আরো চুরমার করে দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে মায়ানমারে মোট কর্মজীবীর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ৮৩ ভাগ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজে করে। করোনার কারনে এ ধরনের কর্মজীবীরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। করোনার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে বিশ্বব্যাকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে গত ১ দশকে এই প্রথম বেসরকারি ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়ছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে