মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের একক পরাশক্তি। তাই তারা নিজেদের মনে করে, অজেয়। ভাবে, তাদের হারানোর ক্ষমতা পৃথিবীতে কারো নেই। তাদের এ হামবড়া মনোভাব সত্যের কতটা কাছাকাছি, সেটা সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে হালের আফগান যুদ্ধই সাক্ষ্য দেবে। তবে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধই নয়, অর্থনৈতিক যুদ্ধেও মার্কিনীরা প্রায়ই হেরে চলেছে, আজ সে গল্পই শোনাবো
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এবারের বাণিজ্যযুদ্ধটি চীনের সাথে; চীনা কম্পানি হুয়াওয়ে নিয়ে। হুয়াওয়ে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকম কম্পানিগুলোর একটি। মূলত মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের যন্ত্রপাতি তৈরি করে কম্পানিটি। আগে এক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল নকিয়া ও এরিকসনের মতো কয়েকটি কম্পানির। কিন্তু কালে কালে হুয়াওয়ে তাদের ছাড়িয়ে গেছে। স¤প্রতি স্মার্টফোনও তৈরি করতে শুরু করেছে হুয়াওয়ে। বিশ্বে মোবাইল ফোনের বাজারের ১৫ শতাংশ এরই মধ্যে তারা নিজেদের দখলে এনে ফেলেছে।
হুয়াওয়ে কম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন রেন ঝেংফেই। তিনি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির একজন সাবেক অফিসার। মার্কিনীদের আপত্তির সূচনা এখানেই। তারা মনে করছে, হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতা যেহেতু সামরিক বাহিনীতে ছিলেন, তাই তার কম্পানি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি হতে পারে। হুয়াওয়ে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সব প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কাজেই তারা ইচ্ছে করলে একে গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার কাজেও ব্যবহার করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলেছে চীনে গত বছর পাস হওয়া একটি আইন। ওই আইনে চীনের সব কম্পানিকে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে সহযোগিতা করতে বলা হয়।
এরপর আর যায় কোথায় ! যুক্তরাষ্ট্র তার সব বন্ধু দেশকে অনুরোধ করে তারা যেন তাদের ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের ্সরঞ্জাম ব্যবহার না করে। কোনো কোনো দেশ অনুরোধটি রাখলেও অন্য অনেক দেশ সোজা 'না' করে দিয়েছে, ব্রিটেন যার অন্যতম। ব্রিটেনের কাছে এমন অপমানের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন এখন বাণিজ্যযুদ্ধে চীনকে পরাজিত করার তোড়জোড় দ্বিগুণ করেছে। তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এতেও যুক্তরাষ্ট্রের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
যুক্তরাষ্ট্র এখন যে চেষ্টাটি করছে তা হলো, হুয়াওয়েকে রেকেটিয়ার-ইনফ্লুয়েন্সড অ্যান্ড করাপ্ট অরগানাইজেশন বা রিকো আইনের আওতায় ফেলার, যে আইন প্রনীত হয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনের লক্ষ্যে। তারা এতে এমন ব্যবস্থা রাখারও প্রস্তাব করছে যেন হুয়াওয়ে এবং চীনের অপর কম্পানি জেডটিই যদি তাদের উৎপাদনের ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে আমেরিকান প্রযুক্তি ব্যবহার না করে, তাহলে এ দু' কম্পানির কাছে মার্কিন যন্ত্রাংশ বিক্রি করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র আরো চাচ্ছে, বেসামরিক যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত উড়োজাহাজের জেট ইঞ্জিনও যেন চীনের কাছে বিক্রি করা না হয়। অথচ ব্রিটেনের জেনারেল ইলেকট্রিক ও ফ্রান্সের স্যাফরান কম্পানি ২০১৪ সাল থেকেই চীনের কাছে এসব ইঞ্জিন বিক্রি করে আসছে। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার সাথে প্রস্তাবটির কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন না পর্যবেক্ষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত হাঁকডাক করা উদ্যোগে এত কম সাড়া পেতে আর দেখেনি কেউ। বরং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও'ব্রায়ান ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ''ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'' পত্রিকাকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়ে সরঞ্জামে একটা গোপন দরজা খুলে দিল, যা ওই কম্পানিকে পশ্চিমা যোগাযোগব্যবস্থায় গুপ্তচরবৃত্তি করতে সক্ষম করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের সব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে হুয়াওয়ে। বলেছে, এসবের কী প্রমান আছে, যুক্তরাষ্ট্র তা প্রকাশ করুক।
বাস্তবেও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ বিশ্বব্যাপী পরিহাসের পাত্র হয়েছে। অরেঞ্জ কম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিফেন রিচার্ড বলেন, ''আমি দেখতে চাইব এ অভিযোগের প্রমান কী। এ ঘটনা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ইরাক যুদ্ধের কথা। তখন বলা হয়েছিল, ইরাকের হাতে বিপুল পরিমাণ মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে।'' জার্মানির বিখ্যাত 'দার স্পাইজেল' পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ''যে গোপন দরজা কেবল যুক্তরাষ্ট্রই দেখতে পায়''। সম্প্রতি মিউনিখে অনুষ্ঠিত এক নিরাপত্তা সম্মেলনে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তারাও হুয়াওয়ে বর্জনের বিরুদ্ধে ইউরোপকে হুঁশিয়ার করে দেন। হুঁশিয়ারি উচ্চারণকারীদের মাঝে রয়েছেন স্বয়ং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইক এসপার ও স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তাঁরা বলেছেন, ''এমনটি হলে তা আমাদের যোগাযোগ ও গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির সক্ষমতাকে পংঙ্গু করে দিতে পারে।'' তবে মার্কিন নিউজ আউটলেট 'পলিটিকো' সংবাদ শিরোনাম করেছে, ''চীনের ফাইভ-জি বিষয়ে মার্কিন হুঁশিয়ারি কানে তুলছে না ইউরোপ''।
দেশে-বিদেশে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুধু ইজ্জত যাওয়ার দশাই হয়নি, তাদের অনেক কম্পানিও বিপদে পড়তে যাচ্ছে। এই যেমন, বেসামরিক উড়োজাহাজের জেট ইঞ্জিনও যেন চীনের কাছে বিক্রি করা হবে না বলে যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, তা সত্যি হলে দেশেই এ ইঞ্জিন নির্মাণের চীনা উদ্যোগ হোঁচট খাবে। কিন্তু তাতে চীনের একার ক্ষতি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মার্কিন কম্পানি বোয়িংও। কারন বোয়িং তাদের নির্মিত উড়োজাহাজের এক-চতুর্থাংশ বিক্রি করে চীনের কাছে।
মোটের ওপর, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর এমন লেজেগোবরে অবস্থায় আর কখনো পড়েনি কোনো মার্কিন উদ্যোগ। ইসরাইল, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো বন্ধু দেশই হুয়াওয়ে বর্জনের মার্কিন আহবানে সাড়া দেয়নি। হুয়াওয়েকে ব্রিটেনের ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আংশিক নির্মাণের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বয়ং এ নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথে। ট্রাম্প এ সময় জনসনের কাছে রীতিমতো কাকুতিমিনতি করেছেন বলে ৬ ফেব্রুয়ারি খবর দিয়েছে 'ফিন্যান্সিয়াল টাইমস' পত্রিকা। জবাবে ১৪ ফেব্রূয়ারির পরিকল্পিত যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন ব্রিটিশ প্রধাানমন্ত্রী জনসন। জার্মানিও হুয়াওয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
হুয়াওয়ের কাছে মার্কিন সরঞ্জাম বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৯ সালের মে মাসে। কিন্তু তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে জাপান, তাইওয়ান ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকে যন্ত্রাংশ কিনতে থাকে। মার্কিন সরঞ্জাম ছাড়াই হুয়াওয়ে এখন ফাইভ-জি গ্রাউন্ড স্টেশন এবং স্মার্টফোন - দু'টোই তৈরি করছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের সাথে ক্রমাগত হেরেই চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থায় কয়েকটি মার্কিন কম্পানি ব্যবসা না-ছাড়লেও দেশ ছাড়তে চাইছে। এ রকম একটি কম্পানি হলো আরআইএসসি-ভি। এরা স্মার্টফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিকসের উপযোগী ওপেন সোর্স সফটওয়্যার তৈরি করে থাকে। ভবিষ্যতে আরো কড়াকড়ির আশঙ্কায় তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এরকম আরো বেশ কিছু কম্পানি আছে, যারা এশিয়ায় ব্যবসা করে ভালো মুনাফা করছে। এখন চীনের সাথে ব্যবসা করতে দেয়া না-হলে তারা তাদের ব্যবসার একটি বড় অংশ হারাবে। এ অবস্থায় দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে ব্যবসা করা ছাড়া উপায় কী?
এদিকে এশিয়ার বাজার থেকে আমেরিকাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পরিকল্পনা আঁটছে হুয়াওয়ে। এ লক্ষ্যে তারা চিপসেটের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়ার কথা ভাবছে। তেমনটি হলে দুই মার্কিন কম্পানি নভিডিয়া ও কুয়ালকম গবেষণা ও উন্নয়নকাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। তার অর্থ হবে, যে সেমিকন্ডাক্টরের উদ্ভাবক আমেরিকা, সেই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পেই আমেরিকার বারোটা বেজে যাওয়া।
হুয়াওয়ে নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে চীনের কাছে জেট ইঞ্জিন বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছে। জেনারেল ইলেকট্রিক এবং অপর কয়েকটি কম্পানি মরিয়া হয়ে লবিং করছে যেন প্রস্তাবটি পাস না-হয়। প্রস্তাবটি পাস হলে মার্কিন কম্পানি বোয়িং-এর বদলে ইউরোপ থেকে এয়ারবাস কিনবে চীন। আর সেটা হবে এমনিতেই অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা মার্কিন কম্পানি বোয়িং-এর জন্য ''মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা''।
হুয়াওয়ে তথা চীনের সাথে চলমান এ বাণিজ্যযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত হেরে যাচ্ছে এবং একা হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে হুয়াওয়ের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করতে সরাসরি 'না' বলে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। জবাবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ভূয়সী প্রশংসা করেছে এবং সেদেশে আরো বিপুল বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে হুয়াওয়ে।
কঠিন বাস্তবতা হলো, চীন যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে পারার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে - এ জ্বলজ্যান্ত সত্যটা চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই হেরেই চলেছে বিশ্বমোড়ল।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে