মেড ইন চায়নার পরিবর্তে মেড ইন তুরস্ক

‘মেড ইন তুর্কি’ কি ‘মেড ইন চায়না’ কে টেক্কা দিতে পারবে - গ্রেগ বাকের, এএফপি

  • মেহেদী হাসান
  • ৩০ জুন ২০২০, ১৬:০৫

যুক্তরাষ্ট্র সবেচেয়ে বেশি পন্য আমদানি করে চীন থেকে। ২০১৫ সাল থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পন্য সরবরাহকারি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে যত পন্য আমদানি করে তার ২১ ভাগেরও বেশি আমদানি করে থাকে চীন থেকে। ট্রাম্প প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন থেকে পন্য আমদানি কমানোর। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে কাজে লাগাতে ইতোমধ্যে এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ তুরস্ক। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। আজ আমরা জানাবো যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে চীনের পরিবর্তে এসব দেশের সাথে বানিজ্যিক সর্ম্পক বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর নানা উদ্যেগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ বিভিন্ন বিষয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত বিরোধ। চীন থেকে পন্য আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তা এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে সংগ্রহ করতে চায়। তুরস্কের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি নানা বিষয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারন করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল কেনা নিয়ে। এরমধ্যে তুরস্ক বর্তমানে উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিরোধ মেটানোর। ট্রাম্প প্রশাসনের সুরও তুরস্কের প্রতি বর্তমানে নরম হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে যেসব পন্য আমদানি করে তার অনেক কিছুই তৈরি করে তুরস্ক। চীনের বদলে তুরস্ক এসব পন্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রেরও বিভিন্ন পন্যের বাজার চাহিদা রয়েছে তুরস্কে। এ প্রেক্ষিতে দুই দেশ নতুন একটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি পর্যায়ের পাশপাশি দুই দেশের ব্যবসায়ী মহলও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উভয় দেশের বিরোধ মিটিয়ে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার। এ নিয়ে সম্প্রতি টেলিফোনে কথা বলেছেন ট্রাম্প ও এরদোয়ান।

লিন্ডসে গ্রাহাম একজন প্রভাবশালী রিপাবলিকান । তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ। তুরস্ক- আমেরিকান বিজনেস কাউন্সিল তুরস্ককে চীনের বিকল্প সাপ্লাই চেইন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এজন্য তারা বেছে নিয়েছেন রিপাবলিকান লিন্ডসে গ্রাহামের মাধ্যমে। লিন্ডসে গ্রাহাম সম্প্রতি তুরস্কের একটি ওয়েব সেমিনারে অংশ নেন। এই সেমিনারে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাি তুরস্ক উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডিং পার্টনার হওয়ার বিষয়ে নিজেকে তুলে ধরার ।

ওয়েব সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিলো ‘এ টাইম ফর এলাইস টু বি এলাইস : তার্কিশ আমেরিকান গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন’। এতে সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ছাড়াও অংশ নেন লুইজিয়ানার সাবেক সিনেটর ডেভিড ভিটার। ডেভিড ভিটার চীনা পন্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা বিরোধী এবং এর পরিবর্তে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য বৃদ্ধির পক্ষে।

তুরস্ক ব্যবসায়ীরা মনে করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অব্যাহত অবনতির ফলে ভ‚-রাজনৈতিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে । আর তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশ বর্তমানে লাভজনক অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।

করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক অবনিতর ফলে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন থেকে যেসব পন্য তারা আমদানী করে তা এশিয়ার অন্য দেশ থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহল থেকেও এ বিষয়ে দাবি জোরালো হচ্ছে। এমনকি করোনার মধ্যেই চীন থেকে সাপ্লাই চেইন বন্ধ করার কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করা দিকে অগ্রসর হয় ট্রাম্প প্রশাসন। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি নির্ধারক মনে করেন, জরুরি অবস্থার কারনে করোনা সামগ্রীসহ বিভিন্ন চীনা পন্যের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ধারা বহাল রাখা উচিত।
চীন থেকে পন্য আমদানি বন্ধের পাশপাশি চীন থেকে তেলের বাজারও যুক্তরাষ্ট্র অন্যত্র সরিয়ে নিতে চায়। চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমান জ্বালানি তেল কিনে থাকে।

রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনা নিয়ে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবণিত ঘটে ২০১৯ সাল থেকে। এর আগে ২০১৬ সালে এরদোয়ান বিরোধী ব্যর্থ অভুথ্যানে ইন্ধনের অভিযোগে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক অবণিত ঘটে ওবামা প্রশাসানের সাথে। এ অভ্যুত্থানে অভিযুক্ত ফেতুল্লাহ গুলেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। এ ছাড়া তুরস্কের রাষ্ট্রীয় হলব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ইরান বিরোধী নিষেধাজ্ঞা অমান্যের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া ঘিরে তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শীতল অবস্থা বিরাজ করছে। এখন তুরস্ক উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার।

পেন্টাগন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থার তুরস্ক বিরোধী অবস্থান সম্প্রতি উপেক্ষা করতে শুরু করেছে হোয়াইট হাউজ। এর প্রথম নজির সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার। এটি সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক অভিযানের পথ করে দিয়েছে। সিরিয়া ও লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি টেলিফোনে আলোচনা করেন ট্রাম্প ও এরদোয়ান। এ টেলিফোন আলাপের পর এরদোয়ান বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।

তুরস্কের জন্য হোয়াইট হাউজে কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্পের একান্ত অনুগত এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার সম্প্রতি বরখাস্ত করেছেন ফেডারেল প্রসিকিউটরকে। যিনি আদালতে হলব্যাংক মামলার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফেডারেল প্রসিকিউটরকে বরখাস্তের পর হলব্যাঙ্কের শেয়র ৯ ভাগ বেড়ে যায়। কৌশলগত দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সর্ম্পক ঘনিষ্ট হচ্ছে।

তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভবিকরনে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী। বিশেষ করে লিবিয়া হাফতার বাহিনী বিরোধী তুরস্কের ভ‚মিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। এর আগে সিরিয়ায় রাশিয়া সমর্থিত আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে তুরস্কের ব্যাপক ভিত্তিক অভিযান সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত মিত্র ইসরাইলের সাথেও বর্তমানে সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে তুরস্কের। ইসরাইলের জাতীয় বিমান সংস্থার দুটি কার্গো ফ্লাইট প্রতি সপ্তাহে ইস্তাম্বুল-তেলআবিবের মধ্যে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে আঙ্কারা । দশ বছর পর প্রথম বারের মত এ বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। ইসরাইলের এ কার্গো বিমান মেডিকেল সামগ্রী তুরস্ক থেকে নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে।

যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে তুরস্ক পালন করতে পারে গেটওয়ের ভূমিকা। তুরস্ক এ সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। যা দুই দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকেই শুধু সহায়তা করবে না বরং আফ্রিকায় চীনা পরিকল্পনার ও পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক অর্থনৈতিক সহযোগিতাও শক্তিশালী রুপ নেবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এল এন জি এবং কৃষি পন্য আমদানির আগ্রহের কথা জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে হোয়াইট গুডস তথা ওয়াশিং মেশিন, রেফ্রিজারেটরসহ নানা ধরনের গৃহস্থালীর ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী এবং অটোমেটিভ পার্টস আমদানি করতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা সাপ্লাই চেইনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র আসবে যা বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল জায়ান্ট ওয়ালমার্ট ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে পন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে । এখন সময় এসেছে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং সংহতি শক্তিশালী করার। চীন নির্ভর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্তমানে অন্যান্য দেশে দৃষ্টি ফেরাতে শুরু করেছে এবং তুরস্ক সে ক্ষেত্রে একটি ভাল গন্তব্য।

তুরস্ক বর্তমানে রাশিয়া এবং ইরান থেকে লিকুইডিফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যবসায়ী চেষ্টা করছে তুরস্কের এলএনজি বাজারে প্রবেশ করতে। এর মধ্যে অন্যতম হলো লুইজিয়ানা ন্যাচারাল গ্যাস এক্সপোর্ট ইনক। এ প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ মেয়াদে তুরস্কের এলএনজি টার্মিনাল, গ্যাস পাইপ লাইন এবং গ্যাস সংরক্ষানাগারে গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা করছে।

অফিস অব দি ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ এর প্রতিবেদনে চীন -যুক্তরাষ্ট্র আমদানি-রপ্তানির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে যত পন্য আমদানি করে তার ২১ দশমিক ২ ভাগ আমদানি করে চীন থেকে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ৫৫৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পন্য ও সেবা আমদানি করে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ওই বছর চীনে রপ্তানি করে ১৭৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পন্য।

যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে যেসব পন্য আমদানি করে তার এক নম্বরে রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল মেশিনারি। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে ১৫২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইলেকট্রিক্যাল মেশিনারি আমদানি করে। এরপর অন্যান্য মেশিনারি আমদানি করে ১১৭ বিলিয়ন ডলারের। তৃতীয় স্থানে থাকা ফার্নিচার এন্ড বেডিং আমদানি করে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের। খেলনা এবং ক্রীড়া সামগ্রী আমদানি করে ২৭ বিলিয়ন ডলারের। প্লাস্টিক পন্য আমদানি করে ১৯ বিলিয়ন ডলারের।
কৃষি পন্য আমদানি করে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের । চীন হলো যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় বৃহৎ কৃষি পন্য সরবরাবরাহকারি দেশ।

অপর দিকে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০১৮ সালে দৈনিক ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬শ ব্যারেল জ্বালানি তেল আমদানি করে। নতুন বানিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এ জ্বালানি ক্রয় ৫ গুন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমে অবনতির কারনে সবই ভন্ডুল হওয়ার পথে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন চীনকে অবশ্যই অতিরিক্ত ২০০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন পন্য এবং সেবা কিনতে হবে। যদি তারা এটা না করে তাহলে চীনের সাথে বানিজ্য চুক্তি বাতিল করা হবে। চীনও অপেক্ষায় আছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়ার। তবে যুক্তরাষ্ট্র এটি জানে সে কারনে চীনা জ্বালানি বাজারও অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বানিজ্য পার্টনারশিপ বড় ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে। ইতোমধ্যে এ সুযোগ অনেকাংশে গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশি মেক্সিকো। তুরস্ক, কানাডা, জাপানসহ আরো অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের বানিজ্য অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করছে। বানিজ্যিক সর্ম্পক বদলে দিচ্ছে কৌশলগত সর্ম্পক।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে