নরেন্দ্র মোদির শাসনে ভারতের এক সময়ের উদীয়মান অর্থনীতি অস্তগামী হয়ে পড়েছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। ক্রমক্ষয়িষ্ণু সেই অর্থনীতি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস। ভারতের অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটি মারতে যাচ্ছে চীন। ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। সীমান্ত সংঘাতের জেরে দিল্লির বেশকিছু হটকারি সিদ্ধান্ত তাদের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে বলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন।
ভারতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যত গতিধারা তুলে ধরা হবে আজকের প্রতিবেদনে।
গত কয়েক বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি দারুণ সুসময় পার করছিল। তখনও ভারতের অর্থনীতিতে ছিল ব্যাপক মন্দা। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে বেকারত্ব বাড়ছিল লাগামহীন গতিতে। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বেকারত্ব ছিল সবচেয়ে উঁচুতে। এর জেরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কয়েক বছরের আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল।
এসবই ছিল স্বাভাবিক সময়ের চিত্র। এরপরই চলে এলো নজিরবিহীন এক অস্বাভাবিক সময়। করোনা ভাইরাসের থাবায় লন্ডভন্ড হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশটি। প্রতিদিনই আগের রেকর্ড ভেঙে সংক্রমণের রেখা উর্ধমুখী। ভারতে করোনার তান্ডব কবে থামবে কেউ বলতে পারছেন না।
করোনার প্রকোপ যখন সহনীয় পর্যায়ে ছিল, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বলেছে, এ বছর ভারতীয় অর্থনীতি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি তো হবেই না, আগের বছরে অর্থনীতির যে আকার ছিল তা থেকে সাড়ে চার শতাংশ কমে যাবে। জুনে এই পূর্বাভাস দেয় আইএমএফ। এরপর থেকেই দেশটিতে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো ভারতের ভবিষ্যত অর্থনীতির কী পূর্ভাবাস দেয় তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সেটি যে আরও ভয়ঙ্কর হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
প্রকাশের পর আইএমএফের মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলেন, এবার ভারতীয় অর্থনীতি ঐতিহাসিক তলানিতে ঠেকবে।
আরেকটি গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চও জানিয়েছে যে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন মাত্রায় পৌঁছাবে। তাদের হিসেবে চলতি অর্থবছরে দেশটির আর্থিক বৃদ্ধি ৫.৩ শতাংশ হারে সংকুচিত হবে। এর জন্য করোনাভাইরাস সংক্রমণকেই দায়ী করেছে ইন্ডিয়া রেটিংস।
এর আগে গত এপ্রিল বিশ্বব্যাংক জানায়, করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ভারতীয় অর্থনীতি ব্যাপক সংকটের মুখে পড়েছে। আগে থেকে দেশটির অর্থনীতিতে যেসব সংকট ছিল সেগুলো আরও ব্যাপকহারে দেখা দিচ্ছে বলে জানানো হয়।
করোনা সংকটের আগেও ভারতের অর্থনীতি বেহাল দশায় ছিল। মার্চ পর্যন্ত সমাপ্ত প্রান্তিকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর কারণ দেশটিতে বিনিয়োগের খরা। আগে ভারতের অর্থনীতিতে কখনও ঋণাত্মক বিনিয়োগ হতো না। কিন্তু গত বছর বিনিয়োগ ৩ শতাংশ কমেছে। অর্থনীতির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশটিতে দারিদ্র চরম আকার ধারণ করবে। এক হিসেবে বলা হয়েছে, তিন মাসের লকডাউনে ভারতের অর্ধেক লোক কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়বে। ফলে নব্বইয়ের দশক থেকে অর্থনীতি উদারীকরণের ফলে ভারতে দারিদ্র হ্রাসে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তা ভন্ডুল হয়ে যাবে।
এরকম এক অবস্থায় চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত। বস্তুত ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য চীন পরিকল্পিতভাবে লাদাখে হামলা চালিয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
চীন ভারতের সবচেয়ে বড় আমদানির উৎস। ২০১৮ সালে ভারত চীনের কাছ থেকে ৬৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে । আর রফতানি করেছে ১৬ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ৫২ বিলিয়ন ডলারের। এর মানে হলো ভারত ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় চীনের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি।
ভারত সরকার সম্প্রতি চীনা পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বন্দরে ঝামেলা তৈরি, উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে হিতে বিপরীতে হতে পারে। চীন থেকে ভারত অত্যন্ত কম দামে ৩ হাজার পণ্য আমদানি করে থাকে। এসব পণ্য আমদানি কমলে ভারতের অর্থনীতিতে তা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ভারতের রফতানি শুধু চীনেই নয়, অন্যান্য দেশেও কমে যাবে । ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং পণ্যের দাম বাড়বে। ভারতের কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যেমন ভারত পরোক্ষভাবে হুয়াওয়ে ও জেটটিইর টেলিকম প্রযুক্তি ব্যবহারে ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভারতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকল্প উৎস থেকে এসব প্রযুক্তি আমদানি করতে তাদের ২০ ভাগ বেশি অর্থ খরচ করতে হবে।
জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক প্রভিন কৃষ্ণ বলেন, চীনের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিলে ভারতের অনেক ব্যবসায়ের ক্ষতি হবে। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনের অধ্যাপক সুমিত গাঙুলী বলেন, চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বিরোধী আহাম্মকি, ধ্বংসাত্মক ও অযৌক্তিক স্লোগান সর্বস্ব। এর কোনো মানে হয় না। মোদির আত্মনির্ভর ভারত স্লোগান দেশটির জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধে জড়ালে ভারতের বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপরও কুপ্রভাব পড়বে। ভারতের অনেক আইটি প্রতিষ্ঠান চীনের বিনিয়োগে উন্নতি করছিল। ভারতে চীন ২৬ বিলিয়ন ডলার বিনিযোগের পরিকল্পনা করছিল। এই বিনিয়োগ না হলে ভারতের অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষত তৈরি হবে। ইতিমধ্যে চীনের এক হাজার কোম্পানি ভারতে ৮ বিলিয়ন ডলারের মত বিনিয়োগ করেছে।
যে কথাটি সবশেষে বলতে চাই কিন্তু যেটি সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা হলো চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার অলীক কল্পনাবিলাসে ভারত সামরিক অস্ত্র কেনার উন্মাতাল নেশায় মেতেছে। ভারতের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সমরাস্ত্রই প্রায় আমদানিনির্ভর। চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ থাকলে বিশ্বের অন্যতম অস্ত্র বিক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও রাশিয়ার বেশি লাভ। তারা ভারতে অস্ত্র বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। আর এতে ভারতের দারিদ্র বিমোচন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামাজিক নানা সূচকে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে।
চীনের সঙ্গে বিরোধের মধ্যেই ভারত রাশিয়া থেকে ২৪৩ কোটি ডলার ব্যয়ে ৩৩টি জঙ্গিবিমান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। গত কয়েক দিন আগে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২১ টি মিগ-২৯ এবং ১২টি সুখই বিমান কেনার পাশাপাশি রাশিয়ার তৈরি ৫৯টি পুরনো জঙ্গি বিমানের আধুনিকায়ন করা হবে।
এ ছাড়া ২০১৮ সালে ভারত রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য ৫৪০ কোটি ডলারের চুক্তি করে।
শুধু তাই নয়, ভারত ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬টি রাফালে জঙ্গিবিমান কেনার জন্য ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে একটি চুক্তি করে। এতে ভারতের ব্যয় হবে ৫৯ হাজার কোটি রুপি বা ৮৭৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর সমান ব্যয় হবে ভারতের। চীনের সঙ্গে উত্তেজনার পর তড়িঘড়ি করে ৬টি রাফালে নিচ্ছে ভারত। পুরো বহর যোগ হবে ২০২২ সালের মধ্যে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশ শাসনে তেমন ক্যারিশমা দেখাতে পারছেন না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার এখন দরকার উগ্র জাতীয়তাবাদ উস্কে দেওয়া। এজন্য মোদি তার দেশের সামর্থ্যরে বাইরে গিয়ে যুদ্ধ-উন্মাদনার জন্য দেশকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছেন।
দিনশেষে এসবের বলি হবে ভারতের ভঙ্গুর অর্থনীতি আর দেশটির বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
১৩০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে এখনও কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করছেন। তাদের ভাগ্যের উন্নয়নে মোদি যতটা গলবাজি করছেন, অর্থনৈতিক কর্মসূচি সেই তুলনায় নেহাতই অপ্রতুল।
চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মোদি দেশটির বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ধস নামাতে পারবেন শুধু। তাকে মনে রাখতে হবে তিন দশক আগে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে চীন ও ভারত ছিল প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু এরপর থেকে চীনের নাটকীয় উত্থান ঘটেছে। ফলে যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হতে পারে।
চীনের জিডিপি এখন ১৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার আর ভারতের জিডিপি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। চীনের অর্থনীতির আকার ভারতের ৫ গুনেরও বেশি। গত বছর চীনের ঘোষিত প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ২৬১ বিলিয়ন ডলার আর ভারতের ৭১ বিলিয়ন ডলার। চীনের সামরিক বাজেট ভারতের প্রায় চারগুণ। ভারত যেখানে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে সেখানে চীনের লক্ষ্য বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হওয়া।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে