চীনের মোবাইল ফোন কোম্পানি হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় পেতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। বৃটেন স্বীকার করেছে ট্রাম্প প্রশাসনের কারনে তারা বাধ্য হয়েছে হুয়াওয়ে নিষিদ্ধ করতে। ইউরোপের সব দেশে থেকে হুয়াওয়ে বের করে দিতে হোয়াইট হাউজ অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে । বৃটেনের পর ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ একই পথে হাটতে যাচ্ছে। ফলে হুয়াওয়ের ৫জি টেকনোলিজর বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার হাতছাড়া হতে যাচ্ছে চীনের। চীন বলেছে এটা ব্যবসায়িক নয় বরং পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দিয়েছে চীন। আজ আমরা হুয়াওয়ে চীনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের টানাপড়েনের নানা দিক তুলে ধরবো।
৫জি হলো ফিফথ জেনারেশন সেলুলার নেটওয়ার্ক। ফোর জির পর এটা নতুন গ্লোবাল ওয়াইরলেস স্টান্ডার্ড নেটওয়ার্ক। এটা এমন এক নেটওয়ার্ক যা মেশিন, অবজেক্ট এবং ডিভাইস থেকে শুরু করে প্রত্যেককে একসাথে ভারচুয়ালি কানেক্ট করতে পারে। মোবাইল ফোনে বসানো প্রত্যেকটি ৫জি ডিভাইস রেডিও ওয়েভস এবং লোকাল এন্টেনার মাধ্যমে ইন্টারনেট এবং টেলিফোনের সাথে সংযুক্ত। এর রয়েছে তিনটি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড। লো, মিডিয়াম এবং হাই। ৫জি নেটওয়ার্কের মূল বৈশিষ্ট হলো এর উচ্চ গতি। এর ডাইনলোড স্পিড প্রতি সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইটস।
বিশ্বজুড়ে ফাইভ জি প্রযুক্তি স্থাপনের বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীনা প্রতিষ্টান হুয়াওয়ে। যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে হুয়াওয়ে যাতে কাজটি করতে না পায় সেজন্য বিভিন্ন দেশে বাধার সৃষ্টি করছে। অবরোধসহ ট্রাম্প প্রশসানের নানা ধরনের হুমকি উপেক্ষা করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হুয়াওয়ের সাথে চুক্তি করে। এরমধ্যে বৃটেনও ছিলো। বৃটেন দেশের টেলিকম সেক্টরে হুয়াওয়ের ফিফথ জেনারেশন টেকনোলিজ স্থাপনের ঘোষণা দেয়। কয়েক ডজন শহর ইতোমধ্যে টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের ৫জি নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃটেন তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। হোয়াইট হাউজ বৃটেনের টেলিকম সেকশনের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে।
অনেকের মতে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারনে বৃটেন এ সিদ্ধান্ত নেয়নি। হংকং বিষয়ে চীনের সর্বশেষ পদক্ষেপের ফলে বৃটেন ক্ষুব্ধ হয়। হংকং ঘিরে শুধু বৃটেন নয় ইউরোপের আরো অনেক দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক অবণতি হতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাম্প্রতিক স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন ইউরোপে যে রাজনৈতিক এবং বাজার ও বিনিয়োগ সুবিধা পেয়েছিল তা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। অবনতি হতে পারে চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক।
টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের সারা বিশ্বে যে বাজার রয়েছে তার চারভাগের এক ভাগ বর্তমানে ইউরোপে। বৃটেনে হুয়াওয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণায় বলা হয়েছে ৩১ ডিসেম্বরের পর যুক্তরাজ্যের কোনো মোবাইল প্রোভাইডার নতুন কোনো হুয়াওয়ে ৫জি ইকুইপমেন্ট কিনতে পারবে না। আর ২০২৭ সালের মধ্যে তাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক থেকে চীনা সমস্ত ৫জি কিট সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারনে বৃটেন হুয়াওয়ে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হুয়াওয়ে নিয়ে বৃটেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেক দিন ধরে টানাপড়েন চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কারণ হিসেবে বলছে, হুয়াওয়ের সাথে সমর্পক রয়েছে চীনা কমিউনিস্ট সরকার এবং চীনা গোয়েন্দা সংস্থার। হুয়াওয়ের মাধ্যমে পশ্চিমা সমস্ত গোপন তথ্য সরাসরি চলে যাবে চীনা গোয়েন্দা সংস্থা এবং চীনা সরকারের কাছে।
বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড মিলে রয়েছে একটি গোয়েন্দা জোট। এ গোয়েন্দা জোট ফাইভ আইস নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ চীন বৃটেনের নেটওয়াকে প্রবেশ করতে পারলে এর সে মাধ্যমে পশ্চিমা সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য হাতিয়ে নেবে । একইসাথে ইউরোপের সরকার, ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য হাতিয়ে নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আনা এসব অভিযোগ শুরু থেকে অস্বীকার করছে প্রতিষ্টানটি। ৫ জি প্রযুক্তির মাধ্যমে বৃটেনে দ্রæত গতির ইন্টারনেট, ওয়াইরলেস ডিভাইস, উচ্চ মানের মোবাইল গেমিং ভিডিও স্ট্রিম এবং এমনকি ভবিষ্যতে চালকবিহীন গাড়ি প্রযুক্তি আনতে যাচ্ছিল হুয়াওয়ে। বৃটেনে হুওয়াওয়ে প্রধান জানিয়েছেন সেখানে তারা ২০ হাজার বেজ স্টেশন, রেডিও রিসিভার বা ট্রান্সমিটার বসিয়েছে। আর চলতি বছর বিশ্বে এ ধরনের ৫ লাখ বেজ স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্টানটির।
বৃটেনের পর ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে হুয়াহুয়ে নিয়ে একই পথে হাটতে যাচ্ছে। ফলে বর্তমানে গোটা ইউরোপে হুয়াওয়ের অনেক বড় বাজার সম্ভাবনা শেষ হওয়ার পথে। বিশ্লেষদের মতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছাড়াও ইউরোপীয় কোম্পানীগুলো হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার আরো কারন রয়েছে। এরমধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনের ভ‚মিকা, হংকং, উইঘুরসহ চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ‘বেইজিং ইউরোপকে হারিয়েছে’। বেইজিং লস্ট ইউরোপ।
হুয়াওয়ের পরিকল্পনা ছিল ইউরোপে হুয়াওয়েকে ‘মেইড ইন ইউরোপ’ হিসেবে পরিচিত করা। ফ্রান্স সরকারও টেলিকম ফার্মগুলোকে ৫জি টেকনোলজি প্রোভাইডার হিসেবে হুয়াওয়েকে বাদ দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে । একই সাথে দেশীয় প্রোভাইডারদের ইনসেনিটভ দিচ্ছে। তবে ফ্রান্স নিশ্চিত করেছ আগামী বছরগুলোতে তাদের ৫জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়ের সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনবে।
ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় দুটি টেলিকম প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীল। তাদের অর্ধেক নেটওয়ার্ক ইকুইপমেন্ট আসে হুয়াওয়ে থেকে। জার্মানির ফোরজি নেটওয়ার্কেরও প্রায় ৭০ ভাগ ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করে হুয়াওয়ে। ইতালিও ঘোষণা দিয়েছে ৫জি বিয়ষক একটি টেন্ডার থেকে হুয়াওয়েকে বাদ দেয়ার । নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়াম হুয়াওয়ে ইকুইপমেন্ট ব্যবহার সীমিত করেছে। ইউরোপের চীনের সবচেয়ে বড় ভক্ত হলো হাঙ্গেরি। কিন্তু হাঙ্গেরিও প্রকাশ্যে বলেছে হুয়াওয়ের নিরাপত্তা ঝুকির কথা। এপ্রিলে ঘোষিত তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্রাটেজিতে এ ঝুকির কথা উল্লেখ করে চীনা টেকনোলজি বিষয়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অন্যান্য দেশকে হুমকি দিয়ে চলছে তারা যদি হুয়াওয়েকে বের করে না দেয় তাহলে তাদের সাথে সমস্ত গোয়েন্দা তথ্যের আদান প্রদান বন্ধ করে দেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র চলতি সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছে হুয়াওয়ে স্টফাদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমন করতে দেবে না। একই সাথে যেসব চীনা কোম্পানী উইঘুরে মানবাধিকার লঙ্ঘনে লাভবান হয়েছে তাদেরও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেবে না।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন তার কারনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন আমরা অনেক দেশকে রাজি করিয়েছি হুয়াওয়েকে বের করে দেয়ার জন্য। আর এর বেশিরভাগ রাজি করানোর কাজ করেছি আমি নিজে। আমি তাদের বলেছি আমাদের সাথে ব্যবসা করতে হলে হুয়াওয়ে রাখা চলবে না। ট্রাম্পের এ দাবি অস্বীকার করেছেন বৃটেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক।
অনেকের আশঙ্কা একটি বড় ধরনের কোল্ড ওয়ার আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে। আর এতে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার হতে পারে টেকনোলজি। সুতরাং এ বিষয়ে ইউরোপের অনেক দেশ আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে চায়। ইউরোপের সর্বত্র হুয়াওয়ে নেটওয়ার্ক বসানো হয়ে গেলে ভবিষ্যতে যে কোনো সংঘাতের সময় বেইজিং সরকার একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলে। চীন সরকার যুদ্ধের অংশ হিসেবে বন্ধ করে দিতে পারে হুয়াওয়ে সফটঅয়ার রপ্তানি । ব্লক করে দিতে পারে হুওয়াওয়ে। ফলে বিপদে পড়তে হবে এর ওপর নিভরশীলদের।
চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম হুমকি দিয়েছে আমেরিকার কথামত হুয়াওয়ে নিষিদ্ধ করায় বৃটেনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে বৃটেনকে আমেরিকার চামচা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গেøাবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে বৃটেনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে হবে। আর এ প্রতিশোধ হবে পাবলিক এন্ড পেইনফুল। এ ঘটনাকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখার দরকার নেই। কারণ বৃটেন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা নয়। এটা হলো ফাইভ আইসের একটি উইক লিঙ্ক মাত্র।
চীনে বৃটেনের বৃটিশ প্রেট্রোলিয়াম, জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার এবং গ্লাক্সোস্মিথক্লিন সহ বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসা খারাপ হওয়ার আভাস দিয়েছে চীন। লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন বৃটেনে নিউক্লিয়ার পাওয়ার, হাইস্পিড রেলওয়ে প্রজেক্টসহ বড় বড় প্রকল্প থেকে চীন বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পারে। অন্যান্য দেশও যাতে এ ধরনের পদক্ষেপ না নেয় সেজন্য চীন বৃটেনের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে। অপর দিকে অন্যান্য দেশ লক্ষ্য করছে চীন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়।
বৃটেনের পদক্ষেপকে চীন মনে করে ব্যবসায়িক নয় বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত । ট্রাম্পের বক্তব্যই তার প্রমান। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র হূয়া চুনিং বলেছেন, এর সাথে নিরাপত্তার কোনো বিষয় নেই। এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বা ট্রাম্প যদি পুনরায় হোয়াইট হাউজে ফিরতে না পারেন তাহলে হুয়াওয়ের ভাগ্য আবার খুলতেও পারে বলে মনে করেন অনেকে।
বাস্তবতা হচ্ছে, হুয়াওয়ে বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউজের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হতে চলছে। তবে হুওয়াওয়েও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। চীনের দাবি পৃথিবী অনেক বড়। আর সে তুলনায় বৃটেন অনেক ছোট দেশ। অন্য দেশে তাদের ব্যবসার দুয়ার খুলবে। পশ্চিমের দরজা বন্ধ হলে তারা পুবে ব্যবসা করবে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে