ঐতিহাসিক সিল্করুট পুনরুজ্জীবনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ন অংশীদার ইরান। যে দেশটির মাধ্যমে চীন সংযুক্ত হবে ইউরোশিয়া অঞ্চলে। ইরানের মধ্যদিয়ে ইরাক, তুরস্ক , মধ্যএশিয়া হয়ে সংযুক্ত হবে চীনের ভুখন্ড উরুমকি পর্যন্ত। একই সাথে ভারত মহাসাগরের মালাক্কা প্রনালী এড়িয়ে আরব সাগরের সাথে চীনের মুলভূখন্ডের সাথে সংযোগ স্থাপনে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের পর ভারতকে হটিয়ে ইরানের চাবাহার বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে চীন। যা এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি বদলে দিতে যাচ্ছে। ভারতের পুরানো মিত্র ইরান পুরোপুরি ভাবে ঝুকে পড়ছে চীনের দিকে।
ইরান-চীনের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্টিত হয় ২০১৬ সালে। এ বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তেহরান সফর করেন। উভয় দেশ যে যৌথঘোষণাপত্র প্রকাশ করে তাতে চীনের সিল্করোড ও একবিংশ শতাবদীর মেরিটাইম সিল্করোডকে স্বাগত জানায় ইরান। ইরানের শিল্প, খনিজ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে সড়ক, রেলপথ, বন্দর, জ্বালানী, শিল্প ও বানিজ্যখাতে বিনিয়োগকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রতিষ্টাতা সদস্য হিসাবে ইরানের অংশগ্রহনকে প্রশংসা করে বেইজিং।
ইরানের জ্বালানী ও অবকাঠামোখাতে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের নিয়ে আলোচনা চলছে। এরমধ্যে ২২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ থাকবে অবকাঠামো খাতে। এরমধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ন দিক হচ্ছে, মালাক্কা প্রনালীর এড়িয়ে ইরানের জ্বালানী চীনে পৌছানোর প্রকল্প। অপরটি ডলারের বিপরীতে চীনা মুদ্রা ইউয়ান দিয়ে লেনদেন।
অবকাঠামো খাতে বড় একটি প্রকল্প হচ্ছে তেহরান থেকে মাশহাদ পর্যন্ত ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বৈদ্যুতিক রেললাইন স্থাপন। ইরানের বড় কয়েকটি শহর তেহরান, কোম, ইসফাহান হয়ে এই রেললাইন যাবে তাবরিজ পর্যন্ত। তাবরিজ হচ্ছে তেল গ্যাস ও প্রেট্রোকেমিক্যাল কেন্দ্র। এখান থেকে শুরু হয়েছে তাবরিজ-আঙ্কারা গ্যাস পাইপলাইন।
এছাড়া এই হাইস্পিড রেললাইন মধ্যএশিয়ার কাজাখস্তান, কিরঘিজস্থান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে চীনের উরুমকি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। যা ইরাক, তুরস্ক থেকে শুরু করে মধ্যএশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত সংযোগ করবে।
সিল্করোড ও মেরিটাইম সিল্করোড সংযুক্তির সাথে সামারিক সহযোগিতার দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এখন ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে যে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির উপস্থিতি নিয়ে তেহরান-বেইজিং আলোচনা চলছে। চীনের সামরিক ঘাটি স্থাপনের অনুমতি দিতে পারে বেইজিং। সামরিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে ইরান, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা চলছে।
চাবাহার দক্ষিণ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্র বন্দর। চীনের বিনিয়োগে পাকিস্তানে প্রতিষ্টিত গোয়াদর বন্দরের উল্টো পার্শ্বে এর অবস্থান। গোয়াদর বন্দর থেকে এর দূরত্ব ৭০-৮০ কিলোমিটারের মধ্যে। পাকিস্তানের বন্দরগুলোর ওপর আফগানিস্তানের নির্ভরশীলতা কমাতে এবং আফগানিস্তান ও ইরান হয়ে মধ্যএশিয়ায় বাণিজ্য স¤প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে ভারত চাবাহার বন্দরের বিনিয়োগ প্রকল্পে সামিল হয়। এখন চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগের কারনে এই প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
২০১৬ সালে ভারত এই সমুদ্র বন্দর নির্মান প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়। বন্দরের টার্মিনাল নির্মানের পাশাপাশি রেল লাইর প্রকল্পের সাথে ছিলো ভারত। চাবাহার বন্দর থেকে থেকে জাহেদান পর্যন্ত প্রায় ছয় শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেললাইন। এই রেললাইন ইরানের জাতীয় রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা।
ইনডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড ও ইন্ডিয়ার রেলওয়ে কন্সট্রাকশন লিমিটেড এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত। এই প্রকল্পটি ছিলো ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। সম্প্রতি ইরান একক ভাবে এই রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধন করেছে। ধারনা করা হচ্ছে চাবাহার থেকে ভারতকে সরিয়ে দেয়ার এটি ইঙ্গিত। ভারত আশা করেছিলো আফগানিস্তান এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় কাবুলে তাদের প্রভাব বাড়বে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মুম্বাই থেকে চাবাহার হয়ে কাবুল ও মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় পণ্যর বাজার সম্প্রসারন করা যাবে। এই রুটে মধ্য এশিয়ার দিকে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে খরচ ও সময় অর্ধেক কমে যেতো।
চাবাহার বন্দরটি আফগানিস্তানের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ন বিবেচনা করা হতো। পাকিস্তানের বন্দরের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কাবুল এই বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে যা আফগানিস্তানের ওপর ভারতের প্রভাব বাড়াবে। চাবাহারের সাথে জাহেদানের সংযোগ এ কারনে গুরুত্বপূর্ণ। জাহেদান নগরী আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানে সব ধরনের বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তখন চাবাহার বন্দর নির্মানে ভারতের বিনিয়োগকে এর বাইরে রেখেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত এই প্রকল্প থেকে ছিটকে পড়তে যাচ্ছে। ইরানের অভিযোগ ছিলো চাবাহার বন্দরসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পে নির্ধারিত সময়ে অর্থছাড় করতে ভারত ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোরের বিকল্প হিসাবে চাবাহার বন্দরকে ভাবতে শুরু করেছিলো দিল্লি।
চাবাহার বন্দর কেন্দ্রিক রেল প্রকল্প থেকে বাদ যাওয়ার পর ইরান একটি বড় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ভারতীয় বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। পারস্য উপসাগরে ফারজাদ-বি নামের এই গ্যাস ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে ওএনজিসি, অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন কনসোর্টিয়াম অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ পায়। ন্যাশনাল ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানি জানিয়েছে এই গ্যাস ক্ষেত্রে ওএনজিসির পরিবর্তে অন্য কেউ গ্যাস ক্ষেত্রটি পেতে যাচ্ছে। ২০১২ সাল থেকে ভারত হঠাৎ করে ভারতের কোম্পানিগুলো কাজ বন্ধ করে দেয়। ধারনা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ভারত কাজ বন্ধ করে দেয়। ইরানের এসব প্রকল্প থেকে ভারতের বিদায়ঘন্টা কৌশলগতভাবে ভারতের বিপর্যয় হিসাবে দেখা হচ্ছে।
ইরানের সাথে ভারতের পুরানো সর্ম্পকে ফাটল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সর্ম্পককে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তেহরান দিল্লির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। বিভিন্ন সময় ইরানের পক্ষ থেকে ভারতকে এমন বার্তা দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের নির্ভরতার কারনে চীন আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে।
ইরানের সাথে জ্বালানী তেল বিক্রি নিয়ে যখন শীতল সর্ম্পক তখন চীনের বিনিয়োগ ইরানের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করতে পারে। চীনের এই বিপুল বিনিয়োগের বিনিময়ে ইরান ২৫ বছর ধরে বেইজিংকে সস্তায় জ্বালানি তেল দিয়ে যাবে বলে কথা রয়েছে। এতে ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধও বেশ অকার্যকর হয়ে যাবে।
ইরানের দিক থেকে এমনও ইঙ্গিত রয়েছে চীনের সহায়তায় নির্মিত পাকিস্তানের গোয়াদার ও চাবাহার বন্দরের মাঝে সংযোগ স্থাপনেও তেহরান রাজি। এমন পরিকল্পনা বাস্তাবায় হলে এ অঞ্চলে সামুদ্রিক যোগাযোগ রুপ বদলে যাবে। কারণ চীন সরাসরি ইরান থেকে জ্বালানী গোয়াদর বন্দর দিয়ে কাশগড় পর্যন্ত নিতে পারবে। এতে ভারত মহাসাগরের মালাক্কা প্রনালীর ওপর নির্ভরতা নাটকীয়ভাবে কমে যাবে।
এর প্রভাব পড়বে আফগানিস্তানের ওপর। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে চীনের প্রভাব বাড়তে শুরু করেছে। তালেবান নেতাদের সাথে চীনা কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠকের খবর এসেছে। ফলে এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার ও তালেবানদের ফিরে আসার কারণে আফগানিস্তানে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে ভারত।
গোয়াদর ও করাচী বন্দরকে ঘিরে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে চীনা বিনিয়োগ এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইরান এই অর্থনৈতিক করিডোরে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শধু ইরান নয় সৌদি আরবও অর্থনৈতিক করিডোরে সম্পৃক্ত হতে চায়। ইরান ও সৌদি আরবের এই আগ্রহের কারন হলো চীনে জ্বালানী তেলের বাজার নিজেদের অংশগ্রহন বাড়ানো। কারন ইরান ও সৌদি আরব উভয়ই চীনে জ্বালানী বিক্রি বাড়াতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে গোয়াদর বন্দর হয়ে উঠতে যাচ্ছে বড় বাণিজ্য কেন্দ্র।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইরানকে ঘিরে চীনের যে বিনিয়োগ পরিকল্পনা তাতে এশিয়ায় ভূকৌশলগত সর্ম্পকের চিত্র বদলে যাচ্ছে। যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে যাচ্ছে ভারত। কারন চীনের আগ্রাসী বিনিয়োগ ও কূটনীতি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারতকে কোনঠাসা করে ফেলছে। ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করেন পাকিস্তান , শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে চীন। যা ভারতের জন্য বড় ক্ষতির কারন।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে