জুলাই মাসের গোড়ার দিকে ইরান থেকে আসা একটি খবরে রীতিমতো চমকে ওঠে ভারত। খবরে বলা হয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে নিচ্ছে ইরান। প্রকল্পটি হলো ইরানের চাবাহার বন্দরকে আফগানিস্তানের সীমান্ত শহর জাহেদান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে নির্মাণ সংক্রান্ত । উল্লেখ্য, ভূ-রাজনৈতিক কারণে ইরানের চাবাহার বন্দর ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। ইরানের বন্দর ও রেল প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেয়ার কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের বেশিরভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য হয় পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দর দিয়ে। পাকিস্তানের আপত্তির কারণে স্থলপথে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় পণ্য রপ্তানি বন্ধ। কাজেই বিকল্প রুট হিসেবে ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ভারতের কাছে জরুরি। এর মাধ্যমে ইরানের মধ্য দিয়ে শুধু আফগানিস্তানের সঙ্গে নয়, তুর্কমেনিস্তানসহ সমগ্র মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় ভারত।
কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ভারত এই বাস্তবতা উপেক্ষা করতে পারে না। আফগানিস্তানও সেটা অনুধাবন করেছে। তাই সই হয় ভারত-ইরান-আফগানিস্তান এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী ভারত চাবাহার বন্দর উন্নয়নে ৬০০ কোটিরও বেশি টাকা বিনিয়োগ করবে, আর ইরান তৈরি করে দেবে চাবাহার বন্দর থেকে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত হাইওয়ে।
চুক্তিতে আফগানিস্তানকেও অঙ্গীকার করতে হয়েছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ইরানের বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে আফগানিস্তান। মার্কিন বা পাকিস্তানের চাপে তারা চাবাহার বন্দর ব্যবহার বন্ধ করবে না। তেমন ক্ষেত্রে বলবে, আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে এই বন্দর জরুরি।
চাবাহার বন্দর নির্মাণে সমস্যা দেখা দেয় গত বছর। পরমাণু ইস্যুতে ইরানের অশোধিত তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে বহু দেশ ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়। ভারতও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মান্য করে। কেউ কেউ বলে, বরং একটু বেশিই মান্য করে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আর্থিক সংকটে পড়ে যাওয়া ইরান যদি চাবাহার বন্দর প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিয়ে চীনকে নেয়, তাতে অবাক হওয়ার তেমন কিছুই নেই। খবরটির সত্যতা যাচাই করতে তেহরানে ভারতীয় কূটনীতিকরা ছুটে যান সরকারি মহলে। ইরান কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বস্ত করে জানায়, ওটি নেহাৎ একটি 'গুজব'। ইরান সরকারের কথায় কূটনীতিকরা কতোটা আশ্বস্ত হন জানা না-গেলেও পর্যবেক্ষকরা মোটেই আশ্বস্ত হন না। তাঁরা বলেন, সত্য হোক কী গুজব, এটা আসলে ভারতের প্রতি ইরানের একটা হুঁশিয়ারি।
এসব ঘটনা ঘটার সময়টি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব ঘটছে এমন এক সময়, যখন একদিকে সীমান্তে চীন-ভারত মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে চীন ও ইরান ২৫ বছর মেয়াদী স্ট্র্যাটেজিক চুক্তি করতে যাচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। চাবাহার বন্দর নিয়ে চীন যদি ইরানকে আরো ভালো প্রস্তাব দেয়, তাহলে ভারতকে বাদ দিয়ে চীনকেই নিতে পারে ইরান। সেক্ষেত্রে চীনের কাছে জায়গা হারালেও ভারতের কিছুই করার থাকবে না।
বর্তমানে চলমান ইরান-ভারত ১০ বছরের একটি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। তখন চীন তার উচ্চাভিলাষী রোড অ্যান্ড বেল্ট উদ্যোগকে চাবাহার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইতে পারে।
পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানী রাষ্ট্রদূত ইতিমধ্যেই ''সিস্টার'' পোর্ট গোয়াদরের সাথে চাবাহারের সংযোগ স্থাপনের প্রসঙ্গটি উত্থাপনও করেছেন। ইরান চাচ্ছে এমন কোনো ব্যবস্থায় উপনীত হতে, যার সাহায্যে চাবাহার বন্দর প্রকল্প থেকে চীন ও ভারত দু'দেশই সমানভাবে উপকৃত হতে পারে।
সেক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায় যে, ইরান কি চীন ও ভারত উভয়ের পক্ষেই সমান তালে খেলতে চায়? এমনকি ভারত যদি ইরানের প্রধান দুশমন আমেরিকা ও ইসরাইলের সাথে দহরম মহরম চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলেও?
বিশেষজ্ঞাদের অভিমত হচ্ছে, এরকম পরিস্থিতিতে চীন ও ভারত উভয় দেশের সাথে একইসাথে বাণিজ্য করে লাভবান হওয়ার একটা কৌশলী পথ দেশটি অর্থাৎ ইরান বের করেই ফেলবে। অপরদিকে অল্পকিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, তখন নয়া দিল্লির সাথে তেহরানের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটবে। এমনিতে ইতিমধ্যে ভারতীয় মুসলিমদের ওপর নরেন্দ্র মোদী সরকারের দমনপীড়নের নিন্দা জানিয়েছে ইরান।
তবে সম্ভাব্য আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার ভারতকে ছেড়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া কতোটা ঠিক হবে, তা নিয়েও ইরানের ভেতরে ব্যাপক হিসাবনিকাশ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেহরানের রাজনীতিবিজ্ঞানের একজন প্রফেসর বলেন, ইরান যে ঝাঁকুনিটা দিয়েছে তাতে কাজ হয়েছে, ইরানের অভিযোগের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে ভারত। চাবাহার-জাহেদান রেল প্রকল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলতে ইরানী সংসদের স্পীকার বাগহের ঘালিবাফ, সড়ক উপমন্ত্রী এবং ইরান রেলওয়ের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গাদ্দাম ধর্মেন্দ্র। এসব সাক্ষাত বেশ কাজ দিয়েছে। এখন ইরান চাচ্ছে, ইরানের কাছের ও দূরের শত্রুদের প্রভাবের বাইরে গিয়ে ভারত স্বাধীনভাবে নিজ ইরাননীতি প্রণয়ন করে দেখাক। ইরান আরো চাইছে, ভারত যে এখনও চাবাহার প্রকল্পের প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকারাবদ্ধ, তা প্রমাণ করুক।
এদিকে ইরানী সংসদের স্পীকার বাগহের ঘালিবাফের শিগগিরই ভারত সফরের কথা রয়েছে। নয়া দিল্লি যে ইরানকে আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব দেয়, এটাও তারই আরেকটি প্রমাণ। যদিও ইরানের সাথে ভারতের সর্ম্পক অনেক পুরানো। কিন্তু মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার পুতুলে পরিনত হয়েছে। এরফলে চীনের সাথে যেমন ভারতের সর্ম্পক খারাপ হয়েছে একই ভাবে ইরানের সাথে সর্ম্পক শীতল য়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন চাবাহার প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণকে বাধা দিচ্ছে না, এটা ইরানের জন্য একটা বিরাট স্বস্তি। কেননা, এর মধ্য দিয়েই ইরানে বিদেশী বিনিয়োগ আসার একটা জানালা খোলা থাকলো। অপরদিকে ভারত একে নিচ্ছে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে। পাকিস্তানকে গোয়াদর বন্দর বানিয়ে দিচ্ছে চীন, ভারতও তাই যুক্ত হয়েছে ইরানের চাবাহার বন্দর প্রকল্পের সাথে।
তবে এটা এখন পরিষ্কার যে, চাবাহার বন্দর প্রকল্পটি এখনও অনেক রকম অনিশ্চয়তা ও বিরোধের মেঘের নিচে আটকা পড়েছে। এগুলো হচ্ছে, চীন-ভারত বিরোধ এবং ওয়াশিংটনের সাথে ভারতের মাখামাখি। ভারতের অথনৈতিক সামর্থ্য বড় সমস্যা। ভারতের অর্থায়নে যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় ধীর গতিতে। চাবাহারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
এছাড়া ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন অবরোধ ভারত যেভাবে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে, তাতে কোনো ইরানীই সন্তুষ্ট নয় এবং এ অসন্তোষ তারা গোপনও করে না। এর ফল হয়েছে , ইরান-ভারত বাণিজ্য বেশ কমে গেছে। ইরানে অনেকে মনে করেন, এ অবস্থায় ইরান-পাকিস্তান-চীন নতুন মৈত্রী জোট গড়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। আবার অন্য অনেকে মনে করেন, ইরান-ভারত বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক কালের, এটা সহজে ভাঙার নয়। শেষের মত পোষণকারীদের অন্যতম হচ্ছেন ইরানী সংসদের স্পীকার বাগহের ঘালিবাফ।
শুধু ঘালিবাফ কেন, গত জানুয়ারি মাসে ইরাকে মার্কিন হামলায় নিহত ইরানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল কাসেম সোলেইমানীও ইরান-ভারত সুসম্পর্কের কড়া সমর্থক ছিলেন। পাশাপাশি আফগানিস্তানের সাথেও ইরানের সুসম্পর্ক চাইতেন তিনি। সোলেইমানী আজ নেই, কিন্তু ইরানের ক্ষমতাশালী রেভুল্যুশনারি গার্ড বাহিনীতে তাঁর ভাবধারা এখনও সজীব।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ইরান এমন এক অবস্থান নিয়েছে যে, তারা ভারতের সাথেও মৈত্রী বজায় রাখবে, চীনের স্বার্থও ক্ষুন্ন হতে দেবে না। এ নীতি নিয়ে তারা কদ্দুর যেতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইরানের সাথে সর্ম্পকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাডারের বাইরে যেতে পারবে না ভারত। ফলে ইরান ও ভারতের মধ্যে সর্ম্পক আর আগের মতো মসৃন হবে না। বরং চীনের সাথে ইরানের সর্ম্পক যতো ঘনিষ্ট হবে। ভারতের সাথে দূরত্ব আরো বাড়তেই থাকবে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে