ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক যতোটা ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ, পাকিস্তানের সাথে ততোটাই মসৃণ। এ কারণেই হয়তোবা, করোনা মহামারীর প্রবল ঝঞ্ঝার মাঝেও চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসি প্রকল্পের কাজে নতুন করে গতি সঞ্চারিত হতে যাচ্ছে। কেন এই প্রকল্পের ওপর এতো গুরুত্ব দিচ্ছে দুই দেশ তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
পাকিস্তান - চীন ইকোনমিক করিডোরের প্রকল্প বাস্তবায়নে জুলাই মাসে দু'দেশের মধ্যে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ অর্থ দিয়ে পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। দেখেশুনে অনেকে মনে করছেন, পাকিস্তানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই কর্মসূচিটি ট্র্যাকে ফিরে এলো।
সিপিইসি প্রকল্পের অংশ হিসেবে দু'দেশের মধ্যে গত ২৫ জুন ও ৬ জুলাই দু'টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বলা হয়েছে, তিন দশমিক নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে দু'টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। সাত দশমিক দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অপর চুক্তির অর্থ দিয়ে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক যুগের রেল যোগাযোগব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হবে। পাকিস্তানে চীনের এটাই সবচাইতে ব্যয়বহুল প্রকল্প।
সিপিইসির অধীনে বিশাল সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে । বর্তমানে পাকিস্তানের বেহাল সড়ক আর রেল নেটয়ার্কের চেহারা পাল্টে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আধুনিক পরিবহন নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের উত্তর অংশকে যুক্ত করবে গোয়াদর বন্দর এবং করাচি শহরকে। একই সাথে চীনের পশ্চিম অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ার সাথে পাকিস্তানের শক্তিশালী পরিবহন নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রেল লাইন সম্প্রসারিত করা হবে জিনজিয়াং এর কাশগর পর্যন্ত।
১৫ বছর মেয়াদি সিপিইসি প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করছে ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মনে করা হয়ে থাকে, উভয় দেশের ব্যাপকতর কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রকল্প হচ্ছে অর্থনৈতিক খিলান। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে একটি সমৃদ্ধ আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপান্তরিত করাই লক্ষ্য।
এসব চুক্তি অবশ্য খুব সহজে হয়নি। জানা যায়, ২০১৮ সালে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় এসেই পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সম্পাদিত সিপিইসি প্রকল্পের খোলনলচে কিছুটা পাল্টে দিতে চান। এ নিয়ে দু' দেশের মাঝে দীর্ঘ দিন নীরব মন কষাকষিও চলে। অবশেষে উভয় দেশ সমঝোতায় আসে।
সিপিইসি প্রকল্পে ফের গতি আনার পেছনের মানুষটি হলেন আসিম সালীম বাজওয়া। সিপিইসি কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে গত বছর নিয়োগ পান তিনি। এ কর্তৃপক্ষই পাকিস্তানে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয়সাপেক্ষ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত। এসব প্রকল্পের মাঝে রয়েছে বেশ-কিছু মহাসড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্র।
আসলে সিপিইসি হচ্ছে সড়ক, রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি পরিকল্পিত নেটওয়ার্ক, যা আরব সাগরে অবস্থিত পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরকে যুক্ত করবে চীনের সম্পদশালী প্রদেশ জিনজিয়াং-এর সাথে।
পাকিস্তান চাইছে সিপিইসি-র সাহায্যে চীনের পুঁজি, উৎপাদনক্ষমতা ও প্রযুক্তিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটাতে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মেকানিজম গড়ে তুলতে। বিনিময়ে চীন চাইছে আরব সাগরের সাথে যোগাযোগের একটা পথ, যা ভবিষ্যতে মালাক্কা প্রণালীর সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটা বাণিজ্যপথ হতে পারে।
তবে যত বড় বড় কথাই বলা হোক, সিপিইসি-কে তার সাফল্য প্রদর্শন করতেই হবে। অন্যথায় এটা পঙ্গু হয়েই থাকবে। এ রকম আশা-আশঙ্কার দোলাচলের মধ্য দিয়ে মাল্টিবিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি ২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে। এ সময় এতে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ফুটে ওঠে। এছাড়া অর্থসঙ্কটে ভুগতে থাকা পাকিস্তানকে তার শিল্প ও কৃষি খাত উন্নয়নে প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থ দেয়া হয়।
সিপিইসি প্রকল্পের যোগাযোগ করিডোর এখনও তেমন দৃশ্যমান না-হলেও বেশ-ক'টি বিদ্যুৎ প্রকল্প ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়ে উৎপাদনে গেছে। দ্য মেরিকস ডেটাবেস জানাচ্ছে, সিপিইসি প্রকল্পে ২৫ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর ৭৫ শতাংশই বিদ্যুৎকেন্দ্র। জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, বাকি বিদ্যুৎ আসে সৌরশক্তি, জলশক্তি ও বায়ুশক্তি দিয়ে চালিত কেন্দ্র থেকে। এ প্রকল্পের ফলে ইতোমধ্যে পাকিস্তান মুক্তি পেয়েছে বিদ্যুৎ খাতের ভয়াবহ দুরবস্থা থেকে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের জাতীয় লাইনে যুক্ত হয়েছে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ । একই সাথে সিপিইসি চীন-পাকিস্তান পারষ্পরিক নির্ভরতা ও বন্ধুত্ব নতুন এক উচ্চতায় পৌছেছে।
তীব্র অর্থসঙ্কটে পড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৮ সালে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জন্য আইএমএফ-এর কাছে হাত পাততে বাধ্য হন। পাকিস্তানের আর্থিক টানাপোড়েন যেহেতু সিপিইসি প্রকল্পেরও আগের, তাই তাদের পক্ষে এমন একটি প্রকল্পের বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ। এমন প্রশ্ন শুরু থেকেই উঠেছে।
ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে এখন আবার যোগ হয়েছে প্রকল্পের উচ্চ নিরাপত্তাব্যয়। কেননা, গোয়াদর বন্দর যে প্রদেশে অবস্থিত, সেই বেলুচিস্তানে স¤প্রতি বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ-র তৎপরতা বেশ বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগেও বেলুচিস্তানের পাঞ্জগুর জেলায় আধা-সামরিক বাহিনীর এক গাড়িবহরে হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এতে নিহত হয় তিন সৈন্য। গত মে মাস থেকে এটা বিএলএ-র তৃতীয় হামলা। এর আগে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে অপর এক হামলায় তিনজন চীনা প্রকৌশলীকে হত্যা ও পাঁচ জনকে আহত করে তারা। ২০১৫ সালে সিপিইসি প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চীনা কর্মীদের ওপর ওটাই ছিল সবচাইতে বড় হামলা।
গোয়াদর যখন তীব্র বিদ্যুৎসংকটে ভুগছিল, সে-রকম মুহূর্তেও গোয়াদর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি দিতে তিন বছর সময় নেয় বেলুচিস্তান প্রাদেশিক সরকার। এভাবে পাকিস্তাানের স্থানীয় রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের সাথে লড়তে হচ্ছে চীনকে। তার ওপর দুর্নীতি ও সেনাবাহিনীর অহেতুক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা তো রয়েছেই!
নির্বাচনী প্রচারকালে ইমরান খান অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি ক্ষমতা পেলে সিপিইসি বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনের কাছ থেকে নিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করবেন। সে-অনুযায়ী ইমরান খান ২০১৯ সালে সিপিইসি কর্তৃপক্ষ গঠন করেন এবং সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং আইএসপিআর-এর সাবেক প্রধান জেনারেল বাজওয়াকে এর প্রধান নিযুক্ত করেন। ওই জেনারেল একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারীও। শেষের পদটি মন্ত্রী পদমর্যাদার।
সিপিইসি চলে যায় সেনাবাহিনীর কব্জায়। এমনিতে দেশটির অনেক শিল্প-কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী, এবার তাদের সামনে সুযোগ এলো সিপিইসি থেকেও লাভবান হওয়ার। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, অবকাঠামো নির্মাণের অনেকগুলো কাজের ঠিকাদারি পেয়েছে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন কম্পানি। এর মধ্য দিয়েই তারা পেয়ে যাচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।
গত মে মাসেও পাকিস্তান সরকার পাঁচ দশমিক আট বিলিয়ন ডলারের একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দেয় যৌথভাবে একটি চীনা কম্পানি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমার্শিয়াল ইউনিটকে।
অপরদিকে চীন তার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানকে তথাকথিত 'শিক্ষা শিবিরে' বন্দী করে ইসলাম ধর্ম ভুলিয়ে নাস্তিক্যবাদ শেখানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পাকিস্তান নিজেকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় সোচ্চার দেশ বলে দাবি করলেও এ ইস্যুতে তারা চোখ-মুখ বন্ধ করে রেখেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিপোক্র্যাসির অভিযোগ উঠছে। কিন্তু 'সিরাজউদ্দৌল্লাহ' নাটকের গোলাম হোসেনের মতো বাস্তবের ইমরান খানেরও হাত-পা বাঁধা অর্থনীতি ও কৌশলগত স্বার্থের দড়িতে।
এমন অবস্থায় সিপিইসি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হবে আমেরিকা, এতে অবাক হওয়ার কী আছে! গত ২০ মে আটলান্টিক কাউন্সিলের এক আলোচনাসভায় সিনিয়র মার্কিন কূটনীতিক এলিস ওয়েলস বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারীর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির নিরীখে পাকিস্তানের উচিত হবে সিপিইসি-র শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা করা। তাছাড়া এ প্রকল্পের ঋণের শর্তগুলোও 'অন্যায্য ও অস্বচ্ছ'।
সবকিছু জেনেও চীনের সাথেই থাকছে পাকিস্তান। কারণ, তারা জানে, পাকিস্তান কখনোই আমেরিকা ও ভারতের সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে না। এ অবস্থায় চীনের সাথে থাকার সুবিধা পাকিস্তান গ্রহন করবে এটাই স্বাভাবিক।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে