জ্বালানি বা তেল-গ্যাস ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। মাটির নিচে তেল-গ্যাসের বিশাল ভান্ডার রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলিম দেশগুলোতে। তাই তো মুসলিমদের প্রতি তীব্র উন্নাসিক মনোভাব সত্ত্বেও কেবল তেল-গ্যাসের লোভেই পশ্চিমা দেশগুলো বার-বার হামলে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে; নানা কৌশল ও অপকৌশল নিয়ে। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বলয় সম্প্রসারণ করেছে কূটনৈতিক অংশীদারিত্ব ও সামরিক জোটের মাধ্যমে। আর এর বিপরীতে চীন নিয়েছে ভিন্ন কৌশল। তারা এ ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছে তাদের অঢেল অর্থসম্পদকে।
পূর্ব এশিয়ার শক্তিধর দেশ চীন হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধিক অশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারক। তারা ছোট-বড় সব আরব দেশ থেকেই পেট্রোলিয়াম কিনে থাকে। এই কেনাবেচা চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এমন এক অর্থনৈতিক বন্ধন তৈরী করেছে, উভয় পক্ষের অনেক অভ্যন্তরীণ বিষয়ও যাকে টলাতে পারে না।
বলাই বাহুল্য যে, চীনের এ বুদ্ধি বেশ কাজে দিচ্ছিল। কিন্তু সব উল্টে দিলো করোনা মহামারি। এর ধাক্কায় পর্যটনশিল্প আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এলো আর চীনের জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজনও গেলো অনেক কমে। করোনা মহামারির শুরু থেকেই চীন সরকার এ ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নেয়। তারা আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের আগমন বন্ধ করে দেয়। সীমান্ত পথেও ভ্রমণে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
দেশের ভেতরে করা হয় লকডাউন। এর স্বল্পমেয়াদী প্রভাব পড়ে চীনের অর্থনীতিতে। সাময়িককালের জন্য হলেও অর্থনীতির গতি হয়ে যায় মন্থর। ফলে বিদেশ থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানির পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়।
এর নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব পড়ে তেলের দামে। সউদি আরব এবং অন্য যেসব তেলসমৃদ্ধ দেশ থেকে চীন দু'হাতে তেল কিনতো, চীনের চাহিদা কমে যাওয়ায় সেসব দেশে তেলের বিপুল দরপতন ঘটে। এ দরপতন আঘাত হানে ওসব দেশের অর্থনীতিকে।
দেশে-দেশে তেলের দরপতনের ভয়াল রূপটি যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে, গত এপ্রিল মাসে আমেরিকায় তেলের ব্যয় 'শূন্য' ডলারেরও নিচে নেমে যায়। এর অর্থ হলো, তেল কিনলে ক্রেতাকেই উল্টো টাকা দিতে হবে বিক্রেতার। এমন অবস্থায় গত জুলাই মাসে আইএমএফ পূর্বাভাস দেয় যে, করোনা মহামারীর আঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলশিল্পের রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এ বিপুল ক্ষতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে চীনেরও অনেককিছু। জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি কমে যাওয়ায় চীন কিছু সময়ের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বটে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আরব এনার্জি সুপার পাওয়ারগুলোর সাথে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কেন এমন পরিস্থিতি হচ্ছে আসুন জেনে নেয়া যাক
আমরা যদি ২০১৮ সালে ফিরে যাই। ওই বছর চীন অন্য যে-কোনো দেশের চাইতে সউদি আরব, ওমান ও কুয়েত থেকে বেশি পেট্রোলিয়াম আমদানি করে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথেও বিপুল বাণিজ্য করে চীনা ব্যবসায়ীরা। মোটের ওপর পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় চীনের পা রাখার মধ্য দিয়ে এসব দেশ পেয়ে যায় এক নির্ভরযোগ্য ক্রেতা।
এখন সবচাইতে ধনী আরব দেশগুলোও তাদের কাছ থেকে চীনের কেনাকাটা কমে যাওয়ার ক্ষতি অনুভব করছে। রাজতান্ত্রিক দেশ ওমানের কথাই ধরা যাক। কিছুদিন আগেও এ দেশটি তেল বিক্রির মুনাফা ব্যয় করতো কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার কাজে, করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি সামাল দিতে আজ তাদেরই হাত পাততে হচ্ছে প্রতিবেশীর কাছে!
মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বাড়াতে অনেক যৌথ প্রকল্প নেয় চীন। ওমানের দুক্বম শহরেও চীন একটি শিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠা করছিল। সেটি এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। শুধু ওমান নয়, গোটা উপসাগরীয় এলাকাতেই চীনের সব রকম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে আছে।
চীনের তেল-চাহিদা কমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব গোটা উপসগরীয় এলাকাজুড়ে অনুভূত হচ্ছে। ২০১৮ সালে চীন ছিল ইয়েমেনের তেলের বৃহত্তম এবং ইরাক ও লিবিয়ার তেলের দ্বিতীয়-বৃহত্তম আমদানিকারক।
সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমীরাত এবং অপর কয়েকটি দেশ যদিও সময়ের সাথে-সাথে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু গৃহযুদ্ধের কারণে ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেনের পক্ষে তা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রেতা হিসেবে ইরাক, লিবিয়া ও ইয়েমেনকে তেমন প্রয়োজনও নেই বিশ্বের দ্বিতীয়-বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের। তারা অন্য যে-কোনো দেশ থেকেই পেট্রোলিয়াম কিনতে পারে। একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে চীন চাইবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে, যে কাজটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে আমেরিকা ও রাশিয়া।
তেল কেনার শর্ত হিসেবে চীন উপসাগরীয় এলাকায় তার সেনাবাহিনীর উপস্থিতির সুযোগ চাইতে পারে বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেযবেক্ষক। ওই সুযোগ না-পেলে কী করবে চীন? তারা কি তখন ওই অঞ্চল থেকে নিজেদের সরিয়ে আনবে? পর্যবেযবেক্ষকদের মতে, চীন যদি তেমন কিছু করেই বসে, তবে তা হবে অন্য কয়েকটি এশীয় দেশের জন্য একটি বিরাট সুযোগ, যেসব দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে সাগ্রহে অপেক্ষায় আছে।
এ রকম একটি দেশ হলো ভারত। তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরুও করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ফোকাস করছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর। ওই দেশটি ভারতের সাথে প্রতি বছর ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল কেনার ক্ষেত্রে চীনের অপর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। চীনের সম্ভাব্য অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতার সুযোগ হারাতে চাইবে না তারাও।
তবে এ সবই হলো সম্ভাব্যতার বিষয়। এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হলো, মধ্য প্রাচ্যে এশিয়া ও পশ্চিমা প্রতিদ্ব›দ্বীদের চাইতে অনেক এগিয়ে আছে চীন। চীন এখন পর্যন্ত অপর দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করার পররাষ্ট্রনীতিতে অটল আছে। তারা অন্য দেশের কোনো কাজের সমালোচনা কখনোই করে না। ফলে ওসব দেশও চীনের প্রতি একই রকম সৌজন্য দেখিয়ে থাকে। রাজনৈতিক পর্যবেযবেক্ষকরা বলেন, এর সবচাইতে কুখ্যাত দৃষ্টান্ত হলো চীন-সউদি সম্পর্ক।
আমেরিকার মতো চীনও ইয়েমেনের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে সউদি আরবের জড়িয়ে পড়া নিয়ে একটি কথাও বলে না। প্রতিদানে সউদি আরবও উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনের বর্বর আচরণের মৌখিক নিন্দা করা থেকেও বিরত থাকে। চীন তার দখলীকৃত পূর্ব তুর্কেস্তান বা সিনচিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ মুসলিমকে ধর্ম ভুলিয়ে নাস্তিকতা শেখাতে দীর্ঘ দিন যাবত বন্দী করে রেখেছে।
কূটনৈতিক তৎপরতা ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল প্রভাব অর্জন করেছে আমেরিকা ও রাশিয়া। কিন্তু এই অ্যাডভেঞ্চার তাদের অনেক শত্রুও তৈরী করেছে। অপরদিকে আরব বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতির বিরোধিতা করে না কেউই। করোনা ভাইরাসের কারণে চীন ও আরব দুনিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, চীনা পররাষ্ট্রনীতির এই নির্দোষ অ্যাপ্রোচের কারণে সেই ক্ষতও হয়তো সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে।
তবে কি এর মানে দাঁড়াবে এই যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোনো-না-কোনোভাবে লেজ গোটাতে হবে পশ্চিমাদের! কী হয়, দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে