বিশ্বে যত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় তার প্রায় ৯০ ভাগ পন্য পরিবহন করা হয় সমুদ্র পথে। আর সমুদ্রপথে। এসব পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম কনটেইনার শিপ। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য সমুদ্রে নিয়োজিত রয়েছে দৈত্যাকার ৫০ হাজারের বেশি কনটেইনার শিপ ।
বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্যের মূল বাহন এসব কনটেইনার শিপ। জাতিসংরে তথ্য অনুসারে ২০১৮ সালে সমুদ্র পথে বিশ্বে মোট ১১ বিলিয়ন টন পন্য পরিবহন করা হয়েছে। এর ৬১ ভাগ খালাস করা হয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন বন্দরে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার শিপের নাম এইচ এম এম অ্যালজাসিরাস। এর মালিক দক্ষিণ কোরিয়ার হাইউন্দাই মারচেন্ট মেরিন বা সংক্ষেপে এইচএমএম। দক্ষিণ কোরিয়ার এইচএমএম বিশ্বের ৯ম বৃহৎ শিপিংলাইন কোম্পানি। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১১টি কনটেইনার শিপের মালিক এ কোম্পানি।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ কনটেইনার শিপের নাম এইচএমএম অসলো, তৃতীয় বৃহৎ কনটেইনার শিপের নাম এইচ এম এম গুলশান, চুতর্থ সুইজারল্যান্ডের এমএসসি মিনা এবং পঞ্চম হংকংয়ের ওওসিএল হংকং।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ২০ টি অধিক কনটেইনার শিপের আয়তন এবং পন্য বহন ক্ষমতা প্রায় সমান। কারণ সুয়েজ খালসহ বিভিন্ন সরু প্রণালীর কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান চাইলেও ইচ্ছামত বড় আকারের কনটেইনার শিপ নির্মান করতে পারে না। নির্মানের আগে সুয়েজ খালসহ বিভিন্ন প্রণালী দিয়ে এসব জাহাজ অতিক্রম করতে সক্ষম হবে কি না তা হিসেব করতে হয়।
বিশ্বে প্রথম কনটেইনার শিপ নির্মিত হয় ১৯৫৬ সালে। এরপর থেকে আজ অবধি তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে সমুদ্রগামী সবচেয়ে বড় পন্যবাহী জাহাজ নির্মাণের। কনটেইনার শিপ নির্মানের প্রতিযোগিতায় প্রতিবছর একটি আরেকটির রেকর্ড ভাঙছে।
এইচ এম এম এ্যালজাসিরাজ নির্মান করেছে দেয়উ শিপ বিল্ডিং এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। দুটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই দক্ষিন কোরিয়ার। অ্যালজাসিরাস পানামা পতাকাবাহী। এ্যালজাসিরাস ক্লাসের মোট ১২টি কনটেইনার শিপ নির্মিত হবে। এর মধ্যে ১০টির নির্মান শেষ হয়েছে। প্রত্যেকটির ক্ষমতা ও আয়তন সমান।
কনটেইনার শিপের পন্য বহন ক্ষমতা নির্ণয় একক হলো টি ই ইউ বা টুয়েন্টি ফুট ইকুই ভ্যালেন্ট ইউনিট। এ্যলজাসিরাস ক্লাসের প্রতিটি জাহাজের পন্য বহন ক্ষমতা ২৪ হাজার টি ই ইউ বা ২ লাখ ৩২ হাজার ৩১১ গ্রস টনেজ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার শিপ এইচ এম এম এ্যালজাসিরাসের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ১২ফিট। প্রস্থ ২০০ ফিট ২ ইঞ্চি। আসুন জেনে নেই বড় আকারের কন্টেইনার শিপ সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য
দক্ষিণ কোরিয়ার শিপিং লাইন এইচ এম এম জানিয়েছে ২০২০ সালেল ৮ মে এ্যালজাসিরাস ১৯ হাজার ৬২১ টিইইউ পন্য নিয়ে চীনের ইয়ানটিয়ান বন্দর ছেড়ে রটারডামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পন্য বোঝাই করে এটিই অ্যালজাসিরাসের প্রথম মহাদেশীয় সমুদ্র যাত্রা। ১৪ জুন চীন থেকে যুক্তরাজ্য পর্যন্ত যাত্রা শেষ করে অ্যালজাসিরাস।
অ্যালজাসিরাস কিংদা, বুসান, নিংবো, সাংহাই, ইয়ানতিয়ান, সিঙ্গাপুর, সুয়েজ ক্যানাল, রটারডাম, হামবার্গ, এন্টওয়ার্প, লন্ডন রুটে চলাচল করবে। এ্যালজাসিরাসের আগে সর্বোচ্চ পন্য বহনের রেকর্ড স্থাপন করে এমএসসি গুলশান। ২০১৯ সালের আগস্টে ১৯ হাজার ৫৭৪ টিইইউ পন্য নিয়ে মালয়েশিয়া ছেড়ে যায় জাহাজটি। এ্যালজাসিরাস ক্লাসের লিড শিপ বা প্রথম কনটেইনার শিপ এইচএমএম এ্যালজাসিরাস। ২০২০ সালেই বাকী সবগুলো জাহাজের ডেলিভারি দেয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্বে বর্তমানে আলোচিত একটি কনটেইনার শিপের নাম ওওসিএল হংকং। যদিও আয়তন এবং পন্য বহন ক্ষমতার দিক দিয়ে এটির অবস্থান পঞ্চম কিন্তু বিভিন্ন কারনে এ জাহাজটি গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে প্রায়ই। ২০১৭ সালে জাহাজটি যখন সার্ভিসে যুক্ত হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার শিপ।
এটি যেন এক সমুদ্র দানব। ওওসিএল হংকং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়। এর মালিক হংকংয়ের ওরিয়েন্ট ওভারসিস কনটেইনার লাইন বা সংক্ষেপে ওওসিএল।
বিশ্বের প্রায় সব বড় কনটেইনার শিপের নির্মাতা দক্ষিন কোরিয়ার বিভিন্ন শিপিং বিল্ডিং কোম্পানী। ওওসিএল এর নির্মাতা দক্ষিন কোরিয়ার স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ বিশ্বখ্যাত স্যামসাং গ্রæপের শাখা এবং এটিও বিশ্বের অন্যতম বড় একটি জাহাজ নির্মান শিল্প।
ওরিয়েন্ট ওভারসিস কনটেইনার লাইন জি ক্লাসের মোট ছয়টি কনটেইনার শিপ নির্মান করেছে। ছয়টি জাহাজের লিড শিপ বা প্রথম জাহাজ হলো ওওসিএল। সিরিজের বাকী কনটেইনার শিপগুলো হলো ওওসিএল জাপান, ওওসিএল জার্মানি, ওওসিএল ইউনাইটেড কিংডম, ওওসিএল স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং ওওসিএল ইন্দোনেশিয়া। প্রতিটি জাহাজই হংকংয়ের পতাকাবাহী। প্রত্যেকটি জাহাজের পন্যবহন ক্ষমতা ও আয়তন একই। একেকটি কেনটেইনার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন রুট মেনে পরিচালিত হয়।
জি ক্লাস কনটেইনার শিপের দ্বিতীয় জাহাজ হলো ওওসিএল জার্মানি। ওওসিএল ইন্দোনেশিয়া ছাড়া বাকী ৫টি জাহাজের নির্মান কাজ ২০১৭ সালে শেষ হয়। ২০১৫ সালে তখনকার পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় জি ক্লাসের ৬টি জাহাজ নির্মানের আদেশ পায় স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। কাজ শুরু হয ২০১৬ সালে। মাত্র ১ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫টি দানবাকৃতির এ কনটেইনার শিপ নির্মান একটি নজির সৃষ্টি করে।
প্রতিটি জাহাজ পূর্ব এশিয়া থেকে সুয়েজ খাল হয়ে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের প্রায় ১ ডজন বড় বড় বন্দরে পন্য ওঠা নামার কাজ করে। চীন থেকে উত্তর ইউরোপ হয়ে আবার চীনের বন্দরে ফিরে আসতে মোট সময় লাগে ৭৭ দিন।
ওওসিএল হংকং চলাচলের রুট হচ্ছে সাংহাই, নিংবো, জিয়ামেন, ইয়ানতিয়ান, সিঙ্গাপুর, সুয়েজ খাল, ফেলিক্সটো, রটারডাম এবং গিডান্স্ক। ওওসিএল হংকং এর পন্য বহন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার ৮৯০ গ্রস টনেজ বা ২১ হাজার ৪১৩ টি ই ইউ। একই সাথে জাহাজটি ১৪ হাজার ৯০৪ কিউবিক মিটার জ্বালানি বহন করতে সক্ষম। ওওসিএল হংকং এর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩১২ ফিট। প্রস্থ ১৯৩ ফিট। জাহাজটির গভীরতা ১০৬ দশমিক ৬ ফিট। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ্যালজাসিরাসের র্দৈঘ্য আর ওওসিএল হংকং এর দৈর্ঘ্য সমান। ওওসিএল হংকং যে ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হয় তার শিক্ত ৮৩ হাজার ৬৫৬টি হর্স পাওয়ারের সমান। জাহাজটির গতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২৪ মাইল।
ওওসিএলের আগে বিশ্বে সবচেয়ে বড় কনটেইনার শিপ ছিল মাদ্রিদ মার্সক। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং এর তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বে যত বানিজ্য পন্য পরিবহন করা হয় তার ৯০ শতাংশ বহন করা হয় সমুদ্রপথে। কনটেইনার শিপ বড় আকারের ইন্টার মোডাল কনটেইনার বহন করে।
বর্তমানে প্রধানত সাত ধরনের কনটেইনার শিপ সমুদ্রে চলাচল করছে। এগুলো হলো স্মল ফিডার, ফিডার ম্যাক্স, প্যানাম্যক্স, পোস্ট প্যানাম্যা´, নিউ প্যানাম্যাক্স এবং আল্ট্রা লার্জ কনটেইনার ভেসেল। এসব অনেক কনটেইনার ভেসেল এখন পাল্লা দিচ্ছে বিশালকার অয়েল ট্যাঙ্কারের সাথে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বড় কনটেইনার শিপের নাম এমএসসি গুলশান। গুলশান ক্লাসের মোট ৪টি জাহাজ রয়েছে। এ জাহাজও সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৯ সালে। গুলশান যখন চালু হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনটেইনার শিপ। এর আয়তন এবং ক্ষমতা অ্যালজাসিরাসের প্রায় সমান।
গুলশানের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩১২ ফিট। প্রস্থ ২০১ ফিট। গভীরতা ১০৯ ফিট। এটিরও নির্মাতা দক্ষিন কোরিয়ার স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ। এটিও পানামার পতাকাবাহী জাহাজ। তবে জাহাজটি পরিচালনা করছে জেনেভা, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক মেডিটারেনিয়ান শিপিং কোম্পানী।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ কনটেইনার শিপের নাম এমএসসি মিনা। মিনা ক্লাসের মোট ৫টি জাহাজ রয়েছে এবং এটি সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৯ সালে।
বিভিন্ন ক্লাসের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ২২টি কনটেইনার শিপের ২২টিই পানামা পতাকাবাহী। যদিও এসব জাহাজের মালিক ভিন্ন ভিন্ন দেশ। পানামা পতাকাবাহী ২২টি জাহাজের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান দখকারী কনটেইনার শিপ।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে