তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা তো বটেই, এমনকি যারা শুধুই খোঁজখবর রাখেন তারাও 'টিকটক' নামটির সাথে যে পরিচিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হালে চীন-মার্কিন বাণিজ্যবিরোধের সূত্র ধরে নামটি আরো বেশি আলোচনায় এসেছে। নিজের স্মার্টফোনের সাহায্যে নিজেকে যারা অন্যের কাছে তুলে ধরতে চায়, সেসব লোকের জন্য টিকটক আসলেই একটি বিপ্লব এনেছে। টিকটকের ওপর দারুণভাবে ক্ষেপে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প। বলা যায় অ্যাপটির বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
ইউজারদের কাছে টিকটক ভিডিও তৈরির এটাই প্রথম অ্যাপ নয়। বিশ্বব্যাপী যেসব তরুণ সামাজিক ও শ্রেণিগত প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে চায় তাদের কাছে টিকটক দারুণ প্রিয়। কারণ, টিকটক-এর রয়েছে সহজে সম্পাদনার সরঞ্জাম, বন্ধুসুলভ ইন্টারফেস, শর্ট ভিডিও ফরম্যাট। সব মিলিয়ে তরুণ সমাজের মন কেড়েছে টিকটক।
এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন ৭৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ টিকটক ব্যবহার করে থাকে। তারা এতে জনপ্রিয় গানগুলোর সাথে ঠোঁট মেলায়, অ্যাক্রোবেটিক কিংবা রন্ধনকুশলতা প্রদর্শন করে অথবা একেবারে কিছু না-করলে পোষা কুকুরের সাথে সময় কাটানোর ভিডিও করে। মোটের ওপর যার যা-কিছু ভালো লাগে, সবই তারা করে টিকটক-এ।
জনপ্রিয়তার বিচারে টিকটকের অবস্থান এখন ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের পাশাপাশি। রাজস্ব আয়ের দিক বিচারে টিকটক-এর সবচাইতে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিজ্ঞাপন থেকেই তারা এ আয় করে থাকে। এ অবস্থায় টিকটক-এর মালিক, চীনের বাইটড্যান্স-কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিচ্ছে যেন ওই কোম্পানি তাদের আমেরিকান অংশটা বিক্রি করে দেয়। শুধু তাই নয় চীনের এই অ্যাপটি ভারতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পর ভারত সরকার চীনের যে সব অ্যাপ নিষিদ্ধ করে তার মধ্যে টিকটিকও রয়েছে।
কিন্তু কেন টিকটক-এর মার্কিন অংশটা কিনে নিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র? আর কেনই বা এই অ্যাপটির বিরুদ্ধে এতো সোচ্চার হয়ে উঠেছে ট্রাম্প প্রশাসন। যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন মিত্র ভারতও সুর মিলিয়েছে? যদিও সীমান্তে সৈন্য হারানোর বেদনা অ্যাপ নিষিদ্ধের মধ্যে সান্তনা খুজছে ভারত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের কিছু কারণ রয়েছে। আসুন খুঁজে দেখা যাক সে সব কারণ।
টিকটক নামের অ্যাপটির প্রতিষ্ঠাতা জাং ঈমিং নামের এক চীনা নাগরিক। তারা তাদের মার্কিন অংশটা বিক্রি করতে চাচ্ছে না, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্রমাগত চাপের মুখে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন প্রশাসনের ধারণা ও অভিযোগ, টিকটক ব্যবহারকারী মার্কিনী তরুণদের কাছ থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। এমন অভিযোগ তুলে গত ৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর দেশে টিকটক নিষিদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক-এর নিষিদ্ধ হওয়া ঠেকাতে এর ব্যক্তি খাতের অংশীদাররা ঈমিং-কে পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি যেন কোনো মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে এটি বিক্রি করার কথা বিবেচনা করেন।
টিকটক আরো একটি ধাক্কা খেয়েছে, যার ফলে এর মার্কিন অংশ বিক্রি করার সম্ভাবনা আরো বেড়েছে। ধাক্কাটি হলো, টিকটক-এর মার্কিন অংশের সিইও বা প্রধান নির্বাহী কেভিন মেয়ারের পদত্যাগ। ওয়াল্ট ডিজনির সাবেক নির্বাহী মেয়ার মাত্র তিন মাস ছিলেন টিকটক-এ। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এতোটা রাজনীতি ভরপুর পরিবেশে কাজ করা খুবই কঠিন।
মার্কিন প্রশাসন এর আগে চীনা কম্পানির কাছে আমেরিকান কম্পানি বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল, এমনকি জোর খাটিয়ে কয়েকটি কম্পানির বিক্রি ঠেকিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু অনেক সম্ভাব্য ক্রেতা আছে এমন একটি চৈনিক অ্যাপকে আমেরিকান বাজারছাড়া করার চেষ্টা এটাই প্রথম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে হুয়াওয়েসহ সব চীনা কম্পানি চীন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে থাকে অর্থাৎ সোজা কথায়, গোয়েন্দাগিরি করে থাকে। এর মাঝে টিকটক ছিল ব্যতিক্রম। তারা নিজ দেশে কোনো সরকারি কন্ট্রাক্ট পেয়ে নয়, বরং নিজস্ব উদ্ভাবনা দিয়েই নিজেদের বাজার তৈরি করে নিয়েছিল।
এ অবস্থায় প্রযুক্তি খাতের বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন মাইক্রোসফট, ওরাকল ও টুইটার আগ্রহ প্রকাশ করেছে টিকটককে কিনে নেয়ার। টিকটকের মালিক সংস্থা বাইটড্যান্স-এর মতে, টিকটকের মার্কিন অংশের দাম পড়বে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে তাদের উদ্ভাবিত একটি নতুন অ্যাপ নিয়ে এর দাম গড়াবে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র কয়েক মাস আগেও কোনো-কোনো বিশ্লেষক এর দাম আন্দাজ করেছিলেন ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
টিকটক সবচাইতে বেশি রাজস্ব আয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। এর পরেই তাদের বড় বাজার হলো যথাক্রমে ব্রিটেন, কানাডা ও তুরস্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ টিকটক ব্যবহার করে থাকে। অথচ ২০১৮ সালের শুরুতে সেখানে এর ব্যবহারকারী ছিল মাত্র এক কোটি ১০ লাখের মতো। এভাবে চীনা মোবাইল অ্যাপটির সর্বাধিক ডাউনলোডকারী দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশ্ন হচ্ছে, টিকটক কী কারণে চীনা এই অ্যাপটি সারা বিশ্বে এতোটা জনপ্রি ও সফল হতে পারলো?
মজার মজার নাচ ও ঠোঁট মেলানো হাস্যকৌতুকের ভিডিও তৈরি ও শেয়ার হয় এই টিকটক অ্যাপে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর চাহিদামতো যে কোনো কিছুর সাথে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করা যায়। আবার পছন্দের গানের সাথে নাচ বা নানা ধরনের কমেডিও তৈরি করা সম্ভব। স্টিকার, ফিল্টার ও অগম্যান্টেড রিয়েলিটিও ব্যবহার করা যায় এসব ভিডিওতে। ফ্রি এই অ্যাপটিকে ইউটিউবের একটা ছোট সংস্করণই বলা চলে।
টিকটক ব্যবহারকারীরা এখানে এক মিনিট লম্বা ভিডিও পোস্ট করতে এবং এখানকার বিশাল তথ্যভান্ডার থেকে গান ও ফিল্টার বাছাই করতে পারেন। তারা নিজেদের মধ্যেও ব্যক্তিগত বার্তা আদান প্রদান করতে পারেন এই অ্যাপের মাধ্যমে। যারা কিছুটা অভিনয় করেন বা কমেডি করতে পারেন, তাদের নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরার জন্য এই টিকটক একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উঠে এসেছে।
এমন জনপ্রিয় একটি অ্যাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সময় আছে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ এর মধ্যেই হেস্তনেস্ত একটা কিছু করে ফেলতেই হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের আর খুব বেশি দেরি নেই। সে-পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যাক, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে