কয়েক বছর আগেও ভারতকে মনে করা হতো অর্থনীতির একটি সফলতার গল্প। তবে তা এখন শুধুই সুখময় অতীত। ভারতের সামনে ঘোর অমানিশা। করোনার তান্ডবে দেশটির ২০ কোটি মানুষ আবার দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির মর্যাদাও হারাতে পারে ভারত। ভারতের অর্থনীতির এই বেহাল চালচিত্র তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাত ভারতের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। এটা সবচেয়ে ভালো চোখে পড়বে সুরাটের শিল্পাঞ্চলের ফাঁকা রাস্তাগুলোতে। কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানে যেসব টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠেছে সেগুলো থেকে এখন আর কর্ণবিদারী শব্দ শোনা যায় না। কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র দশভাগের একভাগ কাপড় এখন তৈরি হচ্ছে।
এখানকার পরিবারগুলোর বিবর্ণ মুখগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা এক সময় শাড়িতে নিপুণ কারুকাজ করতো। আর এখন তারা সামান্য ব্যবসায় শাকসবজি চাষ বা দুধ বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন। সেলুনগুলো ফাকা পড়ে থাকে। লোকজনের হাতে টাকা নেই বলে মোবাইল ফোনের দোকানগুলো মরুভূমির মতো নির্জন।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রের টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি আশীষ গুজারাতি তার নির্জন কারখানার সামনে বোমাবিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলেন। একবুক কষ্ট নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ধোঁয়া নির্গমনের চুল্লিগুলো দেখতে পাচ্ছেন না? সেখান থেকে তো ধোঁয়া বের হওয়ার কথা ছিল।
বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন ভারতের ভবিষ্যত একেবারেই অন্যরকম মনে হতো। বিকাশমান অর্থনীতির জন্য ভারত গর্ব করত। অর্থনৈতিক উত্থানের ফলে ভারতের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। গড়ে উঠেছিল বড় বড় শহর।
ভূরাজনীতিতেও শক্তিধর হয়ে উঠেছিল ভারত। ভারতের জনগণ মধ্যবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। সনাতন সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নও শুরু হয়। ভারত একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । আশা করা হয়েছিল, একদিন এশিয়ায় সবচেয়ে বড় সফলতার গল্প চীনের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠবে ভারত। তবে সুরাটসহ গোটা ভারতজুড়ে অর্থনীতি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে ভারতের অনেক উচ্চাকাংখাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের অন্য বড় অর্থনীতিগুলোর চেয়ে ভারতের অর্থনীতিত দ্রুত সংকুচিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৫ ভাগ কমেছে। বিশ্বের অন্য কোনো বড় অর্থনীতিই এতোটা সংকুচিত হয়নি। কোনো কোনো হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতে আবার ২০ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে যেতে পারে।
এক সময়ের প্রাণচঞ্চল অনেক সড়ক এখনও ফাঁকা। করোনাভাইরাস আতঙ্কে লোকজন বাইরে বের হতে চাচ্ছেন না। এই সর্বনাশ হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জারি করা লকডাউনের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ছিল বজ্র আটুনি ফস্কা গেরোর মত ব্যাপার। এতে অর্থনীতির যেমন ক্ষতি হয়েছে তেমনি ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতে এখন বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে প্রতিদিন ৯০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দেশটিতে। দৈনিক মারা যাচ্ছে সহস্রাধিক লোক।
পুরো দেশেই আতঙ্ক আর অস্বস্তি বিরাজ করছে। তবে করোনার আগে থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে আসছিল। বাড়ছিল সামাজিক বিভাজন। মুসলিমবিরোধী মনোভাবও ছিল বাড়বাড়ন্ত। ভারতে করোনা ছড়ানোর জন্য সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যাভাবে দায়ী করা হচ্ছে মুসলিমদের। এদিকে চীন ভারতের ভূখন্ড শক্তিমত্তা দেখাচ্ছে। পন্ডিতরা ভারতের এই অবস্থাকে কয়েকটি বিশেষ শব্দে চিত্রিত করেছেন। এগুলো হলো : লস্ট, লিস্টলেস, উন্ডেড, রাডারলেস ও আনজাস্ট। অর্থাৎ নিখোঁজ, তালিকাহীন, আহত, দিশাহীন ও বৈষম্যমূলক।
ভারতের বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায় বলেন, ইঞ্জিনটি ভেঙে গেছে। টিকে থাকার সক্ষমতা গুড়ো হয়ে গেছে। এবং সব টুকরোগুলো বাতাসে উড়ছে। আপনি জানেন না সেগুলো কোথায় কিভাবে পড়বে।
সম্প্রতি এক সাপ্তাহিক বেতার ভাষণে মোদিও বলেছেন যে ভারত বহু ফ্রন্টে লড়াই করছে। তবে ভারতের এখনও কিছু শক্তি আছে। দেশটিতে রয়েছে বিশাল তরুণ শ্রমশক্তি এবং প্রযুক্তিতে চৌকস জনগোষ্ঠী। যুক্তরাষ্ট্রসব অনেক দেশ চীন থেকে সরে যেতে চাইলে বা উৎপাদন ব্যবস্থা স্থানান্তর করার জন্য সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে ভারত।
বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ক্ষয়িষ্ণু। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি ২৪ ভাগ সংকুচিত হলেও চীনের অর্থনীতির সব সূচক আবার উর্ধ্বমুখি হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ভারতের যে মর্যাদা ছিল তা হারানোর ঝুকি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও জার্মানির পরই ভারতের অর্থনীতির আকার।
নয়া দিল্লির জওহরলাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জয়তি ঘোষ বলেন, ভারতের স্বাধীনতার পর এটাই সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময়। লোকজনের হাতে টাকা নেই। বাজারে চাহিদা নেই বলে বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করছেন না। প্রায় প্রতিটি জিনিসের দামই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
নয়া দিল্লির উপকণ্ঠে আগে বাস করতেন নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা। সে জায়গাগুলো এখন মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করছে। টিনের তৈরি এই ঘরগুলোতে কেউ নেই। অথচ কয়েক বছর আগেও ভারতের অর্থনীতি ৯ শতাংশ হারে বাড়ছিল। তখন এই এলাকাগুলোতে বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন ছিল।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্রোতের ওপর ভর করে ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন মোদি। তখন অনেক ভারতীয় মনে করেছিলেন যে অবশেষে তাদের আকাংখা পূরণের জন্য একজন শক্তিধর নেতার সন্ধান পেলেন তারা। তবে মোদি তার শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন বিভাজনমূলক আদর্শ বাস্তবায়নে। তিনি নতুন যে নাগরিকত্ব আইন করেছেন তাতে মুসলিমদের প্রতি চরম বৈষম্য করা হয়েছে। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়েছেন তিনি।
মোদির কর্তৃত্ববাদী শাসন অনেক ভোটারকে আকৃষ্ট করলেও সেটাই সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করা হয়। যেমন চার বছর আগে তিনি ভারতের ৯০ শতাংশ মুদ্রা হঠাৎ করে বাতিল করে দেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পদক্ষেপে ভারতের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়েছে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর হটকারিতা দেখিয়েছে মোদি সরকার। গত ২৪ মার্চ রাত আটটায় ভারতে লকডাউন জারি করেন মোদি। মাত্র চার ঘণ্টার সময় দিয়ে তিনি ভারতের সবকিছু অচল করে দেন। এতে তৎক্ষণাত কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে পড়েন।
শহরে কারখানা ও নির্মাণে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তারা গ্রামীন এলাকা থেকে আসা। লকডাউনের কারনে অনেকে অনাহারে মরার দশায় উপনীত হন। পরে উপায়ান্তর না পেয়ে অনেকে হেটে ও বাইসাইকেলে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে গ্রামে পাড়ি দিতে শুরু করেন। এতে রচিত হয় এক বিয়োগান্তক অধ্যায়ের। পথেই মারা যায় কেউ কেউ। এভাবে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হওয়া অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এরফলে ভাইরাসটিও ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেন, ভারতে দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতির যে লজ্জাজনক অবনতি হয়েছে তার পুরোটা ঘটেছে এ ধরনের লকডাউনের কারণে। করোনা থামানো গেলে তাও হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু তা তো হয়নি। তিনি মোদির এই নীতিকে ব্যর্থ বলেও মন্তব্য করেন।
সুরাতের একটি ক্রেতাশূন্য পোশাকের বাজারে বাহারি শাড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন জগদীশ গয়াল। এখানে কম দামি শাড়ি বিক্রি হয়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, কেউ কিনছে না। কারণ কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান হয় না। বিয়ে শাদি নেই, জন্মদিনের উৎসব হয় না। লোকজন ভয়ে বের হতে চায় না।
মোদি সরকার দরিদ্রদের জন্য ২৬ হাজার কোটি ডলারের ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা ছিল খবুই অপ্রতুল।
সরকারের কর আদায়ে ধস নেমেছে। কয়েকটি রাজ্যের সরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন দিতেও পারছে না। সরকারের ঋণ গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে।
তবে এসব সত্ত্বেও মোদির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। ইন্ডিয়া টুডের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, মোদির কাজকে সমর্থন দিচ্ছেন ৭৮ শতাংশ লোক। গত ৫ বছরের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ জনমর্থন। শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিও মোদির জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণ। মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যেভাবে আকড়ে ধরেছেন তাতে বেশিরভাগ হিন্দু খুশি। ভারতের জনসংখ্যার ৮০ ভাগই হিন্দু।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে