একটি পুরনো তেল পাইপলাইন, যা নির্মিত হয়েছিল বহুকাল আগে। তখন ইরান শাসন করতেন শাহ রেজা পাহলভী এবং ওই শাসকগোষ্ঠীর সাথে ছিল ইসরাইলের ওপেন সিক্রেট দহরম মহরম। সেই পুরনো পাইপলাইনটিই আজকের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে ইসরাইলের জন্য নিয়ে এসেছে যুগপৎ ঝুঁকি ও সম্ভাবনা। ইসরাইল ও তার প্রতিবেশী দেশগুলো মিলে তুরস্কের বিরুদ্ধে এ ফাঁদ তৈরী করেছে।
ইসরাইলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র তাই কোনো রাখঢাক না-রেখেই বলে, যা-কিছুই ইসরাইল ও আমীরাতকে কাছাকাছি আনবে এবং তুরস্কের ভূমিকা হ্রাস করবে তাতেই আমাদের লাভ। এখন থেকে তুরস্ক ও তার মিত্রদের পরিবর্তে ইসরাইলই হবে আরব তেলের পরিবহণকারী জাহাজ।
উল্লেখ্য, গত আগস্ট মাসে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সংযুক্ত আরব আমীরাত। তারাই প্রথম উপসাগরীয় দেশ, যারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলো। এটি ছিল নতুন আঞ্চলিক জিওপলিটিক্যাল অর্ডার প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এর এক মাস আগে ইসরাইলের বাজারে প্রবেশ করে শেভরন। তারাই প্রথম বৃহৎ তেল-গ্যাস কম্পানি, যারা ইসরাইলের বাজারে ঢুকলো। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক তেল-গ্যাস বাজার থেকে ইসরাইলের কয়েক দশকের বিচ্ছিন্নতা অবসানের সূচনা ঘটলো।
এর সমান্তরালে ইহুদি দেশটি আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়লো তুরস্ক ও গ্রীসের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায়।
গত জানুয়ারি মাসে গ্রীস ও সাইপ্রাসের প্রধানমন্ত্রীদের সাথে এক চুক্তি করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ চুক্তিবলে ঈস্টমেড পাইপলাইন দিয়ে তিন দেশের গ্যাস যাবে ইউরোপে। এটি হচ্ছে তুরস্কের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটা পাল্টা ব্যবস্থা। তুরস্ক চায়, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আমলের মতো ওই অঞ্চলের সবকিছুতে নিজের একটা ভূমিকা রাখতে।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে লিবিয়ার সাথে মিলে একটি এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন বা ইইজেড প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় তুরস্ক। এতে ভূমধ্যসাগরে তাদের জলসীমার আওতা যেমন বাড়ে, তেমনি কমে যায় গ্রীসের।
এদিকে ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রচেষ্টা থামিয়ে দিতে ক্রিট দ্বীপে যুদ্ধজাহাজ ও রণতরী পাঠায় ফ্রান্স। নিজের স্বার্থ রক্ষা এবং গ্রীসকে মদদ দিতে ভূমধ্যসাগরে সৈন্য পাঠায় আমিরাতও। এর মধ্য দিয়ে আমিরাত হলো প্রথম আরব দেশ, যারা ভূমধ্যসাগরে সেনা মোতায়েন করলো।
তুরস্কের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তির এভাবে একজোট হওয়াটা ইসরাইলের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। কেননা, ইসরাইলের অবস্থানই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ; উপসাগরীয় এলাকা ও ইউরোপের মাঝখানে। ইসরাইলের ইউরোপ এশিয়া পাইপলাইন কোম্পানির জন্য প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী নিজেও ক'দিন আগে বলেছেন সে-কথা। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, আমীরাতের সাথে শান্তিচুক্তি আমাদের সামনে অনেকগুলো দরজা খুলে দিয়েছে, এনে দিয়েছে অনেক সুযোগ। পারস্য উপসাগরের তলদেশ দিয়ে পাইপলাইনের সাহায্যে ইউরোপের বাজার পর্যন্ত তেল নিয়ে এখন আর কোনো বাধা থাকছে না।
আশকেলন-এইলাত পাইপলাইন ফের চালু করার পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার ইসরাইলী গ্যাসক্ষেত্রগুলো উৎপাদন শুরু করলে ওই এলাকাটি আবার বিশ্ব জ্বালানি বাজারে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে, যেমন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে।
১৯৩৫-৪৮ সালে, যখন প্যালেস্টাইন ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেটভূক্ত একটি এলাকা, তখন ইরাক থেকে ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরনগরী হাইফা পর্যন্ত একটি পাইপলাইনই ছিল বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের প্রাইমারি লিঙ্ক।
বৃহৎ শক্তিগুলো প্যালেস্টাইনে জোর করে ইসরাইল নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে আরব লীগ ওই দেশটিকে বয়কট করে। ইরাকও হাইফায় তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এমন অবস্থায় ইসরাইল তার তেলের চাহিদা মেটাতে দ্বারস্থ হয় মার্কিনপন্থী ইরানের। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে তেল নিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে ইসরাইল এ সময় এইলাত থেকে আশকেলন পর্যন্ত ট্রান্স-ইসরাইল পাইপলাইন স্থাপন করে। ইসরাইল ও ইরান - এ দু' দেশের সরকারই ৪২ ইঞ্চির এ পাইপলাইন নির্মাণ করে। এটি নির্মাণব্যয়ের একটি অংশ বহন করেন মার্কিন বিলিয়নেয়ার মার্ক রিচ।
১৯৬৮ সালে পাইপলাইনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এটি যে উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়েছিল, পরবর্তী এক দশক পর্যন্ত সেই কাজ করে যায়। গোল বাধে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর। এ সময় দু' দেশের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ইসরাইল সরকার আবার হঠাৎ করে পাইপলাইনটি জাতীয়করণ করে। সব মিলিয়ে পাইপলাইনটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
২০০৩ সালে এসে তেল যাওয়া-আসার ব্যবস্থা সংবলিত একটি প্রকল্প সম্পন্ন হয়। তখন থেকে পাইপলাইন দিয়ে তেল যাওয়া-আসা দু'টোই চলতে থাকে। আর এভাবে এলিয়াত-আশকেলন পাইপলাইনটি হয়ে যায় আশকেলন-এলিয়াত কনডুইট। কম্পানির নতুন নাম হয় ইউরোপ এশিয়া পাইপলাইন কম্পানি এবং রাশিয়া, আজারবাইজান ও কাজাখস্তান থেকে তেল গ্রহণ করে তা পাঠিয়ে দিতে থাকে এলিয়াতে। সেখান থেকে তা ট্যাংকারভর্তি হয়ে চলে যায় পূর্ব এশিয়ায়।
সেই পাইপলাইনটিকে ফের কাজে লাগিয়ে পারস্য উপসাগর থেকে ইউরোপে তেল পাঠানোর ব্যবস্থাটি তুরস্কবিরোধী জোটের সবাই সমর্থন করে। ইউরোপে তেল পৌঁছানোর নতুন ব্যবস্থাটি কার্যকর হলে কিরকুক-সেইহান পাইপলাইনের গুরুত্ব অনেক কমে যাবে, যার মানে হলো বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে তুরস্কের গুরুত্বও কমে যাওয়া।
এদিকে প্রতিবেশী লেবাননের রয়েছে দু'টি পাইপলাইন, যেগুলো সিডন ও ত্রিপলি বন্দর হয়ে সউদি আরব ও ইরাকের সাথে যুক্ত হয়েও বেশ অনেক বছর ধরে অকার্যকর পড়ে আছে। লেবাননের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রোগ্রামগুলোও দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির অভিযোগে 'থেকেও নেই' অবস্থায় পড়ে আছে।
এর বিপরীতে ইসরাইল ইতিমধ্যে তার বিপুল গ্যাসসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে। এছাড়া তারা এখন লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত একটি সচল পাইপলাইনেরও মালিক।
তবে ইসরাইলী পাইপলাইন তার হারানো গৌরব অত সহজে ফিরে পায়নি, অনেক ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। এজন্য ইসরাইলকে মিশরের সাথে শান্তিচুক্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কেননা পারস্য উপসাগরীয় এলাকার তেলের একটা বিরাট অংশকে মিশরের সুয়েজ খাল পাড়ি দিতে হয়।
২০১৫ সালে সুয়েজ খালের বহনক্ষমতা দ্বিগুণ হলেও ওই খাল দিয়ে এখনও বিশাল আকৃতির সুপারট্যাংকারগুলো চলতে পারে না। অথচ আজকাল তেল বাণিজ্যের বড় অংশই চলে সুপারট্যাংকারের সাহায্যে। এর ওপর আবার চলাচলের ফীও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ। কখনও কখনও এটা চার লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
এ সুযোগটা নিতে চাইছে ইসরাইল। দেশটির ইউরোপ এশিয়া পাইপলাইন কোম্পানি দাবি করছে যে তারা এর চাইতে অনেক কম খরচে এর চাইতে ভালো সার্ভিস দিতে পারবে। কম্পানির প্রধান নির্বাহী মিডিয়াকে বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমানে সুয়েজ খাল দিয়ে বাহিত তেল বাণিজ্যের ১২ থেকে ১৭ শতাংশ ইসরাইলী পাইপলাইনে নিয়ে আসা।
তবে একই সময়ে ইসরাইলী পাইপলাইন নিয়ে প্রশ্নও আছে। ২০১৪ সালে তাদের পাইপলাইনে একটি ফাটল দেশটির ইতিহাসে সবচাইতে ধ্বংসাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটায়। মরুভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে ১৩ লাখ গ্যালনেরও বেশি অশোধিত তেল।
যাহোক, নতুন বাস্তবতায় ইসরাইলের নেতানিয়াহু সরকার বেশ উল্লসিত। তারা একে তাদের পররাষ্ট্রনীতির বিজয় বলে ভাবছে। তবে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বেশ সতর্ক। তাঁরা ভাবছেন, নতুন প্রকল্পটি সফল হবে কী না, হলে মিশর-ইসরাইল সম্পর্কে তার কেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ইসরাইলীপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন সূত্র মিডিয়াকে বলে, আমীরাত ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের সাথে সুসম্পর্ক আমাদের দরকার, তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে মিশরের সাথে শান্তি সবচাইতে জরুরি। আমাদের সামনে এগোতে হবে মিশরকে সাথে নিয়েই; তাদের স্বার্থহানি করে নয়।
ইসরাইল ভাবছে মিশরের স্বার্থহানি না-করার কথা! সত্যিই, রাজনীতি বড়ই বিচিত্র।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে