উপসাগরীয় ক্ষুদ্র দেশ কাতার বিশ্বের এক বিস্ময়কর অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বের ৪০টি দেশে কাতার ৪০০বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই অর্থ বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক রিজার্ভের দশগুণ। শুধু যুক্তরাজ্যেই কাতারের বিনিয়োগ ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
বিদেশে বিনিয়োগের জন্য কাতার গড়ে তুলেছে কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি বা কিউআইএ নামের একটি সার্বভৌম আর্থিক তহবিল।
প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল কাতার বিশ্বের বহু নামীদামী ব্র্যান্ডে বিনিয়োগ করে চলেছে। কাতার বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কৌশলগত স্বার্থ এবং দীর্ঘমেয়াদী লাভের বিষয়টি বিবেচনা করে থাকে। বিভিন্ন দেশে অবকাঠামো, খুচরা বিক্রি, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, গাড়ি নির্মাণ শিল্প, ক্রীড়া, বিনিয়োগ ব্যাংকিং, রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, পর্যটন, কৃষি, কাঁচামাল, বাণিজ্য ইত্যাদি খাতে কাতার বিনিয়োগ করে থাকে।
ইউরোপে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে কাতার। যেমন জার্মানিতে গত ৩০ বছরে কাতারের বিনিয়োগ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভক্সওয়াগন, ডয়চে ব্যাংক, সিমেন্স, হচটিফ ও সোলার ওয়ার্ল্ডের মত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ শেয়ারহোল্ডার কাতার।
যুক্তরাজ্যে কাতার মোট ৫৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার সমান। কাতার বিখ্যাত এইচএসবিসি টাওয়ার, আকাশচুম্বী ভবন শার্ড, অলিম্পিক ভিলেজ, খ্যাতনামা হ্যারোডস স্টোর, স্যাভয় হোটেলসহ বিভিন্ন খাতেবিনিয়োগ করেছে।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সুপারমার্কেটব চেইন সেইন্সবুড়ির ২২ শতাংশ মালিকানা কিনে নিয়েছে কাতার। লণ্ডনের বিখ্যাত হিথ্রো বিমানবন্দরেরও ২০শতাংশের মালিকানা কাতারের। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মালিক ইন্টারন্যাশনাল কনসলিডেটেড এয়ারলাইন গ্রুপেরও ২০ শতাংশের মালিক কাতার।
কাতার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। এর ১০ শতাংশের বেশি মালিকানা কাতারের। কাতার যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম ব্যাংক বারক্লেসের ৬শতাংশের মালিক ।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট টোবিয়াস এলউড বলেছেন, যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহত্তম বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে কাতারের অংশগ্রহণ রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।
টোবিয়াস বলেন, ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানি করেছে কাতার। একই সময়ে কাতারে যুক্তরাজ্যের রফতানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, দুই দেশের যৌথ মালিকানার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬২২টি। জ্বালানি, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও শিক্ষাসহ নানা খাতে দুই দেশের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে।
ফ্রান্সের ইতালির অভিজাত ব্র্র্যান্ড ভ্যালেন্টিনো ফ্যাশন গ্রুপ স্পাকে ৮৩ কোটি ডলারের বেশিতে কিনে নিয়েছে কাতার।
সম্প্রতি ইস্তাম্বুলের র্ব্সা শেয়ার মার্কেটের ১০ শতাংশ কিনে নিতে চুক্তি করেছে কাতার। তুরস্কের আর্থিক খাতসহ মিডিয়া, জ¦ালানি ও রিয়েল এস্টেট খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে চলেছে কাতার।
রাশিয়ার বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী রসনেফটের ১৯ শতাংশের মালিক কাতার। এ কোম্পানিতে কাতার বিনিয়োগ করেছে ১১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিমানবন্দরের ২৫ ভাগ মালিকানা কিনে নেয় কাতার।
যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কাতার ২০১৫ সালে নিউইয়র্কে অফিস খুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় কাতার। এজন্য নিউইয়র্কের পাশাপাশি লস এঞ্জেলেসেও অফিস খুলেছে কাতার। এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিংয়ের মালিকানায় থাকা কোম্পানির ১০ভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে কাতার। নিউইয়র্কে রিয়েল এস্টেট খাতে ৯বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে কাতার। যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ৫৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় কাতার।
পৃথিবীর সবচেযে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশ কাতার। ২০১৬ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, কাতারে মাথাপিছু আয় এক লাখ ত্রিশ হাজার ডলার। কাতারের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গ। তাদের মাথাপিছু আয় কাতারের চেযে ২০ হাজার ডলার কম।
কাতার একটি রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশটি শিল্পকলার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। দেশটি নামী-দামী বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। কাতার আমিরের বোন চিত্রকর্মের জন্য বছরে ১০০ কোটি ডলারের মতো ব্যয় করেছেন বলে জানা যায়। রাজধানী দোহায় ইসলামিক আর্ট জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রায় ১৪০০ বছরের নানা ধরনের চিত্রকর্ম এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে।
যারা দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছেন তাদের চোখে বিশাল আকৃতির একটি ভাল্লুকের শিল্পকর্ম চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। প্রায় এক দশক আগে সুইজারল্যান্ডের একজন ভাস্করের তৈরি এ ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জের তৈরি এবং এর ওজন প্রায় ২০টন। ২০১১ সালে নিউইয়র্কে এক নিলাম থেকে প্রায় সাত মিলিয়ন ডলার খরচ করে এ ভাস্কর্যটি কিনে নেয় কাতার সরকার।
২০১১ সালে কাতার ফ্রান্সের খ্যাতনামা টিম প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন বা পিএসজি টিমকে কিনে নেয়। এই টিমে ডেভিড বেকহামকেও কিনে নেয় কাতার। কাতার এই টিমে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্য অনেক দেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিপ্রয়োগের দিকে এগোচ্ছে, কাতার এগোচ্ছে ভিন্নপথে। কেবল ২০২২ বিশ্বকাপ নয়, ইউরোপের ক্লাব ফুটবলেও বিশাল বিনিয়োগ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে উপস্থাপন করছে অন্য এক চেহারায়।
কাতার এয়ারওয়েজের মতো রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা বায়ার্ন মিউনিখের মতো বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে ইউরোপের সেরাদের লড়াইয়ে ফাইনালটা যখন পিএসজি আর বায়ার্নের মধ্যে হয়, তখন যেই জিতুক না কেন আসলে জয় হয় কাতারের।
গত শতকের ৯০ এর দশক থেকেই কাতার খেলাধুলার মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। পিএসজিতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ছাড়াও ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্যই ব্যাপক যোগাযোগ চালিয়ে সফল হয় দেশটি।
জার্মানির কনরাড আডেনয়্যার ফাউন্ডেশন টু গালফ স্টেটসের প্রতিনিধি ফাবিয়ান ব্লুমবার্গ বলেন, ‘খেলাধুলা এবং বিজ্ঞানের কৌশলগত বিনিয়োগ কাতারকে এগিয়ে নিয়ে চলছে। দুটোই একদিকে কাতারের ক্ষমতাও বাড়াচ্ছে, বহির্বিশ্বে কাতারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করছে।’
তবে অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষণীয় সাফল্যের অধিকারী কাতারের শঙ্কা ছিল তার হটকারি প্রতিবেশীদের নিয়ে। তারা কাতারের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে কতটা মেনে নেবে তা নিয়ে দোহার উদ্বেগ ছিল। এসব কারণে ১৯৯০ এর দশকের দিকেই পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝোঁকার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে দেশটি।
তাই মধপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি কাতারে অবস্থান করছে। আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের একটি দলকেও জায়গা করে দেওয়া হয়েেেছ। কাতারে তুরস্কও সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে। ফলে প্রতিবেশি যেকোনো দেশের আগ্রাসনন ঠেকাতে এই ঘাঁটিগুলো এক ধরনের নিরাপত্তা হিসেবেও কাজ করেছে।
প্রতিবেশীদের নিয়ে কাতারের আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগে সৌদি আরব, আমিরাত, মিশর ও বাহরাইন কাতারের ওপর অন্যায় অবরোধ চাপিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক এই অবরোধ আরোপের পর অর্থনৈতিক বৈচিত্রে আরও মনোযোগী হয় দোহা। সৌদি জোটের অবরোধের জবাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে ভালোভাবেই মানিয়ে নিতে পেরেছে দোহা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের তথ্য অনুসারে, অবরোধেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সচল রাখতে সমর্থ হয়েছে দেশটি।
নিষেধাজ্ঞার আগে কাতারের আমদানির ৬০ শতাংশেরও বেশি আসতো নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী চারটি দেশের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে কাতারের খাবার আসতো এসব দেশ হয়ে। ফলে নিষেধাজ্ঞার পরই কাতার সরকারকে দ্রুত তুরস্ক ও ইরানের মধ্য দিয়ে বিকল্প খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতেও মনোযোগ দিতে হয় দেশটিকে। দ্রুত দশ হাজারেরও বেশি গরু আমদানির মাধ্যমে দুধ সরবরাহ নিশ্চিত রাখা হয়। কাতারের সাবেক এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলেছেন, কাতার নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছে।
কাতারের বিনিয়োগ তহবিল আল রায়ানের সিনিয়র পরিচালক আকবর খান বলেন, অনেকের প্রত্যাশার চাইতেও ভালোভাবে সরকার এই সংকট মোকাবিলা করতে পেরেছে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছে নাগরিকদের জীবন যেনও আক্রান্ত না হয়। এই অবরোধ আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে কিন্তু ব্যবসা পরিচালনার সক্ষমতাকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।
কাতারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিদেশিদের বিপুলভাবে আকর্ষণ করছে। ২০০৩ সালে দেশটিতে মোট জনসংখ্যা ছিল সাত লাখের নিচে। কিন্তু ২০১৬ সালে মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখে। বাড়তি এই জনসংখ্যার বেশিরভাগই অভিবাসী। অভিবাসী শ্রমিকদের দ্বারা ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে কাতারে।