রাশিয়ানরা তাদের সেভিংস রুবলে জমানোর ব্যাপারেই দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে রাশিয়ান মুদ্রা টিকে আছে। শুধু টিকেই নেই, সাত বছরের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুবলের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে।
কর্মসংস্থান সেবা প্রতিষ্ঠান 'সুপারজব' এক জরিপে বলেছে, রাশিয়ানরা অর্থ জমানোর জন্য এখন রুবলকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করছে। জরিপের ৪৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এই মত দিয়েছে। জানুয়ারির তুলনায় এই হার এখন দ্বিগুণ হয়েছে। আর মার্চের তুলনায় বেড়েছে ১০ শতাংশ।
রাশিয়ান মিডিয়া গ্রুপ আরবিসি বলেছে, ১৫ বছরের গড় তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাতীয় মুদ্রার উপর নাগরিকদের আস্থা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ১২ শতাংশ রাশিয়ান মনে করে অর্থ জমানোর জন্য ডলার সবচেয়ে উপযোগি। আর পাঁচ শতাংশ মনে করে ইউরো বেশি নির্ভরযোগ্য।
জানুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান শুরুর আগে ২৩ শতাংশ রাশিয়ান ডলারকে অর্থ জমানোর জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করতো। আর ইউরোকে উপযোগি মনে করতো ১৫ শতাংশ মানুষ। রাশিয়ার সব অঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে সচল ১৬০০ নাগরিকের মধ্যে ওই জরিপ চালানো হয়েছে।
নিখুঁত তথ্য তুলে আনার জন্য এই অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা হয়তো যথেষ্ট নয়। কারণ রাশিয়ার জনসংখ্যা হলো ১৪৫ মিলিয়ন। কিন্তু রাশিয়ানদের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সংহত হচ্ছে, সেটা অন্যভাবেও বোঝা যায়। এই রাশিয়ানরা এখন ইউক্রেন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ায় মুদ্রার বিনিময় হার ২০১৪ সালে বেড়ে যাওয়ার পর ২০১৫ সালের এপ্রিলে হঠাৎ বড় ধরণের পতন হয়েছিল। জরিপে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে বিদেশী মুদ্রার প্রতি আস্থা সেই ২০১৫ সালের পর্যায়ে চলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় যে সংস্থা পেশাদার অর্থ বাজার এবং ব্যবসায়ীদের কাছে আর্থিক ও অর্থনৈতিক তথ্য সরবরাহ করে, সেই সংস্থাও রুবলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ব্লুমবাগ মে মাসের মাঝামাঝির্ রুবলকে ২০২২ সালের সবচেয়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক মুদ্রা ঘোষণা দেয়। ডলারের বিপরীতে রুবলের প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করে এই ঘোষণা দেয়া হয়। এই সংস্থার বিশেষজ্ঞরা যে ৩১টি প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রাকে বিবেচনায় নিয়েছেন, তার মধ্যে সেরা হয়েছে রাশিয়ান মুদ্রা।
তারা বলেছেন, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর রাশিয়া সরকার যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার কারণেই রুবল এত শক্তিশালী হয়েছে। যে সব রাশিয়ান বিদেশী মুদ্রায় তাদের পুঁজি জমিয়েছেন, তাদেরকে সেগুলো উত্তোলনের উপরও আপাতত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, রুবল শক্তিশালী হওয়ার পরও বিদেশী মুদ্রা কেনা কমায়নি রাশিয়া। ২০২২ সালের জুনে রাশিয়া বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শুন্য দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন রুবলের বিদেশী মুদ্রা কিনেছে।
১৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান - যাদের সম্মিলিত সম্পদ রাশিয়ার মোট ব্যাংকিং খাতের ৭৭ শতাংশ - এই প্রতিষ্ঠানগুলো এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন রুবলের ইউরো ও ডলার বিক্রি করেছে। এই মুদ্রাগুলো এসেছে মূলত রফতানি খাত থেকে। রেগুলেটর প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, এর পর থেকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদেশী মুদ্রার প্রবাহ কখনই কমেনি। ফলে সেখানকার ব্যাংকিং খাতে তারল্য বেড়ে গেছে।
তবে, দেশের বাজারে বিদেশী মুদ্রার প্রবেশের পাশাপাশি আমদানিও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে রাশিয়া। এ জন্যেই রুবল আরও শক্তিশালী হয়েছে। রাশিয়ার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ডলারের বিপরীতে রুবল শক্তিশালী হয়েছে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইউরোর বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। রুবলকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো থেকে একের পর এক বিস্ময় দেখা যাচ্ছে।
রাশিয়ান তেলের দাম কম হলেও ডলার আর ইউরোপিয় মুদ্রার বিপরীতে রুবল শক্তিশালী হচ্ছে। প্রমভিয়াসব্যাংকের বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিদেশী মুদ্রার চাহিদা কমে গেলে, এবং রফতানিকারকরা গ্রহণযোগ্য রেটে বিদেশী মুদ্রা বিক্রির চেষ্টা করলে এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটা ঠিক উদীয়মান বাজারে রুবলকে অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এখন ঝুঁকি নেয়ার আগ্রহ হারিয়েছে এবং রুবল সেই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
রাশিয়া আর পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত যত তীব্র হবে, ডলার আর ইউরো তত বিষাক্ত হয়ে উঠবে। জুলাই মাসে একটা প্রায় ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে, ডলার আর ইউরোর মূল্য সমান হয়েছে, এরপর ইউরোর মান ডলারেরও নিচে নেমে গেছে।
বিসিএস ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্টসের পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি ব্যাবিন বলেছেন, মস্কো এক্সচেঞ্জে ডলারের রেট ইউরোর চেয়ে বেশি। এর কারণ হলো বৈশ্বিক বিনিময় হারের সাথে মস্কোর বিনিময় হারের এখনও কিছু তারতম্য রয়েছে।
আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সিনিয়র ব্যবসায়ি ভøাদিস্লাভ সিলায়েভ বলেন, রুবলের মূল মেরুদন্ড হলো উদ্বৃত্ত বাণিজ্য। এটা যতক্ষণ ঠিক থাকবে, ততক্ষণ রুবল বড় কোন সমস্যায় পড়বে না। তিনি মনে করেন, শুধু ডলার বা ইউরো নয়, ইউয়ানের বিনিময় হারের মধ্যেও একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। রফতানি ও আমদানির মধ্যে একটা ভারসাম্য না আসা পর্যন্ত সেটা দূর হবে না। মে মাসে মস্কো এক্সচেঞ্জে যখন ডলারের দাম পড়ে ৬৬ রুবল, এবং ইউরো কমে ৭০ রুবল হয়, তখন তা ছিল একটা বড় ঘটনা।
আর্থিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী আরটেম ভেজদিন বলেন, রুবল যদি এভাবে শক্তিশালী হতেই থাকে, তাহলে রুশ সরকারকে বাজেট ব্যায় কমাতে হবে। জাতীয় মুদ্রা শক্তিশালী হয়ে উঠলে উৎপাদন শিল্পে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তখন রাশিয়ার পণ্য ও সেবা ব্যায়বহুল হয়ে উঠবে, এবং সে কারণে তার চাহিদাও কমে যাবে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী বছরে মুদ্রার রেট কেমন হতে পারে, সেটা অনুমান করা অসম্ভব হয়ে গেছে।
সাধারণ রাশিয়ানরা বিদেশী মুদ্রা না কিনলেও বিনিময় হারের হ্রাস বৃদ্ধি কৌতুহলী হয়ে দেখছে। তারা ভাবছে, রুবল এরপর কোথায় যাবে। শুধু তাই নয়, ডলার আর ইউরো রুবলের ব্যাপারে কি ধরণের আচরণ করবে, সেই কৌতুহলও তাদের রয়েছে। পিএসবি'র প্রধান বিশ্লেষক ইয়েগোর ঝিলনিকভ মনে করেন, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের বৈঠক হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউরোর বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, এটা ভাবা উচিত হবে না যে, ইউরোর মান নিচে নামতেই থাকবে।
এখন যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তা ঘটেছে বিশ্ব বাণিজ্যে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে। ইসিবি রেট বৃদ্ধি যখন শুরু হবে, তখন ইউরো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হবে বলে ধারণা করা যায়। আপাতত ডলার আরও শক্তিশালী হতে থাকবে, এবং এক ইউরো ০ দশমিক ৮৫ ডলারের সমান হয়ে যাবে।
একই ধরণের মত দিয়েছেন পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ দিমিত্রি ব্যাবিন। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদ ইউরোর মান কমে ০ দশমিক ৮ বা ০ দশমিক ৯ ডলার হতে পারে।
ইগর ঝিলনিকভের মত হলো, বছরের শেষ দিকে ইউরোর বিনিময় হার ৭৯ দশমিক ৯ রুবল হতে পারে। ব্যাবিন বলেছেন, গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ আমরা হয়তো দেখবো ইউরোর দাম ৭০ রুবলে নেমেছে। বছর শেষে সেটা ৭৫ রুবল হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা এ সব অনুমান জানালেও কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না, মুদ্রার অবস্থান আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। একমাত্র সময়ই সেটা বলতে পারবে।