সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তার দেশকে পশ্চিমা ছত্রছায়া থেকে বের করে আনতে চাইছেন। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি উচ্চাকাক্সক্ষী মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি। এ জন্য ব্যয় হচ্ছে শত শত বিলিয়ন ডলার। এই মেগা প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও তেলের দাম বেশি রাখতে বদ্ধপরিকর সৌদি আরব। এজন্য দেশটি নতুন বাজারের দিকে নজর দিয়েছে। সেই টার্গেট সামনে রেখে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি সরকার। এর মাধ্যমে দেশটি চীন ও ভারতের মতো বিশে^র সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশের বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ নিতে চায়।
ব্রিকস হলো আয়তন, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক শক্তির দিক থেকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত একটি অর্থনৈতিক জোট। ২০০৯ সালের ১৬ জুন ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের উদ্যোগে এই জোট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় এটি ‘ব্রিক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এটি ব্রিকস নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ব্রিকসের সদস্য প্রতিবছরই বাড়ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ¦ালানি সংকটে পড়া ইউরোপকে সুবিধা দিতে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সৌদি আরবের ওপর চাপ দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে তেলের উৎপাদন আরও কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি আরব ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস-এর সদস্যরা। এতে ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন ওপেক প্লাসভুক্ত তেল কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করার কঠিন হুঁশিয়ারি দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বিশে^র ৫টি বৃহৎ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে সৌদি আরবকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। আবেদন করেন সংস্থার সদস্যপদ লাভের। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র। কেননা এই জোটে আছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া।
কয়েক মাস আগে ব্রিকসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জোট আরও নতুন সদস্য গ্রহণে আগ্রহী। তবে নতুন সদস্য আসার আগেই ব্রিকসের জিডিপি জি-সেভেন-এর জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মোট ক্রয় ক্ষমতা এখন জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর থেকে বেশি। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্রিকস এখন নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বিকল্প আনার কথা ভাবছে। নতুন একটি মুদ্রা তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের সরাসরি বিরোধ এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরসহ অন্তত ১৯টি দেশ ব্রিকস জোটে যুক্ত হতে চায়। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের বার্ষিক সম্মেলন। এর আগেই এমন চাঞ্চল্যকর খবর দিল ব্লুমবার্গ।
জোটে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলাল বলেন, আমরা প্রতিদিনই জোটে যুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের অনুরোধ পাচ্ছি। এবারের সম্মেলনে ব্রিকসকে আরও সম্প্রসারিত করার বিষয়ে আলোচনা হবে। কীভাবে নতুন সদস্য নেওয়া হবে তা হবে আলোচনার মূল বিষয়। তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আবেদন করেছে ১৩টি দেশ। এসব দেশ আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। এছাড়া ৬টি দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে।
এই জোটের নেতৃত্বে আছে চীন ও রাশিয়া। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এরইমধ্যে ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। চীনা মুদ্রা রেনমিনবি বা ইউয়ানে বিনিয়োগও চলছে কিছু দেশের মধ্যে। ফলে বিশ্বজুড়ে ডলারের যে আধিপত্য ছিল তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
এ বছরের শুরু থেকেই ‘ডি-ডলারাইজেশন’ নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এখন ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ আছে। ডলারের আধিপত্য থাকায় দেশটি নিজের প্রয়োজনমতো ডলার ছাপিয়ে অনেক সংকট সামাল দিতে পারে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর একটি অংশ যদি ডলারের রিজার্ভ রাখা বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের সুপারপাওয়ার স্ট্যাটাসের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এরইমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ভিন্ন হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চীনের মধ্যস্থতায় বহু বছরের দ্বন্দ্ব ভুলে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে চুক্তি করেছে ইরান ও সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্য ক্রমশ শান্ত হয়ে আসার ইঙ্গিতও মিলেছে নানা দিক থেকে। ফলে সেখানে কমতে শুরু করেছে মার্কিন প্রভাব। সৌদি আরব এরইমধ্যে চীনা মুদ্রায় বাণিজ্যের পথে হাঁটছে।
আইএমএফ জানিয়েছে, অনেক দেশ এখন আর ডলার রিজার্ভ রাখতে চায় না। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর রিজার্ভের ৭০ শতাংশই ছিল মার্কিন ডলার। অথচ সেটি এখন ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। চীন-রাশিয়া নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। আর এর প্রথম পদক্ষেপ হতে চলেছে বিশ্বে ডলারের আধিপত্য কমানো।
সৌদি আরব ব্রিকস জোটে যোগ দিলে তা মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এই দেশটির অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। কোনো কোনো বিশ্লেষক সৌদি আরবের এই উদ্যোগকে একটি নিছক ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করলেও সামগ্রিক দিক থেকে এর আঞ্চলিক ও বৈশি^ক প্রভাব হতে পারে অনেক বেশি।
এর প্রথম প্রভাবটি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে ব্রিকস দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে হবে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা- এই ৫টি দেশ বিশে^র মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের ও জিডিপির ২৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দিলে তা কেবল এই জোটের আকার ও এর প্রভাবই বাড়াবে না, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি অর্থনৈতিক অংশীদারদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কেও প্রবেশ করবে।
সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দিলে গুরুত্বপূর্ণ যে সুবিধাটি লাভ করবে তা হচ্ছে দেশটির বাণিজ্যিক সুবিধা অনেক বেড়ে যাবে। তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ সৌদি আরব ব্রিকস ব্লকে জ¦ালানি খাতের একটি একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠবে। কেননা এই ব্লকের দেশগুলো বিশে^র মোট উৎপাদিত তেলের ৩০ শতাংশ ও গ্যাসের ২২ শতাংশ ব্যবহার করে।
সৌদি আরব ব্রিকসের সদস্য হলে দেশটি পশ্চিমা বিশে^ তার পুরনো মিত্রদের বাইরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুবিধা লাভ করবে। এতে সৌদি আরবের জ¦ালানির নতুন বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি দেশটির অর্থনীতিও আরও বেশি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হবে।
বিশে^র বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব ব্রিকসের সদস্য হলে জ¦ালানির ভূরাজনীতিও নতুন মাত্রা লাভ করবে। একইসঙ্গে তা জ¦ালানির বাজারে পশ্চিমা বিশে^র আধিপত্যকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কারণ, সৌদি আরবের ব্রিকস জোটে যোগদান জ¦ালানির মার্কেটে এই জোটের অবস্থানকে সংহত ও শক্তিশালী করবে। কৌশলগত এই অংশীদারিত্ব জ¦ালানি সহযোগিতা জোরদার, তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যৌথ অংশীদারিত্ব এবং জ¦ালানি বাণিজ্যের বিকল্প মেকানিজম গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এসব প্রক্রিয়া ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর বৃহত্তর জ¦ালানি নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে।
সৌদি আরব ব্রিকসে যোগদান করলে দেশটি বিনিয়োগ সুবিধাও পাবে। কারণ, ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এরইমধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থা হিসেবে এই ব্যাংক গঠন করেছে ব্রিকসের উদ্যোক্তারা। অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির ধারা অব্যাহত রেখেছে ব্রিকস। জোটের সদস্যগুলোর মধ্যে চীনই একমাত্র দেশ, যে কিনা টেকসইভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। বৈশ্বিক জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রেও জি-৭ জোটকে ছাড়িয়ে গেছে। তার ওপর জোটের সদস্যদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, ব্রিকস মুদ্রাব্যবস্থা ডলারের স্থান দখল করতে পারে। না হলেও অন্তত ডলারের একক রাজত্বকে নাড়িয়ে দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক শাসন এবং উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে ব্রিকস কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।
আর্জেন্টিনা, তুরস্ক ও সৌদি আরবসহ ৩০টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সে বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় জোটের শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা করা হবে। ব্রিকসের এসব উদ্যোগ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। আর যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির সবচেয়ে বিশ^স্ত মিত্র সৌদি আরবের ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ।