বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলার প্রধান মুদ্রা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটি হচ্ছে, আমেরিকান ডলারের আধিপত্য খর্ব করার জন্য সক্রিয় হয়েছে চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে মুদ্রাবাজারে। অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। বর্তমান বিশ্বে ব্যাংকগুলোর মোট রিজার্ভের ৭০ শতাংশই রয়েছে ডলারের দখলে। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর নিজেদের মুদ্রা চালুর এই চেষ্টায় ডলারের আধিপত্য কমছে কিছুটা হলেও। আর এতে উপসাগরীয় দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
মার্কিন ডলারবিহীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য কী তাৎপর্য বহন করছে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মৈত্রীর সম্পর্ক। কিন্তু এরপরও গত মার্চ মাসে চীন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রায় ৬৫ হাজার টন এলএনজি আমদানির একটি চুক্তি করেছে। মার্কিন ডলারের পরিবর্তে নিজের মুদ্রা ইউয়ানে এর মূল্য পরিশোধ করবে বেইজিং। ইউয়ান ব্যবহার করে সৌদি আরব থেকে তেল কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে চীন। এরই মধ্যে তারা ফ্রান্সের টোটাল এনার্জির সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেনও শুরু করেছে।
তবে বিশ্বে মার্কিন ডলারের আধিপত্য একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে এখনো পৌছেনি। তবে তা ক্রমান্বয়ে কমছে। বিশ্ববাণিজ্যে মার্কিন ডলার তার একচ্ছত্র আধিপত্য হারাবে একথা ভাবা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু এখন আর তা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়। গত ২৫ বছরে মার্কিন ডলারের মার্কেট শেয়ার ৭০ শতাংশের বেশি থেকে কমে ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ২০০১ সালে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে সারা বিশ্বে ডলারের ব্যবহার ছিল ৭৩ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছর তা কমে ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন ও তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমাদের নেওয়া পদক্ষেপ মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। মস্কোর ওপর রাশিয়ার সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা, মার্কিন ডলারে রাখা রাশিয়ার বৈদেশিক রিজার্ভ জব্দ করা ও অর্থ লেনদেনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার প্রধান ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়া মার্কিন ডলারবিরোধী আন্দোলনের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সর্বাত্মক অর্থনেতিক যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে ওয়াশিংটন গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের দক্ষিণাংশের দেশগুলোকে মার্কিন ডলারের বিকল্প সন্ধানের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মিডল ইস্ট ইন্সটিউিটের সিনিয়র ফেলো ড. জন ক্যালাব্রিজ দ্য নিউ আরবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীন তার মুদ্রা রেনমিনবি বা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শক্তিশালী একটি মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। ২০০৭-০৮ সালে শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় সারা বিশ্বে যেন ইউয়ানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে সেই চেষ্টায় অনেক সময় ব্যয় করেছে বেইজিং। দেশটির এই চেষ্টা ‘রেনমিনবি’র আন্তর্জাতিকীকরণ’ উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ডলারমুক্ত বিশ্ব বাণিজ্যের উদ্যোগ আরো গতি পায়। এ থেকে বেশি সুবিধা পেয়েছে চীন। কেননা, তখন থেকে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করে। চলতি বছর আরো বেড়েছে এর পরিধি।
সহজ কথায় বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিষেধাজ্ঞা আসক্তি’ই ডলারমুক্ত আন্তর্জাতিক বাণ্যিজ্যকে জোরদার করার চীন-রাশিয়ার উদ্যোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া ও নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে থাকা দেশগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্ত হচ্ছে ডলার হটানোর আন্দোলনে। এমনকি এসব দেশের মিত্র ও বাণিজ্যিক অংশীদাররাও এতে যোগ দিয়ে মার্কিন ডলার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
ইউক্রেনে হামলা করার জেরে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই মস্কো ঘোষণা করেছে, গ্যাস বা তেল বিক্রির অর্থ এখন থেকে রুবলে পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার বদলে বরং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে রুবল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্রাটেজিস্ট ডেভিড উ বিবিসিকে বলছেন, ‘রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ডলারের বিকল্প নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে অনেক দেশ। রাশিয়া ডলারের বদলে রুবলে লেনদেনের চেষ্টা করছে। চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়া থেকে রুবলে তেল ও গ্যাস কিনছে। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও রুবলে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর রাশিয়া সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে থাকে। ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে ইরান, চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুরসহ ১৮টি দেশের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের একটি চুক্তি করেছে ভারত। চীনও বৈদেশিক বাণিজ্যে তার মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করছে। কারণ তারাও চিন্তা করছে, কোনোদিন যদি তাদের অবস্থা রাশিয়ার মতো হয়, তখন কী হবে? ফলে অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
গত মার্চ মাসে ব্রাজিল ও চীন একটি চুক্তি করেছে যাতে দুই দেশের বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরস্পরের মুদ্রা ব্যবহার করবে। ইরান, ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার সাথে পণ্য বিনিময়ে ২০১৮ সালে সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছে চীন। এর মাধ্যমে তারা ইউয়ান বা রেনমিনবিতে লেনদেন করছে।
মার্কিন ডলার পরিহারের এই আন্দোলন সম্পর্কে রাইস ইউনিভার্সিটির বেকার ইন্সটিটিউট ফর পাবলিক পলিসির ওয়ালেস উইলসন ফেলো ড. জিম ক্রেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ডলারবিহীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা একটি ইন্স্যুরেন্স হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্বে বর্তমান রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলারের অবস্থান প্রায় ৭০ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে ইউরো, পাউন্ড ও ইউয়ানসহ অন্যান্য মুদ্রার অবস্থান। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, আগামী আগস্ট মাসে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসের সম্মেলনে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেতে পারে।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের নিজের মুদ্রায় লেনদেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিসেবে খুব বেশি কিছু না হলেও তা একেবারে তাৎপর্যহীন নয়।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র সিনিয়র ফেলো র্যাচেল জিয়েম্বার মতে, ইউএই থেকে চীনের এলএনজি আমদানির চুক্তি এই বার্তাই দিচ্ছে, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের এ ধরনের চুক্তি আগামীতে আরো হতে পারে। এ ধরনের চুক্তিগুলো ভবিষ্যতে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের অবস্থানকেই শক্তিশালী করবে। কেননা, উপসাগরীয় দেশগুলো মার্কিন ডলারমুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চলমান লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন, রাশিয়া ও ইরানের সাথে এসব দেশের সম্পর্ক অনেক ভালো। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জিসিসির সদস্য দেশগুলোর অবদানও অনেক বেশি।
বাহরাইন ইকোনমিস্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. ওমর আল ওবায়দি দ্য নিউ আরবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জিসিসির সদস্য দেশগুলো স্থিতিশীল ও আইনিকাঠামো-ভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। তবে এসব দেশ ডলারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় না থেকে বরং সহযোগি শক্তি হিসেবে থেকেই কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি বা সামনাসামনি বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কোনো আগ্রহ উপসাগরীয় দেশগুলোর নেই। বরং তারা বাস্তব পরিস্থিতির আলোকেই সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানান ড. ওমর আল ওবায়দি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে সৌদি অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জাদান জার্মাান সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে বলেছেন, তার দেশ ডরালের বাইরে অন্য মুদ্রাগুলোতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে চায়। চলতি বছর সৌদি কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে চীনের কাছে তেল বিক্রি করতে চান। অন্যদিকে, এসব দেশ চীন থেকে বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকে। ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে বাণিজ্য হলে চীনের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পাবে এসব দেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো ডলার পরিহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের কাছ থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা আদায় করতে চায়। কিন্তু তারা মার্কিন ডলার পরিহারের এই উদ্যোগে কতদূর পর্যন্ত যাবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে নিজের আধিপত্য ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে ডলারের প্রাধান্য কতদিন ধরে রাখতে পারবে তার ওপর উপসাগরীয় দেশগুলোর ডলার কেন্দ্রিক সংশ্লিষ্টতাও নির্ভর করবে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।