পুতিনের গোপন প্রাসাদ কেন?

-

  • ফারজানা তানিয়া
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৩৫

রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি দাবি করেছেন, দেশটির ধনিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে পুতিনের জন্য উপহার হিসেবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে।

সেখানে মনোরঞ্জনের জন্য একটি স্ট্রিপটেজ পোল, উজ্জ্বল সবুজ রঙের টেবিলসহ ক্যাসিনো, একটি আর্কেড এবং টয় কারের জন্য রেস ট্র্যাকসহ একটি কক্ষ রয়েছে।

রয়েছে গ্রিস থেকে আনা একটি প্রাচীন অর্থোডক্স চ্যাপেল। কৃত্রিম গুহায় একটি হকি রিঙ্ক এবং একটি ওয়াইন টেস্টিং রুম। মাটির নিচে রয়েছে ১৬ তলার বাঙ্কার। পাথর কেটে তৈরি একটি টানেল কৃষ্ণসাগরে ব্যক্তিগত ডক পর্যন্ত গেছে। রয়েছে সশস্ত্র রক্ষীদের চেকপয়েন্ট। এবং একটি হেলিপ্যাড।

আরও কত কী! এগুলো দানবীয় একটি প্রাসাদ-কাঠামোর অংশ। ১৯ হাজার ৩০০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত এ প্রাসাদ। মোনাকোর চেয়ে ৩৯ গুণ বড়। ককেসাস পর্বতমালা এবং কৃষ্ণসাগরের মাঝখানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গ ‘দ্য রাশিয়ান রিভিরা’র গেলেদঝিক শহরের বাইরে পাহাড়ি বনভূমিতে এর অবস্থান।

১৮ জানুয়ারি পোস্ট করা ১১৩ মিনিটের এক ভিডিওতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঝড় তোলা বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি এর বিশদ বর্ণনা দিয়ে বলেন, ১৩৫ কোটি ডলারের এ প্রাসাদ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন রাশিয়ার সবচেয়ে ধনিক গোষ্ঠী।

কোন পথে পরিভ্রমণ করে পুতিন কোল্ডওয়ারের সময় পূর্ব জার্মানিতে কর্মরত নিম্নসারির নগণ্য একজন কেজিবি অফিসার থেকে বিত্তশালী অত্যাচারী শাসকে পরিণত হয়েছেন, এ ভিডিওতে এর বিস্তারিত তুলে ধরেন নাভালনি। তিনি বলেন, রাশিয়ান কর্মকর্তারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তদন্তের নামে যে নোংরা ঘাটাঘাটি হয়, এটা এমন কিছু নয়। বরং, এটি পুতিনের ‘সাইকোলোজিক্যাল পোর্ট্রটে’-এর চেয়েও বেশি কিছু।

মস্কোতে ফেরার দুইদিন পর প্রচারিত এ ভিডিওতে নাভালনি বলেন, ‘প্রত্যেকে জানতে চান, নিয়মিত একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা কর্মকর্তা কীভাবে অর্থ ও বিলাসিতার পেছনে এত পাগলামিতে মত্ত হতে পারেন। ১৯ আগস্ট বিষপ্রয়োগ করার পর নাভালনিকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, রুশ গোয়েন্দারা তাকে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করেছেন।

নাভালনি ইস্যুতে রাশিয়া এখন উত্তপ্ত। দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। এ ইস্যুতে সরগরম বিশ^ রাজনীতিও। রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিনটি দেশ একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে।

নাভালনি সমর্থকদের পুতিনবিরোধী বিক্ষোভে জার্মানি, সুইডেন ও পোল্যান্ডের কূটনীতিকরা যোগ দিয়েছেন, এমন অভিযোগে রাশিয়া এ দেশগুলোর কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের রাশিয়া সফরের মধ্যেই এ বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। এর জবাবে জার্মানি, সুইডেন ও পোল্যান্ডও তাদের দেশে অবস্থানকারী রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে।

নাভালনিকে বিষ প্রয়োগে জড়িত ছিল এমন অভিযোগে গত বছরের অক্টোবরে ইইউ ছয় রুশ শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাশিয়ার একটি রাসায়নিক অস্ত্র গবেষণা কেন্দ্রের ওপর অবরোধ আরোপ করে। পুতিনের অনেক সহযোগীই বর্তমানে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের আওয়তায় রয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক প্রবীণ সৈনিককে মানহানির অভিযোগে সম্প্রতি মামলা করা হয় নাভালনির বিরুদ্ধে। একজন দুর্নীতিবিরোধী প্রচারক বলেছেন, এটি নাভালনির বিরুদ্ধে আরেকটি বানোয়াট মামলা। এ মাসে নাভালনিকে আরেকটি মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এ রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন।

নাভালনির প্রচার করা ভিডিওতে আলোচিত প্রাসাদটি পুতিনের বলে স্বীকার না করে ক্রেমলিন বলেছে, এর মালিক ব্যবসায়ীরা, যাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। জানুয়ারির শেষের দিকে পুতিনের শৈশবের বন্ধু এবং জুডো পার্টনার আকরাদি রোতেনবার্গ, যিনি পরে রাশিয়ার বৃহত্তম সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন, তিনি হঠাৎ বলে বসলেন, কাঠামোটি তার এবং সেখানে তিনি একটি হোটেল তৈরি করতে যাচ্ছেন।

ভিডিওটির ভিউ হয়েছে প্রায় ১১০ মিলিয়ন। সাধারণ রুশ নাগরিক, বিশ্লেষক এবং বিরোধী কর্মী, যারাই ভিডিওটি দেখেছেন, বিশ^াস করেছেন যে, প্রাসাদটি পুতিনের। তারা নিজেদেরকে একটি সাদামাঠা প্রশ্ন করেছেন: প্রাসাদটি কী বলছে তার মালিককে নিয়ে, যিনি রাশিয়াকে ২০ বছরেরও বেশি সময় শাসন করেছেন?

এক রুশ মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় অর্জিত এ গর্হিত সম্পদ এটাই প্রকাশ করে যে, এ ধরনের একটি কাঠামোর মালিকের ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ^াস পুনরুদ্ধারে মানসিক বিকারগ্রস্ততার চিকিৎসা প্রয়োজন।

মস্কোভিত্তিক এ মনোবিজ্ঞানী এবং লেখক বললেন, ‘কল্পনাকেও হার মানায়- এমন একটা থাকার জায়গার প্রয়োজন কার? আকার বড় না হলে যার সমস্যা হবে, তারই তো এ-রকম প্রাসাদ প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘এটাই বার্তা যে, আমি কত মহান। এটাই বিশাল বার্তা। যাদের আত্মবিশ^াস ও মূল্যবোধ আছে, তাদের চিৎকারের প্রয়োজন হয় না।’

তাছাড়া, বছরের পর বছর ধরে যেসব ক্রেমলিন-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পুতিনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে চাষাবাদ করে আসছিল, ভিডিওটি তা তছনছ করে পুতিনের সর্বজনীন ব্যক্তিত্বকে ধূলিস্যাত করে দিয়েছে।

নির্বাসিত বিরোধী নেতা গেনাডি গুদকভ বলেন, ‘এ ভিডিও অনেক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তার কাছে, অনেক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের কাছে, অনেক প্রৌঢ়ের কাছে মানুষ হিসেবে পুতিনের ইমেজকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পুতিন শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রের প্রতিমূর্তিও। তিনি রাষ্ট্রকেও ধ্বংস করেছেন।’

কেজিবি এবং এর উত্তরসুরী এফএসবি’র সাবেক কর্মকর্তা গুদকভ রুশ সংসদের নিম্নকক্ষ ডুমায় তিন-তিনবার নির্বাচিত আইনপ্রণেতা। কিন্তু, ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অপরাধে ২০১২ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

গড়পড়তা রাশিয়ানরা এ প্রাসাদকে ‘মাধুর্যহীন ঐশ^র্য’ আখ্যা দিয়ে বিষয়টি নিয়ে, এমনকি পুতিনের পুরো লাইফস্টাইল নিয়ে ক্ষুব্ধ। সাবেক সহকর্মী এবং প্রতিবেশীদের নিয়ে গঠিত তার বলয়ের ওপর আরও বেশি ক্ষুব্ধ তারা। অনেকে বলেন, তাদের আচরণ দখলদারদের মতো। দেখলে মনে হয়, তারা রাশিয়াকে বিজিত অঞ্চল মনে করে। বিষয়টা এমন- যে যত পার, দ্রুত লুঠে নাও।

ভ্লাদিমির নামে মস্কোভিত্তিক এক আইনজীবী বললেন, যে ব্যবস্থা তারা তৈরি করেছে, তাতে তাদের ‘দখলদার’ এবং রাশিয়াকে ‘দখলকৃত অঞ্চল’ বলা যায়। এ আইনজীবী নির্যাতনের ভয়ে তার নামের শেষের অংশ বলেননি। তিনি ভয় পান যে, তাকে ‘উগ্রবাদ’ এবং ‘রাশিয়ার সাংবিধানিক আদেশ ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা’র অপরাধে অভিযুক্ত করা হতে পারে।

নাভালনির মতো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক স্বাধীন প্রকাশনায় দাবি করা হয়, রাশিয়া এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে পুতিনের ঘনিষ্ঠদের কাছে বিলাসবহুল সম্পদ রয়েছে।

২০১৭ সালে নাভালনি একটি দীর্ঘ ভিডিও প্রচার করেন, যেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের অনেক সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। তিনি দাবি করেন, মেদভেদেভের কিছু প্রাইভেট ম্যানসন রয়েছেন, যেখানে ইনডোর সুইমিং পুল, কৃত্রিম পুকুর, হ্যালিপেড ও প্রাইভেট চ্যাপেল রয়েছে।

পুতিনের এ অভিযুক্ত প্রাসাদের অবস্থান দেখলে জেমস বন্ডের গোপন আস্তানা মনে হয়।

ভিডিওতে নাভালনি দাবি করেন, এ প্রাসাদের উপরে কোনো উড়োজাহাজ ওড়ার অনুমতি নেই। কোনো সাধারণ মানুষ, নৌকা কিংবা গাড়ি সেদিকে যেতে চাইলে ভারী নিরাপত্তা উপস্থিতি তাদের প্রতিহত করে।

ক্রেমলিন বলেছে, আবখাজিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে জনসমাগম সীমিত। এলাকাটি বিচ্ছিন্ন জর্জিয়ান প্রদেশ, যা কার্যত মস্কো নিয়ন্ত্রণ করে এবং রুশ সাবসিডি ও পর্যটকদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

স্থানীয় অধিবাসী এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, প্রাসাদটি পুতিনেরই। তারা একে ঘিরে নিয়মিত নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। সেখানে গেলে মোবাইলের সিগনাল কাজ করে না। মাঝেমধ্যে লিমুজিনের শোভাযাত্রা ও হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যায়।

২০১৪ থেকে ২০১৮ সময়ের মধ্যে গেলেদঝিকে কয়েকটি রেস্টুরেন্টে কাজ করা সের্গেই বললেন, ‘পুতিন যে এখানে আসেন, এটা সবাই জানে। কোনো সাধারণ মানুষ এর ধারেকাছেও যেতে পারে না।’

নব্বইয়ের দশকে পুতিনের সঙ্গে কাজ করেন রুশ ব্যবসায়ী সের্গেই কোলেসনিকভ। পরে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের ডেপুটি মেয়রও হন। তিনি ২০১৪ সালে বলেছিলেন, অবৈধভাবে সরানো তহবিলের বিলিয়ন ডলারে তৈরি একটি প্রাসাদ আছে পুতিনের।

পুতিনের সাবেক ব্যক্তিগত এক ফটোগ্রাফার বলেন, ৬৮ বছর বয়সী পুতিন গেলেদঝিকে দিনের পর দিন এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটান। তখন রুশ টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো ‘টিনজাত’ অথবা পূর্বে ধারণকৃত ফুটেজ রিলিজ করেন, যেখানে দেখানো হয়, তিনি ক্রেমলিনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন অথবা রুশ অঞ্চল সফর করছেন। যাতে, মানুষ মনে করেন তিনি মস্কোতেই আছেন।

এ ফটোগ্রাফার বললেন, ‘এক সপ্তাহ তিনি সেখানে, আর টিভি নেটওয়ার্কগুলো প্রতিদিন ‘বোতলজাত’ ফুটেজ দেখাচ্ছে। সবাই ভাবছেন, পুতিন মস্কোতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।’