অধিকাংশ বিলিওনিয়ার বা ধনকুবের অর্থ খরচ করেন নতুন ম্যানসন, ইয়ট এবং ব্যক্তিগত বিমান কেনার পেছনে। তারা অর্থ খরচ করেন তরুণী মডেল বা সেলিব্রেটিদের বিয়ে করা বা তরুণীদের পেছনে। বিশ্বের বিখ্যাত এক ধনী ব্যক্তি শেলডন এডেলসন এর ব্যতিক্রম। যদিও তিনি লাস ভেগাস ক্যাসিনো মোগল হিসাবে পরিচিত।
শেলডন এডেলসন ক্যাসিনো তথা জুয়ার ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। ৩৩ বিলিয়ন ডলার তিনি ব্যয় করেছেন ইসরাইলের ইহুদিদের পেছনে। এডেলসন একজন ইহুদি ভক্ত। যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইলের পক্ষে রাখার জন্য তিনি ব্যয় করেছেন তার বিপুল অর্থ।
রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত না হয়েও তিনি রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের রাজনীতিতে তিনি শীর্ষ একজন প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি হিসাবে ভুমিকা রেখে চলছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি পরিচিত কিং মেকার হিসেবে। এডেলসন লাস ভেগাস স্যান্ডস করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন সিঙ্গাপুরের আইকনিক মেরিনা বে স্যান্ড হোটেলের মালিক। ফোর্বস তালিকায় ২০২০ সালে তিনি ছিলেন বিশ্বের ২৮ তম ধনী।
রাজনীতিবিদদের পেছনে অর্থ ঢালা থেকে শুরু করে তিনি অকাতরে অর্থ বিলিয়েছেন ফিলিস্তিনে ইসরাইলের সীমানা সম্প্রসারনের পেছনে। ফিলিস্তিন এলাকা দখল করে আজকে যে ছোট একটি স্থানে আটকে রাখা হয়েছে তার পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে এডেলসনের অগাধ অর্থ। আর অর্থের মাধ্যমে কেনা ক্ষমতা। ইসরাইলীদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সামরিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের পেছনে রয়েছে এডেলসনের বিশেষ অবদান।
বলা হয়ে থাকে, ইসরাইল শুধু ফিলিস্তিন দখল করেনি, তারা দখল করেছে ওয়াশিংটনের মন। ওয়াশিংটনের মন দখলের পেছনে নিরন্তর প্রাপাগান্ডা এবং ইসরাইলের পক্ষে কথা বলার জন্য দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্রে বিরামহীন লবি, কৌশল আর আগাধ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছেন ইহুদী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং এডেলসনের মত অনেক ইহুদীপ্রেমী ধনকুবের। তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে লবি এবং ক্ষমতা কেনার পেছনে।
গত কয়েক বছরে শেলডন এডেলসন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রিপাবলিকনা পার্টিকে কমপক্ষে ১৫০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেন। এডেলসন অনেক রাজনৈতিক একশন কমিটির অর্থায়ন করেন। এগুলো তিনি করেছেন কর ছাড়ের তহবিল দিয়ে। অনেকে দাবি করেছেন এডেলসন ১১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন রাজনৈতিক অনুদান হিসেবে। গুটিকয়েক যেসব রাজনীতিবিদ এডেলসনের তোয়াক্কা করেননি এবং বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্রের ধারনা মেনে নেননি তাদের প্রতি ভীষন ক্ষুব্ধ হন এডেলসন। তারা শিকার হন তীব্র রাজনৈতিক আক্রমনের।
কিং মেকার এডেলসনের কাছ থেকে যেসব রাজনীতিবিদ সবেচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছেন তাদের মধ্যে দুজন হলেন সিনেটর নিউট গিংরিচ এবং মারকো রুবিও। তবে এডেলসনের কাছ থেকে অর্থ নেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক ফান্ডের আয়ের প্রধান উৎস ছিল এডেলসনের ক্যাসিনো ব্যবস্যায়ের অর্থ। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেন এডেলসন। এ ছাড়া এডেলসনের মত আরো অনেকে ইসরাইলপন্থী ধনকুবের ছিল ট্রাম্পের রাজনৈতিক ফান্ডের অর্থের যোগানদাতা। ট্রাম্পের অর্থের যোগানদাতাদের অনেকে সরাসরি ইসরাইলের লিকুদ পার্টির সাথে জড়িত।
ট্রাম্পের অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল কঠোর সম্প্রসারনবাদী নেতানিয়াহু সরকারকে সহায়তা করা। সমালোচকদের অনেকে ট্রাম্পকে অবিহিত করেছেন ইসরাইলের ট্রোজান হর্স হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল ট্রাম্প আর তার অনুগত লাঠিয়াল মাইক পম্পেও মাধ্যমে। ইসরাইলের প্রতি প্রশ্নহীন অনুগতদের জায়গা করে দেন। ইসরাইলের দাবী পুরনে তারা ছিলেন সব সময় তৎপর।
সিআইএ এবং ভয়েস অব আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক সংস্থাও একইভাবে বশীকরণ করা হয়। যেসব গণমাধ্যম ভাষ্যকার লিকুদ পার্টির লাইনে হাটতে রাজি হননি তাদেরকে সামনের সারিতে আসতে দেয়া হতো না ।
ইসরাইলে এডেলসনের ভূমিকা ছিল আরো সরাসরি এবং স্পষ্ট। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইসরাইল টুডে’ নামে একটি ফ্রি নিউজপেপার। এর উদ্দেশ্য ছিল বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার দল লিকুদ পার্টিকে সমর্থন দেয়া। নেতানিয়াহুর বিরোধী পিস পার্টিকে ধ্বংস করতে এডেলসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসরাইল টুডে ছাড়াও ইসরাইলে এডেলসনের আরো তিনটি পত্রিকা রয়েছে। এর একটি হলো দৈনিক ইসরাইল হাইয়োম। অপর দুটি হলো ইসরাইল উইকলি এবং মাকর রিশন। এ ছাড়া এডেলসন লাস ভেগাস রিভিউ জার্নালেরও মালিক।
দীর্ঘদিন অকাতরে অর্থ ঢালার পর এডেলসন তার শেষ কাজ করেন ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহুকে ডাইরেক্ট একশনের আদেশ দিয়ে। ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে ট্রাম্প তার শক্তি প্রদর্শন করেন । এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন এবং মরক্কো বের হয়ে আসে খোলস ছেড়ে। তারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। তারা কবর রচনা করে ফিলিস্তিনীদের জন্য। এসব রাজতন্ত্রী আর স্বৈরশাসকদের ওয়াশিংটনের আদেশ অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না । ট্রাম্পের অপর সমর্থক গোষ্ঠী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উগ্র খ্রিস্টানরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে লেখক আপটন সিনক্লেয়ার লিখেছিলেন ‘আমেরিকায় যখন ফ্যাসিবাদ আসবে তখন সেটা আসবে খ্রিস্টান ক্রস প্রতীকের অধীনে। এখন যেনো তাই ঘটছে।
ট্রাম্প সমর্থক যে গুন্ডাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস দখল করেছিল তাদেরকে দেখা গেছে বিভিন্ন ধর্মীয় স্লোগান লেখা ব্যানার বহন করতে। বিভিন্ন ব্যানারে দেখা গেছে ‘জেসাস সেভস’ লেখা স্লোগান। কিন্তু শীঘ্রই টিভি স্ক্রিন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এ ধরনের ফুটেজ।
আমেরিকান জীবনে উগ্র খ্রিস্টানদের প্রভাব এখনো অনেক শক্ত। আর একইভাবে অপরিসীম সমর্থন রয়েছে ইসরাইলের প্রতি। এরাই রিপাবলিকান দলের মূল শক্তি। অনেকের মতে এভাবে অনেক আগেই রিপাবলিকান মূলত একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। এটা আব্রাহাম লিঙ্কন আর আইজেন হাওয়ারের সাধারণ, পুরনো, সহনীয় কোনো রিপাবলিকান দল নয়।
২০১৪ সালে ইসরাইল গাজায় নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার সময় হিলারি ক্লিনটন থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট বারাকা ওবামা প্রত্যেকেই দৃঢ কন্ঠে বলেছেন, ইসরাইলীদের নিজেদের রক্ষার অধিকার রয়েছে। আর তারা এ অধিকার রক্ষার পক্ষে। অর্থাৎ তারা ইসরাইলের আত্মরক্ষার নামে বর্বর হত্যা অভিযানের পক্ষে। এভাবেই প্রতিবার ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরাইলের নিধনযজ্ঞ, দখলদারিত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে সমর্থন দিয়ে আসছে।
কংগ্রেসে দেয়া ভাষনে নেতানিয়াহুর ইসরাইলী সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার প্রতি যখন ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান উভয় দল দাড়িয়ে তীব্র হাততালির মাধ্যমে সমর্থন জানায় তখন তার মানে দাড়ায় তারা ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনীদের প্রতি চলমান এবং ভবিষ্যতের সব হত্যা আর ধ্বংসের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
২০১৪ সালের ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সিনেট সর্বসম্মতভাবে ইসরাইলের গাজা আগ্রাসন নীতিকে সমর্থন জানিয়ে রেজুলেশন পাস করেছিলো।
তবে অনেক ইহুদী পন্থী আমেরিকান ধনকুবের ইসরাইলের পক্ষে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচের পরও তরুন অনেক আমেরিকান ফিলিস্তিনীদের সমর্থন করছেন । ২০১৪ সালের ইসরাইলের গাজা হত্যাযজ্ঞের পর যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নামে গাজায় ইসরাইলী আগ্রসন এবং অবরোধের বিরুদ্ধে।
এমনকি আমেরিকান অনেক ইহুদীও প্রকাশ্যে ব্যানারসহ রাস্তায় নামে ফিলিস্তিনীদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে। অনেকে ডাক দেয় ইসরাইলকে বর্জনের। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রতি দাবি জানানো হয় ইসরাইলের প্রতি অবরোধ আরোপের। এতে তখন ঘাবড়ে যায় শেলডন এডেলসনের মত ইসরাইলপ্রেমীরা।
২০১৫ সালের ৫ জুন যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ানে শেলডনের ছবিসহ একটি খবর বের হয়। তাতে বলা হয় শেলডন এডেলসন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইসরাইল বিরোধী আন্দোলন দমনের উপায় নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। এতে বলা হয় ক্যাসিনো ম্যাগনেট শেলডন এডেলসন তার লাস ভেগাস ক্যাসিনোতে ইসরাইলপন্থী ধনকুবের আর কর্মীদের নিয়ে সপ্তাহ শেষে বৈঠকের আয়োজন করছেন। যেখানে ইসরাইল বিরোধী চলমান আন্দোলন দমনের উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
১৯৮২ সালে বৈরুত হত্যাকান্ডের পর বিশ্বব্যাপী তীব্র ইমেজ সঙ্কটে পড়ে ইসরাইল। এ ইমেজ পুনরুদ্ধারে তখন ইসরাইল ব্যাপকভিত্তিক প্রাপাগান্ডা কর্মসূচী হাতে ন্যায়। ব্যাপক লবি চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন এবং মধ্য পশ্চিম অঞ্চল বাইবেল বেল্ট নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের সমাজ রাজনীতি এবং চার্চে রয়েছে ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের ব্যাপক আধিপত্য। নতুন রিপাবলিকানরা এই বাইবেল বেল্টের যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বর্ণবাদ নিয়ে এসেছেন। এই বাইবেল বেল্ট বুদ্ধি বিরোধী, বর্ণবাদী, শিক্ষা বিরোধী এবং ধর্মের নামে অন্ধ গোড়ামী দ্বারা পরিচালিত।
ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে জর্জিয়া, টেনেসি, আলাবামা, মিসিসিপি, নর্থ ক্যারোলাইনা, সাউথার্ন এন্ড ওয়েস্টান ভার্জিনিয়া, সাউথ ক্যারোলাইনা এবং ইস্ট টেক্সাস, আরকানসাস, কেনটাকি, লুইজিয়ানা, মিসৌরীর মতো স্টেটগুলোতে।
আমেরিকার বাইবেল বেল্টসহ গোড়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনের জন্য ট্রাম্প নিজেকে একজন আধা- ধর্মীয় বিবলিক্যাল ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাড় করিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছেন। তার অনেক অদ্ভুত আচরন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। আসলে এগুলো ছিল রাজনৈতিক নাটক। গোড়াদের মনজয়ে তিনি নাটক করে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত তারা ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্যাপিটল হিল দখল করেছে।
এ ধরনের দানবীয় রাজনৈতিক অপরাধের পরও রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের হাতের মুঠোয়ই থেকেছে । তারা এখনো অনেক শক্তিশালী। আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে তারা জয়ীও হতে পারে এবং তাদের ক্ষমতা আরো বাড়তে পারে। ট্রাম্প আর তার ইসরাইলী মিত্ররা সেদিনের জন্য দিন গুনছে ।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের বিশ্বস্ত মিত্র শেলডন গ্যারি এডেলসন মারা যান এ বছরের ১১ জানুয়ারি। তখন তার বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর। তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে। সমাহিত করা হয়েছে জেরুজালেমের মাউন্ট অব অলিভস কবরস্থানে।