প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তুরষ্কের রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন আধুনিক তুরস্ককে স্বয়ম্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনাকারী। যিনি মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, দক্ষ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কুরআনের হাফেজ। তুরস্কের সব মতের মানুষের কাছে এরবাকান হোজা বা এরবাকান উস্তাদ নামে পরিচিত। মৃত্যুর পরও যিনি তুরস্ক ও মুসলিম বিশ্বে যথেষ্ট আলোচিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালে ১৯২৬ সালের ২৯ অক্টোবর উত্তর তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের সিনপে এরবাকানের জন্ম। পিতা মোহম্মদ সাবরি এরবাকান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হতেন। মায়ের নাম খায়ের। পিতার কর্মসূত্রে তিনি ঘুরেছেন দেশটির আনাচে কানাচে।
প্রাথমিক শিক্ষা কায়সেরি শহরে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে। গৃহশিক্ষকের কাছে পেয়েছেন ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ। ইস্তাম্বুল বয়েজ কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মেধা, মনন ও প্রতিভা গুণে অনেক শিক্ষক ডাকতেন ‘দরিয়া নাজমুদ্দিন’ বা ‘জ্ঞানের সাগর’ বলে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পুরো তুরস্কের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। ভর্তি হন ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং শিক্ষানবীশ শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে জার্মানির আচেন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পুনরায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ইস্তাম্বুলেরই টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার আগে মাত্র ২৭ বছর বয়সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কেউ শিক্ষকতা করেননি।
নাজমুদ্দিন এরবাকান ছিলেন দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী এক প্রজ্ঞাবান চিন্তানায়ক। ছাত্র অবস্থায় তিনি পরিবর্তনের আকাঙ্খা নিয়ে রাজনৈতিক ভাবনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি একাধিক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বার বার তার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবারই তিনি নতুন নামে দল গঠন করে আইনসিদ্ধ পন্থায় পুনরায় তৎপরতা শুরু করেছেন।
তুরস্কে তখন ইসলামী অনুশাসনের উপর ছিলো কড়া নিষেধাজ্ঞা। এরবাকান- সেই দুঃসময়কে পাল্টে দিতে চাইলেন। সময়ের বিপরীত স্রোতে চলার অবিচল মনোবল দেখালেন। তুরস্কের মানুষের ভেতরে ইসলামী ধ্যান-ধারণা জাগ্রত করার লক্ষ্যে কাজ করলেন। একই সাথে বৃহৎ তুরস্ক গড়ার লক্ষ্যে নিয়ে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করেন। কিভাবে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আসুন জেনে নেই।
প্রখ্যাত আলেম জাহেদ আহমেদ কুতকু এর পরামর্শে ১৯৬৯ সালে ১০ জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন মিল্লি গুরুশ বা জাতীয় ভিশন আন্দোলনের। ‘মিল্লি গরুশ’ এর অর্থ ‘জাতীয় ভিশন’। ‘জাতি’ বুঝাতে তিনি তুরস্ক ও মুসলিম উম্মাহর মিশন-ভিশনকে এক করে দেখেছেন। লক্ষ্য ছিল, তারুণ্যের ভেতর জাগৃতির মন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া, আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া, জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পন্ন করা, উম্মাহর ঐক্য চেতনায় ভর করে সাম্রাজ্যবাদ ঠেকানো।
এরবাকান ১৯৬৯ সালে সুলেমান ডেমিরেলের রাজনৈতিক দল আদালত পার্টি থেকে নমিনেশন চেয়ে পাননি। কিন্তু কোনিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। এরবাকান এরপর গঠন করেন মিল্লি নিজাম পার্টি বা ন্যাশনাল অর্ডার পার্টি। এই দলের নেতৃত্ব দেন ২৬ জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে ২০ মে ১৯৭১।
মিল্লি সালামেত পার্টি বা ন্যাশনাল সলভেশন পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। আর দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। রাফাহ পার্টি বা ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতৃত্ব দেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত। ফজিলত পার্টি বা ভারচু পার্টিও সাথে সক্রিয় ছিলেন ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত। সা’দাত পার্টি বা ফেলিসিটি পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ২০০৩ সালের ১১ মে থেকে ২০০৪ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরবাকানের দলের নাম পরিবর্তন ও দল গঠনের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা। যখনই নতুন দল গঠন করে এগিয়ে গেছেন তখন তুরস্কের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার তার দলের কার্যক্রমের ওপর বিধি নিষেধ অরোপ করেছে।
নানা প্রতিকুলতরা মধ্যদিয়ে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জনগণের ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হয় এরবাকানের নেতৃত্বাধীন ওয়েলফেয়ার পার্টি। আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে এটাই প্রথম ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত কোনও ইসলামিক রাজনৈতিক দলের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়। ইসলামী সংগঠন ‘মিল্লি গোরুশ’ এর রাজনৈতিক শাখা ছিল এ দলটি। ১৯৯৬ এর ২৮ জুন থেকে ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তুরষ্কের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন এরবাকান। এর আগে ১৯৭৭ সালের ২১ জুলাই থেকে ১৯৭৮ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত একটি কোয়ালিশন সরকারের হয়ে তুরস্কের উপ-প্রধামন্ত্রী ছিলেন।
তুরস্কে ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বন্দুকের নলের মুখে সামরিক বাহিনী এরবাকান সরকারকে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর নিষিদ্ধ করা হয় ওয়েল ফেয়ার পার্টিকে। পার্টির নেতৃস্থানীয় বাক্তিদেরকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় ভাবধারার লোকদের বের করে দেয়।
স্বল্প সময়ে শাসনে তুরস্কের আভ্যন্তরি উন্নতিতে এরবাকানের সরকার গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখে। তিনি শুধু আভ্যন্তরিন উন্নয়নের দিকে মনোযোগি ছিলেন না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও আমুল পরিবর্তন আনেন। তবে তুরস্কের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। নাগরিকদের মধ্যে আত্নবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেন।
স্বনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা থেকে তার সময় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয় । গড়ে তোলা হয় অসংখ্য শিল্প কারখানা। যেখানে বিপুল সংখ্যক তরুন জনগোষ্টীর কর্মসংস্থান হয়। এরবাকানের সরকার ১১ মাসেই- সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়। কৃষকদেরকে ২০০ ভাগ বেশী ভর্তুকি দেওয়া শুরু করেন। সকল প্রকার কর্মচারীর বেতন ভাতাকে ৩০০ গুন বাড়িয়ে দেয়া হয়। তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম ব্যাল্যান্স বাজেট দেয়া হয়। অর্থনীতিকে সুদ মুক্ত করার লক্ষ্যে নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সুদকে সম্পূর্ণ রূপে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ সময় সুদের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বনিম্নে নিয়ে এসেছিলেন।
এছাড়া তুরস্ককে ওআইসিতে কার্যকর ভুমিকা পালনের উদ্যেগ নেয়া হয়। ইসলামিক ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এরবাকান। তুরস্ক ও ইরানের মধ্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানো হয়। ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। মুসলিম দেশগুলোর কমন মার্কেট ধারণার উদ্ভাবন এরবাকানের।
নাজমুদ্দিন এরবাকানের পররাষ্ট্রনীতিতে আমুল পরিবর্তন আনেন। মুসলিম দেশগুলির মধ্যে জি-৭ এর আদলে উন্নয়নশীল মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে গঠন করার ডি-৮। প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির সাথে সখ্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে তুরস্ক নিবিড় সর্ম্পক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যার ধারবাহিকতা এখনও আছে।
তিনি ক্ষমতায় না থেকেও বসনিয়াকে স্বাধীন করার জন্য মুজাহিদ বাহিনী পাঠানো এবং সেখানে অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। বিরোধীদলে থেকেও সবরকমের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। বসনিয়ান নেতা আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচের সাথে ছিলো তার ঘনিষ্ট সর্ম্পক।
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে তার্কি সাইপ্রাস তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে আসে। এর আগে ক্যু এর মাধ্যমে সেনা শাসনের অধীনে আসে গ্রীস। এরপরই দ্বীপটিতে মুসলিমদের উপর নেমে আসে চরম মাত্রার নির্যাতন। তুরস্কের ক্ষমতায় তখন মিল্লি গুরুশ। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ উপ-প্রধানমন্ত্রীর আসনে মিল্লি গুরুশের প্রতিষ্ঠাতা এরবাকান। প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত এজেভিদ তখন ইংল্যান্ড সফরে। পদাধিকার বলে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা তার হাতে। ১৯ জুলাই এরবাকান আদেশ দিলেন সেনাবাহিনীকে পুরোদমে সাইপ্রাস অভযানের। ৭০০ গ্রীক সৈন্যকে আটক করে দ্বীপটিতে তুরস্কর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টিত হয়। তুর্কি সাইপ্রাসের মানচিত্র প্রফেসর এরবাকান নিজে তৈরী করেন।
মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে এরবাকান দেখিয়ে গিয়েছেন কীভাবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দেশকে স্বনির্ভর করার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বলতেন- ‘আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য নয় বরং সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতি করি। আসুন জেনে নেই তার শাসনের আরো কিছু দিক
১৯৯৭ সালে তার ক্ষমতাকালে ইসরাইল কোনো হামলা করার সাহস পায়নি ফিলিস্তিনে। সে সময়ের ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, আপনারা কী কারণে হামলা করেননি। উত্তরে তিনি বলেছিলো- ‘যে ব্যক্তি একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে সাইপ্রাস দখল করে নিতে পারে, তার ক্ষমতাকালে ফিলিস্তিনে হামলা করা আত্মহত্যার শামিল।’ তিনি মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এজন্য তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
মাত্র ৫ বছরের ক্ষমতা থেকে তিনি তুরস্ককে যে শক্ত ভিত দিয়েছেন তার উপর নির্ভর করেই তুরস্ক এ পর্যন্ত এসেছে। ইনসাফের সমাজ নিয়ে, প্রায়োগিক রাজনীতির কর্মকৌশল ও ধরন নিয়ে তার জীবনভিত্তিক লেখা ‘দাওয়াম’ বা ‘আমার সংগ্রাম’ অনেকেরই প্রেরণা হয়ে আছে । এরবাকান ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আঙ্কারার চানকায়ায় গুভেন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।