ইরানের অগ্রগতির নেপথ্যে নারী


  • রওশন আলম
  • ২১ জুলাই ২০২১, ১২:২৩

ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ঐতিহাসিকভাবে পারস্য এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান নামে পরিচিত দেশটি। ইউরেশিয়ার কেন্দ্রে এবং হরমুজ প্রণালীর কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভূ-কৌশলগতভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইরান। রাজধানী ও বৃহত্তম শহর তেহরান দেশটির অগ্রগামী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে। আয়তনের দিক থেকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পৃথিবীর সপ্তদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র।

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে ইরান বা ইরন নামে ডাকতো। ইরান নামটি এসেছে ওই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে। তবে গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পার্সিস বলে ডাকত, যা বর্তমানে ইরানের ফার্স প্রদেশ। পার্সিস থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া, যা বাংলায় পারস্য হিসেবে পরিচিত। ১৯৩৫ সালে ইরানের তৎকালীন শাসক দেশটিকে শুধু ইরান বলেই ডাকার অনুরোধ করেন। তখন থেকেই দেশটি ইরান নামে সারাবিশ্বে পরিচিত লাভ করে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং এর নাম হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান।

ইরানিদের অর্থনীতি প্রধানত তেল ও গ্যাস-নির্ভর। বিশ্বের ১০ শতাংশ তেল ও ১৫ শতাংশ গ্যাসের মজুদ রয়েছে ইরানে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতি করেছে ইরান। যেমন- পেট্রোলিয়াম, পেট্রোকেমিক্যাল, সার, গাড়ি উৎপাদন, যন্ত্রাংশ, ফার্মাসিউটিক্যালস, নির্মাণ শিল্প এবং অস্ত্রশিল্প থেকেও আয় করছে ইরান।

ইরানের সংস্কৃতি পারস্য সংস্কৃতি হিসেবেও পরিচিত, যা বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে। ইরানকে সভ্যতার দোলনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সংস্কৃতির কারণে পশ্চিমে ইতালি, ম্যাসিডোনিয়া, ও গ্রিস- উত্তরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ এবং পূর্বে ভারত উপমহাদেশেও ইরানি সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রভাব রয়েছে।

ইরানের শিল্প-ঐতিহ্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী। এর আওতায় রয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, স্থাপত্যকলা, চিত্রাঙ্কন, বুনন, মৃৎশিল্প, হস্তলিপিবিদ্যা, ধাতব ও পাথরের কর্ম ইত্যাদি। ইরানি শিল্পকলা একাধিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। গত দশকে ইরানি চলচ্চিত্র তিন শতাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার-সহ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। দেশটির খ্যাতিমান ফার্সি চলচ্চিত্রকার হলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মাজিদ মাজিদি, জাফর পানাহি ও আসগর ফরহাদি।

ইরানের প্রধান ও জাতীয় ভাষা হলো ফার্সি। ৭৮ শতাংশ মানুষ ফার্সি তথা মাতৃভাষায় কথা বলে। এছাড়া ১৮ শতাংশ তুর্কি এবং ২ শতাংশ মানুষ সেমিটিক ভাষা ব্যবহার করে। দেশটিতে প্রায় ৮৬টি ভাষা রয়েছে।

ইরানের সাহিত্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ সাহিত্য, যার ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের বেশি। ইসলামী স্বর্ণযুগ ও আধুনিক ইরানের প্রখ্যাত কবিরা ইরানি সাহিত্যকে মানবতার অন্যতম সেরা সাহিত্যে পরিণত করেন। বলা হয়, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম চারটির একটি হলো ইরানি সাহিত্য। আলেকজান্ডারের পার্সেপোলিস এবং ৬৪১ সালে আরবদের ইরান আক্রমণকালে অসংখ্য গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়। ওই সময় পুড়িয়ে ও নদীতে ফেলে দিয়ে বই-পুস্তক ধ্বংস করা হয়। কিন্তু তারপরও সাহিত্যের প্রতি ইরানিদের ভালোবাসা ও মোহকে দমিয়ে রাখা যায়নি।

ইরানি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো সঙ্গীত। যা পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে। পার্শ্ববর্তী তুর্কি ও আরবি সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি মুঘল আমলে তা ভারতেও পৌঁছায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ইরানে জটিল বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তি হয়। পূর্ব ইরানে সোনা, রূপা ও কপারের তৈরি অসংখ্য তূর্য পাওয়া যায়। আধুনিককালে ইরানি সঙ্গীতে বিভিন্ন ধরনের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী লোক ও ধ্রুপদী সঙ্গীত। এছাড়াও পপ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য ধরন তথা জ্যাজ, রক, ও হিপহপও ইরানের সঙ্গীতের অংশ হয়ে গেছে।

ইরানি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এর সমৃদ্ধ ও প্রাচীন নৃত্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দে উৎপত্তি হলেও সময়ের সাথে সাথে তা আরও উন্নত ও বিস্তৃত হয়েছে। বিভিন্ন উৎসব যেমন- বিবাহ বা নরুজ উদযাপনে পরিবেশিত হয় এই নৃত্য। উন্নত ধরনের নৃত্যে হাত ও বাহুর সাবলীল বিচরণ- যেমন কবজির ঘূর্ণন দেখা যায়।

ইরানি স্থাপত্যও খ্রিস্টপূর্ব ৫ হাজার বছরের পুরনো। এর নিদর্শন তুরস্ক, ইরাক, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান থেকে দক্ষিণ ককেশাস ও জাঞ্জিবার পর্যন্ত পরিলক্ষিত। ইরানিদের নকশা ও নির্মাণকৃত ইউনেস্কো ঘোষিত ১৯টি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান রয়েছে। অবশ্য এর ১১টি ইরানের বাইরে অবস্থিত।

আরবদের বিজয়ের পূর্বে প্রায় এক হাজারের বেশি সময় জরাথুস্ট্রবাদ ছিল ইরানের জাতীয় ধর্মবিশ্বাস। ইরানিরা ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের দর্শনে এই ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ব্যাপক প্রভাব ছিল। তবে বর্তমান ইরানে ৯৮ ভাগ মানুষ মুসলমান।

ইরানের সর্বত্র রয়েছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় নানা ঐতিহাসিক স্থান। বাম শহরের বিখ্যাত রেশম পথের ওপর জাতীয় দালানটি ইরানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কিন্তু ২০০৩ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে ২০০০ বছরের পুরনো দালানটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরান সরকার তা পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। কেরমানশাহ প্রদেশে রয়েছে বেহিস্তুনের শিলালিপি, যেখানে পাহাড়ের গায়ে প্রাচীন পারসিক, ব্যাবিলনীয় এবং এলামীয় অক্ষরে অনেক খোদাইকৃত লেখা পাওয়া যায়। ইস্পাহান শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিখ্যাত নক্শ-ই জাহান ময়দান, দক্ষিণের শাহ মসজিদ অন্যতম।

দক্ষিণ-পশ্চিমের পার্সেপোলিস, উত্তর-পশ্চিমের সোলতানিয়েহ শহরের ধ্বংসাবশেষ এবং ইল-খান ওলজেইতুর সমাধিস্তম্ভ দর্শনীয় স্থান। পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে আছে রাজা সুলায়মানের স্মৃতিবিজড়িত তীর্থস্থান তাখ্ত-ই-সুলাইমান।

ইরানে প্রথাগত এবং আধুনিক খেলাধুলার প্রচলন আছে। ইরানের জাতীয় ক্রীড়া হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে ফ্রিস্টাইল কুস্তিকে বিবেচনা করা হয়। কুস্তির একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে ফুটবল ইরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ইরানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শরীরচর্চা খুবই জনপ্রিয়।

ইরানিদের প্রধান খাবারের মধ্যে আছে চাল, ভেড়া ও মুরগির মাংস, মাছ, সবজি ও বাদাম। তাল, ডালিম, কুইন, প্রুনিস, খুরফু ও রেসিনস ইরানের জনপ্রিয় ফল। ইরানিদের রান্নায় জাফরান, শুকনো লেবু, দারুচিনি ও পেসলে ব্যবহৃত হয়। আজকের দিনে ইরানে সর্বাধিক জনপ্রিয় মিষ্টিজাতীয় খাবার হচ্ছে আধা-জমায়িত নুডলস দিয়ে তৈরি ফালুদা। এছাড়া জাফরান আইসক্রিম ঐতিহ্যবাহী ইরানি খাবার।

ইরানের আজকের উন্নতির পেছনে পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে নারীর বিরাট অবদান। ইরানি নারীরা খুবই কর্মতৎপর। অফিস-আদালত, বিমানবন্দর, হোটেল, মার্কেট, কৃষিক্ষেত তথা সর্বত্র পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে নারীর পদচারণা। সাধারণত নারীরা অপেক্ষাকৃত কম ভারী কাজগুলো করার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তবে সর্বত্র ইরানি নারীরা তৎপর হলেও কোথাও নেই অশ্লীলতা-বেহায়পনা।

ইরানি সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নওরোজ বা ফার্সি নববর্ষ। যা ইংরেজি বছরের ২১ মার্চ শুরু হয়। চার হাজার বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে এই নববর্ষ। নওরোজের উৎপত্তির পেছনে বেশ কিছু মজার লোককথা প্রচলিত আছে। ইরানি জাতির সবচেয়ে বড় এই জাতীয় উৎসবটি দীর্ঘ ১৩ দিন ধরে পালিত হয়। ইরানিরা এই উৎসবকে ঈদ বলেও মনে করেন। দেশটিতে অন্য যেকোনো জাতীয় উৎসবের চেয়ে নওরোজে বেশিদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা থাকে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছুটি থাকে প্রায় এক মাস।

বসন্তের প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া নওরোজের আগেই ইরানিরা ঘর-দোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে। পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিস ফেলে দিয়ে তারা নতুন জিনিস কেনে। নতুন জামা-কাপড়, জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। মেহমানদারির জন্য চলে ব্যাপক আয়োজন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর বসে।

ইরানি জাতির নওরোজ বা ফার্সি নববর্ষের উৎসব পালনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পর উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন আসে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে যুক্ত হয় ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান। মুসলমানরা বসন্ত ঋতুতে গাছপালার পুনরায় সবুজ হওয়াকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ বলে মনে করেন এবং এদিন প্রথম প্রহরেই মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ দোয়া করেন। সামর্থ্যবানরা তাদের সাধ্যমতো অর্থ বা জিনিসপত্র নিয়ে গরীব, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান।

উৎসবের শেষদিন অর্থাৎ ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউ ঘরে থাকেন না। বরং তারা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক স্পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝর্ণা, পাহাড়, পার্ক- এসব স্থানে তারা চাদর বিছিয়ে বা তাঁবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করেন এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।