মুসলিম বিশ্বের ধনী দেশ ব্রুনেই

ছোট একটি দেশ ব্রুনেই -

  • ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৬:৩৪


দক্ষিণ চীন সাগরের দক্ষিণ প্রান্তে মালয়েশিয়ার পেটে ছোট একটি দেশ ব্রুনেই। পশ্চিম আর উত্তরে সাগরের দিগন্ত বিস্তারি জলরাশি। দক্ষিণ দিকটায় মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া। পূর্বে বেশ খানিকটা দূরে ফিলিপিন। উত্তর দিকে সাগরপথে হাজার মাইল পাড়ি দিলে পড়বে ইন্দোচীন। মালয়েশিয়ার সাবাহ, সারাওয়াক আর ফিলিপিনের মুসলিম প্রদেশটিতে মূলত এদের শিকড়। হাজার বছরের ঐতিহ্য আবর্তিত হয়েছে মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। দেশটি মূলত একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র। যদিও সুলতানের রয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য। চৌদ্দ শতকে ছোট দেশটিতে একটি শক্তিশালী সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ তারই নিরবচ্ছিন্ন ২৯তম উত্তরাধিকার।


বর্তমান সুলতানের পিতা সুলতান হাজি ওমর আলি সাইফুদ্দিন স্বেচ্ছায় অবসরে যান ১৯৬১ সালে। বড় সন্তান হিসেবে সালতানাতের দায়িত্ব্ পান ক্রাউন প্রিন্স হাসান আল বলকিয়াহ। ইসলামি ভাবধারা আর মূল্যবোধের অনুসরণে পরিচালিত ব্রুনেই। তবে রাজকীয় অনুষ্ঠানে আড়ম্বরের অভাব হয় না। হাসানের রাজকীয় অভিষেক হয় ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট। ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণকারী সুলতানের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ। ব্রিটেনের মিলিটারি একাডেমিতে অ্যাডমিশনের সুযোগ পান। ক্যাপটেন হিসেবে তিনি কমিশন পান সেখানে। পাশাপাশি তিনি মালয়েশিয়া থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজমুকুট গ্রহণ করার পর একই সাথে তিনি প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, ব্রুনেই দারুসসালামের ধর্মীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।


বর্তমান রাজা হাসানের পিতা সাইফুদ্দিনকে আধুনিক ব্রুনেইয়ের রূপকার বলা হয়। হাসান আল বলকিয়াহের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রিন্স হাজি আল-মুহতাদি বিল্লাহ। তিনি ক্রাউন প্রিন্স। ইতোমধ্যেই ঘোষণা হয়ে গেছে তিনি ব্রুনেই সালতানাতের ৩০তম উত্তরাধিকার। তার জন্ম ১৯৭৪ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি কুরআনে হাফেজ। ইসলামের মৌল বিষয়ে তাকে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হচ্ছে। শরিয়ত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন দেশটিতে বাধ্যতামূলক। ক্রাউন প্রিন্সকে ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মূলত সরকারি কর্মকান্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জনের জন্য এ ব্যবস্থা।


চৌদ্দ থেকে ষোড়শ শতকে ব্রুনেইতে শক্তিশালী মুসলিম সালাতানাত গড়ে ওঠে। মালয় অংশের সাবাহ, সারাওয়াক ও ফিলিপিনের ভাটি অঞ্চল নিয়ে তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। বর্তমান সালতানাত বিশ্বের পুরাতন সালতানাতগুলোর একটি। উনিশ শতকে ব্রুনেই সালতানাত যুদ্ধ, হাঙ্গামা আর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের মুখে মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়।


১৮৪৭ সালে সুলতান ব্রিটেনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৮৮৮ সালে এটি ব্রিটিশ করদ রাজ্যে পরিণত হয়। নিযুক্ত হয় ব্রিটিশ শাসক। তিনি সুলতানের উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেও ক্ষমতার চাবিকাঠি তার হাতেই চলে যায়। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিষয় ছাড়া রাষ্ট্রের সব বিষয় ব্রিটিশ নিযুক্ত উপদেষ্টা সর্বময় ক্ষমতার চর্চা করতেন। ১৯৫৯ সালে একটি সংবিধান রচিত হয়। এর আওতায় ব্রুনেইকে অভ্যন্তরীন স্বায়ত্তশাসনের নামে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে সুলতানকে পুরো স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। তবে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক যাবতীয় বিষয়ে ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতে থেকে যায়। ১৯৮৪ সালে ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিন। তারা এদিন পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ছয় সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ শাসক হন। এরপর মন্ত্রিসভাকে ১১ সদস্যে উন্নীত করা হয়। দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দেয়া হয়। সুলতানের আরো কিছু সহযোগী নিয়োগ দেয়া হয়।
ছোট এ মুসলিম দেশটি অর্থসম্পদে সমৃদ্ধ। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। মুলত তেল রফতানি থেকে আয় করে থাকে। তেলসম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও অর্থনৈতিক বহুমুখিতার জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার জন্য ভ্রুনেইর খ্যাতি আছে। বন্দর সেরি বেগওয়ান বিশ্বের অন্যতম বিমানবন্দর। চার হাজার মিটারের রানওয়ে। যেকোনো ধরনের এয়ারক্রাফট এখানে ল্যান্ড করতে পারে। বছরে ১৫ লাখ মানুষ গমনাগমনের সুবিধা এবং ৫০ হাজার টন মাল বহন করার সুযোগ রয়েছে এ বিমানবন্দরে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা সর্বাধুনিক যা মাত্র চার লাখ মানুষের দেশে কল্পনা করা যায় না।
১৯৭৪ সালে ব্রুনেই রয়াল এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বর্তমানে বিশ্বের একটি নামকরা বিমান সংস্থায় পরিণত হয়েছে। দেশে আরো একটি বিমানবন্দর রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য হ্যালিপ্যাড সুবিধা। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর মুয়ারা। এর অবকাঠামো ব্যবস্থাও সর্বাধুনিক। এ ছাড়া আরো দু’টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। ব্রুনেইতে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। এ সময় মাথায় রাখা হয় মানুষের বসবাস এলাকা, ব্যবসায়িক কেন্দ্র ও শিল্প এলাকা। প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে হাইওয়ে, লিঙ্ক রোড ও ফ্লাইওভার। দেশে আড়াই হাজার কিলোমিটারের উন্নত পাকা সড়ক। এতে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের পাথর, বালি ও কেমিক্যাল।
শিক্ষাব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। সরকার মানসম্পন্ন শিক্ষায় বেশ মনোযোগী। ১৪৭টি সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রয়েছে ৬০টি বেসরকারি স্কুল। যারা ছাত্রাবাসে থাকবে না তাদের জন্য ফ্রি যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ব্রুনেই দারুসসালালাম। সরকার ব্যাপক হারে শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। যেসব বিষয়ে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই সেসব বিষয়ে ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে বাইরে পাঠানো হয়। সরকার জনগণের জন্য বিনা খরচে চিকিৎসাসেবা দেয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে সড়ক বা নৌ যোগাযোগ নেই সেখানে বিমানে করে সরকার জনগণকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। প্রত্যেকটি জেলায় চারটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। তার ওপর দু’টি করে বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে। ৩২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি রাজধানীতে অবস্থিত। এখানে সর্বাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। জনগণের আবাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগ রয়েছে ব্রুনেইতে।


এখানে নিরক্ষীয় জলবায়ু। আবহাওয়া উষ্ণভাবাপন্ন। বাতাসে বেশি মাত্রায় জলীয় দ্রবণ। তাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জায়গাভেদে ২৫০০ মিলিমিটার থেকে ৭৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। বিশেষ করে উপকূলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশি। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ সবসময় বেশি থাকে বলে ঋতু পরিবর্তন বোঝার উপায় নেই এ দেশে। সবসময় দেশে একই ধরনের আবহাওয়া লক্ষণীয়।
দেশটি চারটি জেলায় বিভক্ত। এগুলো ব্রুনেই মুয়ারা, টুটঙ্গ, বেলায়েত এবং টেমবুরাঙ্গ। রাজধানী বন্দর সেরি বেগওয়ান। এর বিস্তৃতি ১৬ বর্গমিটার। অন্য উল্লেখযোগ্য শহর হচ্ছে মুয়ারা। এটি প্রধান সমুদ্রবন্দর।


দেশের নাম : ব্রুনেই দারুস সালাম
সরকার ব্যবস্থা : সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, মালয় ইসলামিক রাজতন্ত্র নামে পরিচিত
স্বাধীনতা : ১ জানুয়ারি ১৯৮৪
রাজধানী : বন্দরসেরি বেগওয়ান
আয়তন : ৫হাজার ৭৬৫ বর্গ কিলোমিটার
খনিজ সম্পদ : পেট্রোলিয়াম , গ্যাস ও টিম্বার
জনসংখ্যা : ৪ লাখ ৫০ হাজার
জাতিগত পরিচয় : মালয় ৬৬. ৩ শতাংশ , চীনা ১১.২ শতাংশ, উপজাতি ৩.৪ শতাংশ, অন্যান্য ১৯.০১ শতাংশ
ধর্ম : মুসলিম ৬৭ শতাংশ, বৌদ্ধ ১৩ শতাংশ ও খ্রিস্টান ১০ শতাংশ
প্রতিরক্ষা : ছোট এই দেশটিতে সেনা বাহিনী নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনী রয়েছে। ১৭ বছরের পর সবাইকে বাধ্যতামুুলক সামরিক শিক্ষা গ্রহন করতে হয়।